বাংলাদেশের রাজনীতিতে নির্বাচন বিষয়ে আলোচনা করতে হলে দুটি বিষয় আমাদের মাথায় আসে— একটি হলো উৎসব, অন্যটি সহিংসতা। নির্বাচন নিয়ে অতীত স্মৃতি আমাদের যতটা আনন্দের, তার চেয়ে বেশি ভয়ের। এই ভয় হলো নির্বাচনী সহিংসতা। দেশে নির্বাচনী সহিংসতা যেন স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। আমাদের দেশের বিগত প্রায় সব জাতীয় এবং স্থানীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করলে নির্বাচনী সহিংসতার চিত্র ফুটে ওঠে। এ নির্বাচনী সহিংসতা বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে।
আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) কর্তৃক প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুসারে, গত ১০ মাসে বাংলাদেশে রাজনৈতিক সহিংসতায় ৭৪ জনের প্রাণ গেছে। গত ১১ দিনে ৭ মৃত্যুও এই তালিকায় স্থান পেয়েছে। এর মধ্যে দুজন নিহত হয়েছেন সোমবার, আর পাঁচজন নিহত হয়েছেন আজ। আসকের প্রতিবেদনের পরে আরও দুজনের মৃত্যুর সংবাদ পাওয়া গেছে। অর্থাৎ, আজ মোট প্রাণহানি ঘটেছে ৭ জনের।
স্বনামধন্য জাতীয় দৈনিক থেকে সংগৃহীত তথ্যের বরাত দিয়ে মানবাধিকার সংস্থাটি বলেছে যে, জানুয়ারি থেকে অক্টোবরের মধ্যে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ৩৭৯টি রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনার খবর প্রকাশ হয়েছে। এই ঘটনাগুলোতে মোট ৫ হাজার ২৫৪ জন আহত হয়েছেন।
নিহতদের মধ্যে ৩৪ জন ছিলেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতা ও সমর্থক, ২ জন বিএনপির নেতা-কর্মী এবং একজন সাংবাদিক।
এই সময়ের মধ্যে পুলিশের গুলিতে অন্তত ১৫ জন নিহত হয়েছেন বলে আসকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
এছাড়াও, নিহতদের মধ্যে ২২ জন কোনো ধরনের রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন না।
চলতি বছরের জুনে শুরু হওয়া ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষে ৪০ জন নিহত হয়েছেন বলে জানানো হয়েছে প্রতিবেদনে।
বেশিরভাগ প্রাণসংহারকারী ঘটনার জন্যই আওয়ামী লীগের দলীয় অন্তর্কোন্দলকে দায়ী করা হয়।
গত ২০ জুন প্রথম ধাপের ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। বৃহস্পতিবার সকাল থেকে শুরু হয় দ্বিতীয় ধাপের ভোটগ্রহণ। সকাল ৮টা থেকে শুরু হয়ে বিকেল ৪টা পর্যন্ত ভোট হয়েছে এসব ইউনিয়নে। এসময় নির্বাচনে কেন্দ্র দখল ও আধিপত্য বিস্তার নিয়ে সংঘর্ষে সাতজন নিহত হয়েছেন।
ভোট চলাকালে নরসিংদীতে সংঘর্ষে প্রাণ গেছে তিনজনের। আর কুমিল্লায় ২ জন, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে নিহত হয়েছেন দুইজন।
বৃহস্পতিবার সকাল ৮টা থেকে দেশের ৮৩৫টি ইউনিয়নে ভোটগ্রহণ শুরু হয়। ভোট চলাকালীন ভোটকেন্দ্রে ঢুকে জোর করে ব্যালট পেপারে সিল মারা, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর এজেন্টদের বের করে দেয়াসহ ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে।
নরসিংদীর রায়পুরার প্রত্যন্ত চরাঞ্চল বাঁশগাড়িতে ভোটকেন্দ্র দখল নিয়ে আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে ৩ জন নিহত হয়েছেন। বৃহস্পতিবার ভোরে রায়পুরার বাঁশগাড়ি ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এ ঘটনা ঘটে।
গত ২০ জুন প্রথম ধাপের ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। বৃহস্পতিবার সকাল থেকে শুরু হয় দ্বিতীয় ধাপের ভোটগ্রহণ। সকাল ৮টা থেকে শুরু হয়ে বিকেল ৪টা পর্যন্ত ভোট হয়েছে এসব ইউনিয়নে। এসময় নির্বাচনে কেন্দ্র দখল ও আধিপত্য বিস্তার নিয়ে সংঘর্ষে সাতজন নিহত হয়েছেন।
কুমিল্লার মেঘনায় ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে ভোটকেন্দ্রে বহিরাগতদের হামলায় শাওন আহমেদ (২৫) ও সানা উল্লাহ নামের দুজন নিহত হয়েছেন। এ সময় গুলিবিদ্ধসহ আহত হয়েছেন আরো প্রায় ৩০ জন।
চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির ১৩ নম্বর লেলাং ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের এম আর সি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রে দুই মেম্বার প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে ১ জন নিহত হয়েছেন।
কক্সবাজারের সদর উপজেলার খুরুশখুল ইউনিয়নে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আক্তারুজ্জামান পুতু (৪৫)। নামের এক যুবক নিহত হয়েছেন। এ ঘটনায় আরো চারজন গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন বলে জানা গেছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, পরিস্থিতি সামাল দিতে নির্বাচন কমিশন ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। সহিংসতা দূর করতে নির্বাচন কমিশন কঠোর হচ্ছে না কেন? নির্বাচনের সময় যেহেতু স্থানীয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনা মেনে চলে তাই এই পরিস্থিতির দায় নির্বাচন কমিশনকে নিতে হবে। নির্বাচন কমিশন একটি স্বাধীন ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য এই প্রতিষ্ঠানকে অগাধ ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। এই ক্ষমতা প্রয়োগের বিষয়টি নির্ভর করে নির্বাচন কমিশনের দৃঢ়তার ওপর। দেশে শান্তিশৃঙ্খলা, স্থিতিশীলতা এবং দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল রাখার জন্য আমাদের নির্বাচনী সহিংসতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। এ জন্য নির্বাচনী সহিংসতায় জড়িত ব্যক্তি এবং তাদের পৃষ্ঠপোষকদের কঠিন শাস্তির আওতায় আনতে হবে।
দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে তারা বলেন, ‘আদর্শিক রাজনীতি এক জিনিস। যেমন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কিংবা গণতন্ত্রের জন্য রাজনীতি হচ্ছে আদর্শের রাজনীতি। সেই বিষয়টি আলাদা। কিন্তু রাজনীতির উদ্দেশ্য যদি হয় জমি দখল, ঠিকাদারি, চাঁদাবাজি, তাহলে সেটা রাজনীতি হবে না। সেটা হবে রাজনৈতিক ছদ্মবেশে দুর্বৃত্ত্বায়ন। আমাদের দেশে এখন রাজনৈতিক ছদ্মবেশে দুর্বৃত্ত্বায়ন হচ্ছে। আমরা প্রত্যাশা করি, রাজনীতি হবে নীতির জন্য ও আদর্শের জন্য। রাজনীতি যদি হানাহানির জন্য হয় সেই রাজনীতি প্রত্যাশিত নয়।’
তারা বলেন, আধিপত্য বিস্তার, প্রভাব বিস্তার ও ক্ষমতা নিরঙ্কুশ করার চেষ্টা ও আদর্শবর্জিত রাজনীতির চর্চার কারণেই অভ্যন্তরীণ সংঘাত বেড়ে যাচ্ছে। নিজ রাজনৈতিক দলের ভেতরে এ প্রতিযোগিতা চলবে। যেহেতু রাজনীতিটা আদর্শবিহীন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে জবাবদিহিতা নাই, স্বচ্ছতা নাই। রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রেও এগুলো নাই। এ কারণেই সংঘাত অনিবার্য হয়ে উঠছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯২২
আপনার মতামত জানানঃ