বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী
প্রশান্ত ত্রিপুরা
সাম্প্রতিক কালে বাংলাদেশের গণমাধ্যম ও বিভিন্ন বইপত্রে ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’ কথাটির ক্রমবর্ধমান ব্যবহার অনেকের চোখে পড়ে থাকবে, বিশেষ করে একটি মিথ্যা বিতর্কের জালে আটকে পড়া ‘আদিবাসী’ শব্দটির নিরাপদ ও গ্রহণযোগ্য বিকল্প হিসেবে বহু ব্যক্তি, সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান এটি চালানোর চেষ্টা করছে।
কিন্তু এক্ষেত্রে যে বাস্তবতা অগ্রাহ্য করা হয় তা হলো, ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’ (বা সরকারি বানানে দ্বিতীয় শব্দটির গায়ে হাইফেনসমেত ‘ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী’) বলতে যাদের বোঝানো হচ্ছে, সেসব জনগোষ্ঠীর শিক্ষিত ও সচেতন অংশ এই নামে অভিহিত হওয়ার ব্যাপারে আপত্তি জানিয়ে আসছে শুরু থেকে।
অধিকন্তু ব্যুত্পত্তিগত বিচারে ও নৃবৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকেও পদটি সমস্যাজনক।
এসব বিষয়ে এরই মধ্যে আমি প্রচুর লেখালেখি করেছি (যেমন— ২০১৫ সালে প্রকাশিত আমার বহুজাতির বাংলাদেশ: স্বরূপ অন্বেষণ ও অস্বীকৃতির ইতিহাস শীর্ষক গ্রন্থে একাধিক প্রবন্ধ রয়েছে, যেগুলো বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে প্রাসঙ্গিক) এবং আপাতত আমার দিক থেকে পেশ করার মতো উল্লেখযোগ্য কোনো নতুন পর্যবেক্ষণ বা বিশ্লেষণ নেই।
তথাপি নিজের আগে বলা কিছু কথাই নতুন করে আবার বলতে হচ্ছে সম্প্রতি বণিক বার্তা পত্রিকায় প্রকাশিত একটি সম্পাদকীয়তে চোখে পড়া কিছু মন্তব্যের প্রেক্ষাপটে।
আমার বিবেচনাধীন সম্পাদকীয়টি ছাপা হয়েছে ১৭ নভেম্বর বণিক বার্তায়, ‘প্রান্তিকতার পথে সাঁওতাল জনগোষ্ঠী: উন্নয়ন দুর্বলতারই লক্ষণ’ শিরোনামে; যেটির মূল বক্তব্যের সঙ্গে আমি সহমত।
অধিকন্তু সম্প্রতি গাইবান্ধা জেলার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলাধীন একটি স্থানে যেভাবে সহিংস পন্থায় একটি সান্তাল (‘সাঁওতাল’ নামের আরেক রূপ) পল্লী উচ্ছেদ করা হয়েছে, সেই পটভূমিতে উপস্থাপনাটি খুবই সময়োপযোগী হয়েছে।
কাজেই এটি ছাপানোর জন্য আমি দৈনিকটিকে সাধুবাদ জানাচ্ছি।
তবে উক্ত সম্পাদকীয়তে নিজেকে উদ্ধৃত হতে দেখা ছিল আমার জন্য এক অপ্রত্যাশিত সম্মান, যদিও যে ভাষায় আমার বক্তব্য তুলে ধরা হয়েছে, তাতে আমি যথেষ্ট বিব্রতও বোধ করেছি।
এমনিতে মোটাদাগে আমার যে বক্তব্য তুলে ধরা হয়েছে, তা ঠিকই আছে। আলোচ্য সম্পাদকীয়তে আমার নাম উল্লেখ করে বলা হয়েছে, ‘তিনি বলেছেন, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভূমি হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে।
এ ব্যাপারে রক্ষাকবচ হিসেবে যে আইন ও সরকারের সদিচ্ছা থাকা দরকার, তা নেই। মৌখিক আশ্বাস সব সরকারই দিয়েছে।
তবে প্রকৃতপক্ষে যথাযথ আইনি ও নীতিনির্ধারণী পরিকাঠামো এবং তার জন্য যে রাজনৈতিক সদিচ্ছা দরকার, তার ঘাটতি রয়েছে।’
আমার এই কথিত বক্তব্যের উৎস হলো, একই কাগজে আগের দিন গুরুত্ব দিয়ে প্রথম পাতায় ছাপানো ‘উন্নয়নে পরিত্যক্ত সাঁওতাল জনগোষ্ঠী’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন, যেখানে আমার বক্তব্য হিসেবে একটি উদ্ধৃতি ছিল, যাতে একটু ভিন্নভাবে উপস্থাপিত একটি বাক্য ছাড়া বাকি সব কথা হুবহু একই।
ভিন্নতার জায়গাটা হচ্ছে, সম্পাদকীয় থেকে তুলে ধরা উপরের উদ্ধৃতির প্রথম বাক্য, যেখানে আগের দিনের প্রতিবেদনে লেখা ছিল, ‘আদিবাসীদের ভূমি হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে তাদের প্রান্তিকতার কারণে।’
এক্ষেত্রে ‘আদিবাসী’ শব্দের জায়গায় ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’ বসিয়ে সেটিকে আমার বক্তব্য হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে দেখে আমি যথেষ্ট বিব্রত হয়েছি।
আমার লেখালেখির সঙ্গে যাঁরা কিছুটা হলেও পরিচিত, যাঁরা খেয়াল করেছেন কীভাবে একাধিক নিবন্ধে আমি ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’ পদটির সীমাবদ্ধতার ওপর আলোকপাত করেছি, তাঁরা হয়তোবা বিস্মিতই হবেন আমার এমন কথিত বক্তব্যে।
তবে এ ধরনের সম্ভাব্য পাঠক প্রতিক্রিয়ার চেয়েও যে বিষয়টি আমার বিবেচনায় অধিকতর তাত্পর্যপূর্ণ তা হচ্ছে, বণিক বার্তার সম্পাদকীয়তে পরিলক্ষিত এই ভাষিক আরোপণ কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা বা সংশ্লিষ্ট সম্পাদকের অমনোযোগের ফল নয়, বরং তা ব্যাপকতর পরিসরে ক্রিয়াশীল একটি আধিপত্যকামী প্রবণতার অংশ।
অনেকেই জানেন, বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে একটি প্রচারণা চালানো হয়ে আসছে যে, ‘আদিবাসী’ ধারণাটি এ দেশে প্রযোজ্য নয় অথবা যেসব জনগোষ্ঠী ‘উপজাতি’ হিসেবে পরিচিত, তাঁরা আন্তর্জাতিক আইনের আলোকে ‘আদিবাসী’ হিসেবে কোনো অধিকার চাইতে পারেন না।
অনেকে আরেক ধাপ এগিয়ে এমন কথাও বলে আসছেন যে, ‘আদিবাসী’ শব্দটি অসাংবিধানিক ও সরকারিভাবে নিষিদ্ধ, এ অবস্থায় এটি যাঁরা ব্যবহার করেন, তাঁরা আসলে রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপে লিপ্ত।
তবে ‘আদিবাসী’ শব্দটি ব্যবহারের ব্যাপারে কথিত সরকারি নিষেধাজ্ঞা আসলে অত্যন্ত ধোঁয়াটে একটি বিষয়, যার পেছনে কোনো স্বচ্ছ আইনি ব্যাখ্যা অথবা জোরালো কোনো বুদ্ধিবৃত্তিক ভিত্তি নেই।
এটা ঠিক যে, আমলাতান্ত্রিক কায়দায় গোপনীয় চিঠিপত্র বা প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ‘আদিবাসী’ শব্দটিকে নিষিদ্ধ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা একাধিকবার হয়েছে, যে ব্যাপারে বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে।
কিন্তু ‘আদিবাসী’ শব্দটি যদি সত্যিই সরকারিভাবে নিষিদ্ধ হতো, তাহলে সেটিকে কেন গোপনে প্রচার করতে হবে— তা ভেবে দেখার বিষয়।
ক্ষমতাসীন মহলে কারা কেন ‘আদিবাসী’ শব্দটির বিরুদ্ধে তৎপর রয়েছেন, ঠিক কোন প্রক্রিয়ায় তাঁরা কাজ করেন, এসব প্রশ্ন জনসমক্ষে ওঠানোর এবং সেসবের উত্তর খুঁজে বের করার একটা বড় দায়িত্ব বর্তায় বাংলাদেশের সাংবাদিক সমাজের ওপর।
দুর্ভাগ্যবশত এ ধরনের কোনো গভীর অনুসন্ধানী কাজ হয়েছে বলে আমাদের জানা নেই, বরং দেশের প্রায় সব কয়টি প্রতিষ্ঠিত পত্রিকা ও টিভি চ্যানেল, এমনকি বিবিসি বাংলার মতো আন্তর্জাতিক সংস্থাও ইদানীং ‘আদিবাসী’ শব্দটির বদলে ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’ পদটিই ব্যবহার করতে শুরু করেছে।
কেন এমনটি হচ্ছে, সে প্রশ্নের উত্তর এক কথায় দেয়া মুশকিল, তবে দীর্ঘ দুই যুগের ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ ও গবেষণার আলোকে আমি বলতে পারি, ‘আদিবাসী’ শব্দটি নিয়ে বাংলাদেশে যে ধরনের আপত্তি ও বিভ্রান্তি রয়েছে, সেগুলো একেবারে নতুন নয় এবং সবার আপত্তিও আসলে ঠিক একই কারণে নয়।
এসব ব্যাপারে বিস্তারিত ব্যাখ্যা আমি অন্যত্র দেয়ার চেষ্টা করেছি, সেগুলোর পুনরাবৃত্তিতে না গিয়ে এখানে এটুকুই বলব যে, বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন মহলে যাঁরা ‘উপজাতি’ শব্দটি স্বচ্ছন্দে প্রয়োগ করেন কিন্তু বলে বেড়ান যে ‘আদিবাসী’ ধারণাটা এ দেশে প্রযোজ্য নয়, তাঁরা অনেকে হয়তো জানেনও না যে আন্তর্জাতিক আইনে (যেমন— বাংলাদশের অনুস্বাক্ষর করা আইএলও কনভেনশন ১০৭ অনুসারে) ‘উপজাতি’ ও ‘আদিবাসী’ বলার মধ্যে অধিকারের প্রশ্নে কোনো ফারাক নেই।
এ প্রসঙ্গে আরেকটি বিষয় উল্লেখ্য যে, আন্তর্জাতিক আইনের ছায়াতে ‘আদিবাসী’ হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির দাবি বাংলাদেশে মূলত উঠতে শুরু করে ১৯৯৩ সাল থেকে।
এমনিতে তার আগে কয়েক দশক ধরেই এ দেশে শব্দটি ব্যবহৃত হয়ে আসছিল ‘আদিম’ অর্থে এবং ‘উপজাতি’ শব্দের সঙ্গে কমবেশি সমার্থক হিসেবে।
আগে যত দিন ‘আদিম’ অর্থে ‘আদিবাসী’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে, তা নিয়ে খুব একটা আপত্তি ওঠেনি।
কিন্তু যখন এটিকে নতুন আঙ্গিকে আত্মপরিচয়ের হাতিয়ার করে অধিকারের দাবি তুলতে শুরু করল কিছু প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, তখন অনেকে বলতে শুরু করলেন, ‘উপজাতিরা নয়, বাঙালিরাই বাংলাদেশের প্রকৃত আদিবাসী!’
উল্লেখ্য, বাংলাদেশে বিভিন্ন জনগোষ্ঠী ‘আদিবাসী’ হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতির যে দাবি জানিয়ে আসছে, সেটির মূলে আছে দেশের বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রথাগতভাবে তাদের জীবিকার ভিত্তি হিসেবে ব্যবহৃত ভূমির ওপর তাদের অধিকার সমুন্নত রাখার আকাঙ্ক্ষা।
এ প্রসঙ্গে মনে রাখার বিষয় হলো, যে নামেই সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীদের আমরা অভিহিত করি না কেন, তাদের ভূমি যে নানাভাবে বেহাত হয়ে যাচ্ছে, এই বাস্তবতা সবারই কমবেশি জানা আছে।
যেমন— বণিক বার্তার যে সম্পাদকীয় নিয়ে বর্তমান আলোচনার সূত্রপাত, সেখানেও বলা হয়েছে, ‘সমতলে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী অধ্যুষিত অঞ্চলে বন ধ্বংস বা জমি অধিকার করার ফলে তারা প্রতিনিয়ত জীবন-জীবিকা, আবাসস্থল হারানোর পাশাপাশি বঞ্চনার শিকার হচ্ছে।’
বলা বাহুল্য, এ প্রবণতা মোটেও নতুন নয়, বরং ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলেই তা সূচিত হয়েছিল এবং তখন বিভিন্ন ধাপে সীমিত আকারে হলেও সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীগুলোর জন্য কিছু আইনি ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল, যেগুলো এখনো বহাল রয়েছে।
কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে এসব আইনের যুগোপযোগী নতুন রূপ অনুসন্ধানের বদলে সেগুলোর ফাঁকফোকর ব্যবহার করে অথবা সেগুলোকে পাশ কাটিয়ে নানা কায়দায় প্রত্যন্ত জনপদগুলোয় ভূমি দখলের দিকেই ক্ষমতাসীনদের অনেকের মনোযোগ কেন্দ্রীভূত রয়েছে।
এ পটভূমিতে যাঁরা ‘আদিবাসী’ ধারণার বিরোধিতা করেন, তাঁরা যে জেনেশুনে অথবা কিছু ক্ষেত্রে নিজেদের অজান্তে এ ধরনের ভূমিদস্যুতার পথই প্রশস্ত করছেন না, তা কি হলফ করে বলা যায়?
উল্লেখ্য, যেসব রাজনৈতিক দল বর্তমানে দেশে ক্ষমতায় রয়েছে, তাদের কাছে ‘আদিবাসী’ শব্দটি আগে ঠিক অপাঙেক্তয় ছিল না।
বরং খোদ আওয়ামী লীগের ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে আদিবাসীদের ভূমি সমস্যা সমাধানের অঙ্গীকার করা হয়েছিল।
তাহলে মাঝখানে কী এমন হলো যে, সরকারিভাবে ‘আদিবাসী’ শব্দটিকে নিষিদ্ধ বলে প্রচার করা শুরু হলো?
অনেকে অবশ্য বলতে চান যে, ২০১১ সালে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে সংযোজিত ২৩ক ধারার মাধ্যমে ‘আদিবাসী’ স্বীকৃতির দাবি মেটানো হয়েছে।
কিন্তু সেখানে যেসব শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে — উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃ-গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়, সেগুলোর কোনোটিকে ‘আদিবাসী’ পরিচয়ের দাবিদার জনগোষ্ঠী যথেষ্ট বলে মনে করেননি, বরং অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, ‘উপ’, ‘ক্ষুদ্র’ ইত্যাদি বিশেষণ দিয়ে কারো পরিচয় তুলে ধরা কি তাদেরকে হেয় করা নয়?
তবে সবচেয়ে বড় কথা হলো, ২৩ক ধারার আওতায় মূলত সংকীর্ণ অর্থে ‘আঞ্চলিক সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও বিকাশ’ নিয়ে কথা বলা হয়েছে কিন্তু সেখানে বা সংবিধানের অন্য কোথাও সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীর প্রথাগত ভূমি অধিকার ও ভাষিক স্বাতন্ত্র্যের স্বীকৃতি দেয়া হয়নি।
শেষোক্ত পর্যবেক্ষণের আলোকে দেখলে বলতে হয়, বণিক বার্তার পর্যালোচিত সম্পাদকীয়তে উল্লিখিত একটি বক্তব্য, ‘সংবিধানে সব জাতিসত্তার অধিকারের কথা বলা হয়েছে’, আমাদের অনেকের অভিপ্রায়ের প্রতিফলন হতে পারে কিন্তু এখন পর্যন্ত ঠিক বাস্তব অর্জনের পর্যায়ে পৌঁছায়নি।
পক্ষান্তরে যাঁরা সংবিধানের দোহাই দিয়ে দাবি করেন যে বাংলাদেশের ‘আদিবাসী’ শব্দটি বর্তমানে নিষিদ্ধ, তাঁরা মূলত এ কথাই বলতে চান যে শব্দটি সংবিধানে নেই বা এর সঙ্গে যে ধরনের অধিকারের দাবি জানানো হয়েছে, তা সংবিধানে স্পষ্টভাবে স্বীকৃত হয়নি।
এ যুক্তিতে অবশ্যই ফাঁকি আছে। কারণ সংবিধানে ভবিষ্যতে আর কোনো সংশোধনী আনা যাবে না এমন নয়, আর সেখানে কোনো শব্দের অনুপস্থিতির অর্থ এই নয় যে সেটির ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে।
যাঁরা এমন কথা বলেন, তাঁদের যুক্তি দাঁড়ায় অনেকটা এ রকম যে, ‘প্রতিবন্ধী’ বা ‘গৃহকর্মী’ শব্দগুলো যেহেতু সংবিধানে নেই, সেগুলোকে সাংবিধানিকভাবে নিষিদ্ধ বলে গণ্য করতে হবে!
এ আলোচনা শেষ করব সাংবিধানিকভাবে অনুমোদিত বলে বিবেচিত ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’ পদটিকে ‘আদিবাসী’র বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা কেন সমস্যাজনক, এ বিষয়ে আরো কিছু পর্যবেক্ষণ যোগ করে।
এ প্রসঙ্গে শুরুতেই উল্লেখ্য যে, ‘নৃগোষ্ঠী’ শব্দটি মূলত বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের একটি পারিভাষিক উদ্ভাবন, যা চালু করা হয়েছিল দৈহিক বৈশিষ্ট্যনির্ভর ‘রেইস’ ধারণার প্রতিশব্দ হিসেবে।
কালক্রমে এটি ‘এথনিক গোষ্ঠী’ অর্থেও ব্যবহৃত হতে থাকে, তবে অনেকে শব্দটিকে এমনভাবে ব্যবহার করেন, যাতে ‘রেইস’ ও ‘এথনিক গোষ্ঠী’ ধারণা একাকার হয়ে যায়।
উল্লেখ্য, ‘নৃগোষ্ঠী’ শব্দটির প্রায় সমার্থক আরেকটি পদ হচ্ছে ‘নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী’, যেটির প্রচলিত অর্থও ‘রেইস’ এবং/বা ‘এথনিক গোষ্ঠী’ ধারণার অনুরূপ।
এ প্রসঙ্গে এটাও উল্লেখ্য যে, সংবিধানের ২৩ক ধারার ইংরেজি অনুবাদে ‘মাইনর রেইস’ কথাটি রয়েছে, যার মধ্যে বাংলা ‘ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী’ পদের প্রচলিত অর্থ ফুটে ওঠে।
নৃবিজ্ঞানে দীর্ঘকালের প্রশিক্ষণ, গবেষণা ও শিক্ষকতার সুবাদে আমি এ কথা জোর দিয়ে বলতে পারি যে, রাজনৈতিক ও বৈজ্ঞানিক— উভয় দৃষ্টিকোণ থেকে প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার কারণে ‘রেইস’ ধারণাটি নৃবিজ্ঞানীরা ব্যাপকভাবে পরিত্যাগ করেছিলেন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরেই।
এই পরিত্যক্ত ধারণাকে ‘আদিবাসী’ ধারণার বিপরীতে যাঁরা ব্যবহার করছেন, তাঁরা হয় এ ব্যাপারে খোঁজ রাখেন না অথবা জেনেশুনেই তাঁরা তা করছেন জাত্যাভিমানী দৃষ্টিকোণ থেকে, বাংলাদেশের জনগণের একটি প্রান্তিক অংশের অধিকারের প্রশ্নকে আড়াল করার একটি ঢাল হিসেবে।
এ প্রবণতার বিরুদ্ধে দাঁড়ানো এবং ‘আদিবাসী’ শব্দটিকে মিথ্যা অভিযোগের ফাঁদ থেকে মুক্ত করা একটি সামষ্টিক গণতান্ত্রিক কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে, নয় কি?
আপনার মতামত জানানঃ