বর্তমানে ‘গণতান্ত্রিক সংকট’ মোকাবিলা করছে বিশ্ব। গবেষণায় দেখা গেছে, পৃথিবীর এক তৃতীয়াংশ মানুষ এমন পরিবেশে বাস করছে যার অধীনে কর্তৃত্ববাদী সরকার রয়েছে। কিন্তু সেখানে বলা হচ্ছে গণতন্ত্র আছে। আরেক গবেষণায় দেখা গেছে, পৃথিবীর ৬৭ শতাংশ মানুষ এমন রাজনৈতিক পরিবেশে বসবাস করছেন যেখানে পূর্ণ গণতন্ত্র নেই। এশিয়াতেও এমন অনেক দেশ আছে যেগুলো গণতান্ত্রিকও নয়, কর্তৃত্ববাদও নয়।
রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে বিংশ শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কার্যকরী ছিল পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে। একবিংশ শতাব্দীতে এসে সে চিত্র অনেকটাই বদলে গেছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে পৃথিবীর অনেকে দেশে গণতন্ত্র নামেমাত্র কার্যকর রয়েছে। বিংশ শতাব্দীর মতো অনেক দেশে সরাসরি সামরিক শাসন না থাকলেও, অনেক দেশে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারগুলো সামরিক একনায়কদের মতোই আচরণ করছে বলে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের পর্যবেক্ষণে বলা হচ্ছে।
বিশ্ব পরিস্থিতি
এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক ইনস্টিটিউট ফর ডেমোক্রেসি অ্যান্ড ইলেক্টোরাল অ্যাসিস্ট্যান্স (আইডিইএ) আজ সোমবার প্রকাশিত ‘গ্লোবাল স্টেট অব ডেমোক্রেসি ২০২১’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে বলেছে, বিশ্বজুড়ে একটি বৃহত্তর সংখ্যক দেশ কর্তৃত্ববাদের দিকে ধাবিত হচ্ছে। এর আগে কখনো এত বেশিসংখ্যক প্রতিষ্ঠিত গণতন্ত্রকে হুমকির মুখে পড়তে দেখা যায়নি।
সুইডেনের স্টকহোমভিত্তিক আন্তসরকার সংস্থাটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জনতুষ্টিবাদী রাজনীতি, সমালোচকদের থামিয়ে দিতে করোনা মহামারিতে বিধিনিষেধের ব্যবহারকে হাতিয়ার করেছে। এর জন্য অন্যদের গণতন্ত্রবিরোধী আচরণকে নকল করার প্রবণতা এবং সমাজকে বিভক্তকরণে ব্যবহৃত বিভ্রান্তিমূলক তথ্য প্রচারই দায়ী।
এদিকে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান প্রথমবারের মতো ক্রমাগত নিচের দিকে যাচ্ছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। বলা হয়, ২০১৯ সালে দেশটির গণতন্ত্রে ‘দৃশ্যমান অবনতি’ শুরু হয়।
প্রতিবেদনের সহলেখক আলেক্সান্ডার হাডসন আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থা এএফপিকে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রে গণতন্ত্রের সর্বোচ্চ চর্চা হয়। ২০২০ সালে নিরপেক্ষ প্রশাসনের (দুর্নীতি এবং পূর্বাভাসযোগ্য প্রয়োগ) সূচকগুলোতে দেশটি উন্নতি করেছে। তবে নাগরিকদের স্বাধীনতা সংকুচিত হওয়াসহ আরও কিছু বিষয় সেখানে গণতন্ত্রের মৌলিক বিষয়গুলোতে ঘাটতি আছে।’
প্রতিবেদনে বলা হয়, অতীতের চেয়ে অনেক বেশি দেশ ‘গণতান্ত্রিক অবক্ষয়ের’ শিকার হচ্ছে। ১৯৭৫ সাল থেকে সংকলিত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে বলা জানিয়েছে আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থা রয়টার্স।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বিশ্বজুড়ে ‘গণতান্ত্রিক পশ্চাদপসরণ’-এর মধ্য দিয়ে যাওয়া দেশের সংখ্যা এত বেশি কখনো ছিল না। সরকার ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং মানবাধিকারের ক্ষেত্রগুলোতে পশ্চাদপসরণমূলক বাঁকের কথা উল্লেখ করে প্রতিবেদনে এ তথ্য দেওয়া হয়।
উদাহরণ হিসেবে আফগানিস্তানের সাম্প্রতিক অবস্থা ছাড়াও মিয়ানমারের পরিস্থিতির কথা উল্লেখ করা হয় এতে। বলা হয়, এসব দেশে ইতিমধ্যে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। গত বছর মালিতে সেনা অভ্যুত্থানের কথাও বলা হয়েছে প্রতিবেদনে।
ব্রাজিল ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো বৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফলাফলের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে দেখা গেছে। বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশ ভারতে সরকারি নীতির সমালোচকদের বিচারের মুখোমুখি করা হয়েছে; যা দেশগুলোর গণতন্ত্রের অবনমনেরই ইঙ্গিত করে।
ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে হাঙ্গেরি, পোল্যান্ড, স্লোভেনিয়া ও সার্বিয়ায় গণতন্ত্রের সবচেয়ে বেশি পতন হয়েছে। এ ছাড়া ২০১০ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে তুরস্ক তাদের গণতন্ত্রে সবচেয়ে বড় পতন দেখেছে।
বৈশ্বিক জনসংখ্যার ৭০ শতাংশ এখন এমন দেশে বাস করছে, যেসব দেশে হয় গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা নেই বা গণতান্ত্রিকভাবে পিছিয়ে পড়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। যার মধ্যে আছে আমাদের বাংলাদেশও।
এএফপির প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বে প্রতি দুজনে একজনের বেশি মানুষ এমন দেশে বাস করছেন, যেখানে গণতন্ত্রের অবনমন ঘটছে। আর প্রতি তিনজনে একজন মানুষ কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থার মধ্যে বসবাস করছেন বলে আইডিইএর প্রতিবেদনে বলা হয়।
গণতন্ত্র এবং ইতিহাস
প্রখ্যাত আমেরিকান রাষ্ট্রবিজ্ঞানী স্যামুয়েল ফিলিপস হান্টিংটন তার ‘দ্য থার্ড ওয়েভ: ডেমোক্রেটাইজেশন ইন দ্য লেট টোয়েন্টিথ সেঞ্চুরি’ বইয়ে আধুনিক বিশ্বে গণতন্ত্রের তিনটি জোয়ারের কথা বলেছেন। প্রথম জোয়ারটি ছিল ১৮২৮ থেকে ১৯২৬ সাল পর্যন্ত। শত বছরের এই সময়ে যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্সসহ বিশ্বের ২৯টি দেশ গণতন্ত্রের পথে যাত্রা শুরু করে। এরপর ১৯২০ থেকে ১৯৪০ সাল পর্যন্ত ২০ বছর গণতন্ত্রের ভাটার সময় গেছে। তখন কোথাও ফ্যাসিজমের আবার কোথাও কমিউনিজমের বিকাশ হয়েছে।
গণতন্ত্রের দ্বিতীয় জোয়ার শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যৌথ বাহিনীর বিজয়ের পর। তখন বিশ্বে গণতান্ত্রিক দেশের সংখ্যা দাঁড়ায় ৩৬। ১৯৫৮ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত আবার ভাটা আসে। এ সময় সাবেক ঔপনিবেশিক দেশগুলোতে কর্তৃত্ববাদী শাসন জোরদার হয়ে ওঠে।
হান্টিংটনের মতে গণতন্ত্রের শেষ জোয়ারটি ছিল ১৯৭৪ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত, এ সময়ে দক্ষিণ ইউরোপ, দক্ষিণ আমেরিকা, এশিয়া ও বিভিন্ন কমিউনিস্ট দেশে গণতন্ত্রের বিকাশ ঘটে। ১৯৯৪ সাল নাগাদ বিশ্বে গণতান্ত্রিক দেশের সংখ্যা দাঁড়ায় ৭২।
হান্টিংটন আজ বেঁচে নেই। থাকলে হয়তো তিনি গণতন্ত্রের আরও আরও ঢেউ নিয়ে লিখতেন। গবেষণা করতেন। তবে তিনি ১৯৯১ সালে যখন তার এ গবেষণাটি শেষ করেন তখন তিনি আশঙ্কা করেছিলেন, দ্রুতই আরেকটি ভাটার টান আসবে। সেই আশঙ্কা তার গবেষণারই অংশ। কারণ, তিনি প্রতিটি জোয়ারের শেষে ভাটার টান দেখিয়েছেন। সম্ভবত বর্তমান বিশ্বে গণতন্ত্রের সেই ভাটার টানটাই দীর্ঘায়িত হচ্ছে। শুধু দীর্ঘায়িতই নয়, সমূলে নষ্ট করছে গণতন্ত্রের সম্ভাবনাকে।
কিভাবে বুঝবেন একটি দেশে গণতন্ত্র নেই?
গণতন্ত্রের মূল বিষয় হচ্ছে নির্বাচন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে নির্বাচন হলো ‘গণতন্ত্রের প্রাণভোমরা’। সে নির্বাচন হতে হবে এবং অবাধ ও স্বচ্ছ। যে দেশে নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি এবং জবরদখল হয় সেটিকে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বলতে নারাজ রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা।
যে দেশে গণতন্ত্র থাকে না, সেখানে শাসকগোষ্ঠী নিয়মিত নানা ধরণের নির্বাচন অনুষ্ঠান করলেও সেসব নির্বাচনের প্রতি মানুষের কোন আস্থা থাকেনা। ভোটাররা ভোট প্রদানের ক্ষেত্রে উৎসাহ হারিয়ে ফেলে। তারা ভোট দেবার জন্য ভোট কেন্দ্রে যেতে চায়না।
গণতন্ত্রে জনগণের মতামতের প্রাধান্য একটি বড় বিষয়। একটি সরকার নির্বাচিত হলেই গণতান্ত্রিক হয় না। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে গণতন্ত্র না থাকলে এবং একনায়কতন্ত্রের আবির্ভাব হলে জনগণের মতামতকে সহিংসভাবে দমনের চেষ্টা করা হয়। এর ফলে জনগণ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করার সামর্থ্য হারিয়ে ফেলে।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে একটি দেশে যখন গণতন্ত্র থেকে বিচ্যুত হবার দিকে ধাবিত হয় তখন সংসদে ক্ষমতাসীনদের একচ্ছত্র আধিপত্য থাকে। সংসদে কার্যত কোন বিরোধী দল থাকেনা।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে গণতন্ত্র না থাকলে দেশের নিরাপত্তা বাহিনীগুলো নানা ধরণের আইন-বহির্ভূত কাজ জড়িয়ে পরে। কারণ, শাসক গষ্ঠী তাদের ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য নিরাপত্তাবাহিনীকে রাজনৈতিক দমন-পীড়ন এবং সাধারণ মানুষকে দাবিয়ে রাখার কাজে ব্যবহার করে।
গণতান্ত্রিক পরিবেশ না থাকলে স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশের ক্ষেত্রে মানুষের মধ্যে ভয়ের পরিবেশ তৈরি হয়। সেক্ষেত্রে সংবাদমাধ্যমও স্বাধীনভাবে কাজ করতে ভয় পায়। এমনকি শাসকগোষ্ঠী ইন্টারনেটও নিয়ন্ত্রণ করতে চায় যাতে করে মানুষ সেখানে নিজেদের মতামত প্রকাশ করতে না পারে।
একনায়কতন্ত্রে দুর্নীতির ব্যাপক বিস্তার ঘটে। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ক্রয় করার জন্য এই দুর্নীতি ব্যবহার করা হয়। এই ব্যবস্থায় দুর্নীতি এমন সুন্দরভাবে সাজানো হয় যে, সেটি অল্প কিছু ব্যক্তির উপর নির্ভর করে। শাসকের অনুগত হবার বিনিময়ে তাদের দুর্নীতি করার সুযোগ করে দেয়া হয়।
একনায়ক শাসকরা অবসরের ভয়ে থাকেন। তাদের মনে থাকে যে ক্ষমতা হারানোর পর একটি অনিশ্চিত পরিস্থিতির তৈরি হবে। ফলে তাদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ প্রতিশোধ নিতে পারে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৫৩৫
আপনার মতামত জানানঃ