সদস্য রাষ্ট্রগুলোর প্রবল মতভেদের মধ্যে জাতিসংঘে এই প্রথমবারের মতো সর্বসম্মতিক্রমে রোহিঙ্গা রেজুলেশন গৃহীত হয়েছে। জানা গেছে, রেজুলেশনটি যৌথভাবে উত্থাপন করে ইসলামিক সহযোগিতা সংস্থা (ওআইসি) ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। গতকাল বুধবার (১৭ নভেম্বর) জাতিসংঘে ‘মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলিমসহ অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানবাধিকার পরিস্থিতি’ শীর্ষক রেজুলেশনটি গৃহীত হয়।
কী আছে রেজুলেশনে?
এবারের প্রস্তাবে ১০৭টি দেশ সহপৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করেছে, যা ২০১৭ সালের পর থেকে এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ। ইইউ, ওআইসি ছাড়াও প্রস্তাবে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, মেক্সিকো, আর্জেন্টিনা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়াসহ বিভিন্ন ভৌগোলিক অঞ্চলের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক দেশ প্রস্তাবে সমর্থন জুগিয়েছে; সহপৃষ্ঠপোষকতা করেছে।
প্রস্তাবে প্রাথমিকভাবে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলিমসহ অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানবাধিকার পরিস্থিতির পাশাপাশি গত ১ ফেব্রুয়ারি দেশটিতে জরুরি অবস্থা জারির প্রেক্ষাপটের মতো বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি দেওয়া হয়েছে।
রেজুলেশন গ্রহণের বিষয়টি বাংলাদেশের জন্য এক বড় অর্জন। কেননা ২০১৭ সালে রোহিঙ্গাদের ওপর চরম নির্যাতন চলার সময়ও তাদের পক্ষে কোনো রেজুলেশন সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়নি।
প্রস্তাব গ্রহণের ঘটনাকে রোহিঙ্গা ‘সঙ্কটের সমাধানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃঢ় প্রতিশ্রুতিরই প্রতিফল’ বলে অভিহিত করেচেন জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত রাবাব ফাতিমা।
বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের আশ্রয় ও মানবিক সহায়তা প্রদান এবং জাতীয় কোভিড টিকাদান কর্মসূচিতে তাদেরকে অন্তর্ভুক্ত করার মাধ্যমে বাংলাদেশ যে উদারতা ও মানবিকতা প্রদর্শন করেছে, তার প্রশংসা করা হয় প্রস্তাবটিতে।
কক্সবাজারের জনাকীর্ণ আশ্রয়শিবির থেকে রোহিঙ্গাদের একটি অংশকে ভাসানচরে স্থানান্তর এবং সে লক্ষ্যে ভাসানচরে অবকাঠামোসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা তৈরির জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রচেষ্টা ও বিনিয়োগেরও স্বীকৃতি দেওয়া হয় রেজুলেশনটিতে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ও জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের মধ্যকার সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরকে স্বাগত জানানো হয়।
রোহিঙ্গা সমস্যার মূল কারণ খুঁজে বের করা, বাংলাদেশের সঙ্গে স্বাক্ষরিত দ্বি-পাক্ষিক চুক্তির বাধ্যবাধকতাগুলো পূরণ করা এবং মিয়ানমারে নিযুক্ত জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ দূতসহ জাতিসংঘের সমস্ত মানবাধিকার ব্যবস্থাপনাকে পূর্ণ সহযোগিতা দিতে এবারের রেজুলেশনে মিয়ানমারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে।
এর পাশাপাশি চলমান বিচার ও দায়বদ্ধতা নিরূপণ প্রক্রিয়ার ওপর সজাগ দৃষ্টি বজায় রাখার কথা বলা হয়েছে প্রস্তাবটিতে। রেজুলেশনটিতে মিয়ানমারে নবনিযুক্ত জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ দূতকে স্বাগত জানানো হয়েছে এবং মিয়ানমারকে সম্পৃক্ত করে তার জন্য একটি কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণের কথাও বলা হয়েছে।
এছাড়া, রাখাইন রাজ্যে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি করার জন্য মিয়ানমার, ইউএনএইচসিআর ও ইউএনডিপির মধ্যে স্বাক্ষরিত ত্রিপাক্ষিক সমঝোতা স্মারকটি নবায়ন ও এর কার্যকর বাস্তবায়ন করার কথা উল্লেখ করা হয়েছে প্রস্তাবটিতে।
রেজুলেশন কতটা গুরুত্বপূর্ণ?
রাষ্ট্রদূত রাবাব ফাতিমা বলেন, ‘বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মানবিক বিবেচনায় ২০১৭ সালে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের জন্য বাংলাদেশের সীমান্ত খুলে দেন। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় এই যে, রোহিঙ্গাদের স্বপ্রণোদিত, নিরাপদ ও টেকসই প্রত্যাবর্তনের উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি করতে মিয়ানমার ব্যর্থ হওয়ায় বাংলাদেশে দীর্ঘমেয়াদী সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে।’
প্রত্যাবাসনের কোনো অগ্রগতি না হওয়ায় রোহিঙ্গাদের হতাশা ক্রমেই তীব্র হয়ার ফলে এ অঞ্চলে নানা ধরনের নিরাপত্তাজনিত উদ্বেগ ও অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে বলে উল্লেখ করেন বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি।
রাবাব ফাতিমা আরও বলেন, ‘আশা করা যায় এবারের রেজুলেশনটি নিজভূমি মিয়ানমারে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া নিশ্চিত করতে বাস্তবভিত্তিক পদক্ষেপ গ্রহণের প্রেরণা হিসেবে কাজ করবে, যা দীর্ঘস্থায়ী এই সমস্যার টেকসই সমাধানে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।’
সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত এবারের রোহিঙ্গা রেজুলেশনের বিষয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করে রাষ্ট্রদূত রাবাব ফাতিমা বলেন, ‘একটি শক্তিশালী ম্যান্ডেট নিয়ে এবারের রেজুলেশন গৃহীত হলো, যা রোহিঙ্গাদের মনে নতুন আশার সঞ্চার করবে, যেজন্য তারা পথ চেয়ে বসে আছে।’
পরিস্থিতি কতটা জটিল?
এর আগে ১৮ নভেম্বর ২০২০ চতুর্থবারের মতো জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের তৃতীয় কমিটিতে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘন সংক্রান্ত ওআইসি ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন যৌথভাবে রেজুলেশনটি উত্থাপন করে, যাতে পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করে ১০৪টি দেশ। রেজুলেশনটির পক্ষে ভোট দেয় ১৩২টি দেশ, বিপক্ষে ভোট দেয় ৯টি। আর ভোট দানে বিরত থাকে ৩১টি দেশ।
বিপক্ষে ভোট দেয়া দেশগুলো হলো: রাশিয়া, চীন, মিয়ানমার, বেলারুশ, কম্বোডিয়া, ফিলিপাইন, ভিয়েতনাম, জিম্বাবুয়ে ও লাওস। ভোট না দেয়া দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে প্রতিবেশী ভারত, সার্কভুক্ত নেপাল, শ্রীলঙ্কা, জাপান, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, ভেনেজুয়েলা ইত্যাদি।
রোহিঙ্গা সংকটের জরুরি সমাধানের লক্ষ্যে জাতিসংঘে এই প্রস্তাব পাশের সময় এই ইস্যুতে বাংলাদেশ কতটা বন্ধুহীন, সেটাই বেরিয়ে এসেছে। এই ভোটাভুটিতে বাংলাদেশ পাশে পায়নি তার কোনো প্রতিবেশী দেশকে। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক নজিরবিহীন উচ্চতায় উন্নীত হয়েছে মর্মে দাবি করে আসছে দুই দেশের সরকার। চীনের সঙ্গেও সম্পর্ক দিন দিন উন্নতির পথে বলা হচ্ছে। অথচ জাতিসংঘে যখন ‘মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলিম ও অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানবাধিকার পরিস্থিতি’ শীর্ষক রেজুলেশনের ওপর ভোট হলো, তখন দেখা গেল ভারত বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ায়নি, আর চীন দাঁড়িয়েছে বিরুদ্ধে।
নেপাল, ভুটান, শ্রীলংকা বাংলাদেশের নিকটতম প্রতিবেশী। দক্ষিণ এশিয়ার একই জলবায়ুতে অবস্থান দেশগুলোর। তবু এই আত্মীয়রাও পাশে দাঁড়ায়নি বাংলাদেশের। প্রতিবেশী হিসেবে বাংলাদেশ নয়, বরং মিয়ানমারকেই বন্ধু হিসেবে বেছে নিয়েছিল। পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোও উদীয়মান অর্থনীতির দেশ হিসেবে বাংলাদেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠার কোন তাগিদ অনুভব করেনি। একযোগে ভোট দিয়েছিল বাংলাদেশের বিপক্ষে।
এদিকে, মিয়ানমার জান্তা প্রধান চীনা ভাষার ফোয়েনিক্স টেলিভিশন চ্যানেলকে দেওয়া তার এক সাক্ষাৎকারে রোহিঙ্গাদের ফেরা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন। গত ১ ফেব্রুয়ারি সামরিক অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতা দখলের পর ওই প্রথম তিনি কোনো গণমাধ্যমকে সাক্ষাৎকার দেন।
সাক্ষাৎকারে তিনি দাবি করেন, বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ মিয়ানমারে রোহিঙ্গারা কোনো ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত নয়। তার ভাষ্যমতে, ১৯৪৮ সালে ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতালাভের পরই রোহিঙ্গাদের উত্থান।
মিন অং হ্লাইং বলেন, ‘আমরা স্বাধীনতা অর্জনের পর আদমশুমারিতে ‘বাঙালি’, ‘পাকিস্তানি’, ‘চট্টগ্রাম’ শব্দ নিবন্ধন করা হয়েছে। কিন্তু রোহিঙ্গা বলতে কোনো শব্দ ছিল না। তাই আমরা এটি কখনো গ্রহণ করিনি।’
উল্লেখ্য, মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ রোহিঙ্গাদের বাঙালি বলে মনে করে। তাদের মতে, মিয়ানমারে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশ থেকে আসা বহিরাগত। যদিও অনেক রোহিঙ্গাই শত বছর ধরে সেখানে বসবাস করছে।
এদিকে, গত ৪ বছরে সাড়ে ৪ গুণ বেড়েছে রোহিঙ্গাদের সংখ্যা। ইউএনএইচসিআরের সর্বশেষ পরিসংখ্যানে দেখা যায়, নতুন করে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পরে বাংলাদেশে ৭ লাখ ৩৩ হাজার ৩৪৩ রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করে। এর আগে ৩৭ হাজার ২১৬ পরিবারের এক লাখ ৫০ হাজার ৬৯৮ রোহিঙ্গার বসতি ছিল। এখন ৮ লাখ ৮৪ হাজার ৪১ রোহিঙ্গার বসতি।
এর মধ্যে শূন্য থেকে ৪ বছরের ৭০ হাজার ৭২৪ জন মেয়েশিশু, ৫ থেকে ১১ বছরের ৬১ হাজার ৮৮৩ জন ছেলেশিশু, ৯৭ হাজার ২৪৪ মেয়ে, ৯২ হাজার ৮২৪ জন ছেলে। এ ছাড়া ১২ থেকে ১৭ বছরের ৫৩ হাজার ৪২ জন মেয়ে এবং ১৮ থেকে ৫৯ বছরের মেয়ের সংখ্যা এক লাখ ৫৯ হাজার ১২৭ জন, ১৭ শতাংশ পুরুষ এক লাখ ৫০ হাজার ২৮৭ জন। ৬০ বছরের বেশি বয়সী নারী ১৭ হাজার ৬৮০ জন, পুরুষ ১৭ হাজার ৬৮০ জন।
এসডব্লিউ/এসএস/১২০১
আপনার মতামত জানানঃ