বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার কারণে শুরু হয় পরিবহন ধর্মঘট। হঠাৎ ডাকা এই ধর্মঘটে মুখ থুবড়ে পড়ে সাধারণ মানুষের জীবন। ভর্তি পরীক্ষার এই সময়টাতে পরিবহন শ্রমিকদের এমন সিদ্ধান্তে বেকায়দায় পড়ে অসংখ্য শিক্ষার্থীরাও।
অফিসগামী মানুষের ভোগান্তি ছাড়িয়েছে চরম সীমা। কয়েকগুণ বেশি ভাড়া হাঁকিয়ে নেয়া এক শ্রেণীর সুযোগসন্ধানী চালকদের হাতে একপ্রকার গত তিনদিন ধরে জিম্মি হয়ে আছে গোটা দেশের মানুষ
এরপর আজ মালিকদের দাবির মুখে গণপরিবহনে নতুন করে ভাড়া সমন্বয়ের প্রস্তাব করা হয়েছে। যেখানে বাসভাড়া গড়ে ৪০ শতাংশের বেশি বাড়ানোর প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। তবে পরিবহন মালিকরা বাস বাড়ার যে নতুন প্রস্তাব দিয়েছেন তা বাস্তবায়ন হলে প্রতি ৫ কিলোমিটারে ভাড়বে ২ টাকা ৯০ পয়সা। অর্থাৎ ডিজেলের দাম ২৩ শতাংশ বাড়লেও বাস ভাড়া বাড়বে ৪০ শতাংশ।
এখানেও ভুক্তভোগী সাধারণ মানুষ। বাড়ছে না আয়। এমনিতেই নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের আকাশছোঁয়া দামে হাহাকার মধ্যবিত্তদের জীবনে। আর নিম্নবিত্তরা বহুদিন থেকে সমাজের বাইরেই আছে যেন। তাদের নিয়ে কোনও পরিকল্পনা আদৌ এই উন্নয়নের গান গেয়ে বেড়ানো সরকারের আছে কিনা, তা নিয়েই সন্দেহ বিশিষ্টজনের।
প্রসঙ্গত, আজ রবিবার (৭ নভেম্বর) দুপুরে রাজধানীর বনানীতে বিআরটিএ কার্যালয়ে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর প্রেক্ষাপটে গণপরিবহনে ভাড়া পুনর্নির্ধারণে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) সঙ্গে পরিবহন মালিক সমিতির নেতাদের বৈঠক থেকে এ প্রস্তাব দেওয়া হয়।
যে হারে বাড়ছে বাস ভাড়া
প্রসঙ্গত, সবশেষ ২০১৫ সালে নগর পরিবহনে বাসের ভাড়া প্রতি কিলেমিটারে ১ টাকা ৭০ পয়সা এবং মিনিবাসের জন্য ১ টাকা ৬০ পয়সা নির্ধারণ করে দেয় সরকার। আর ২০১৬ সালে দূরপাল্লায় ডিজেলচালিত বাস ও মিনিবাসের ভাড়া নির্ধারণ করা হয় ১ টাকা ৪২ পয়সা।
নতুন প্রস্তাবে বলা হয়েছে, দূরপাল্লার বর্তমান বাসভাড়া প্রতি কিলোমিটারে ১ টাকা ৪২ পয়সা, তা বাড়িয়ে ২ টাকা করার প্রস্তাব হয়েছে। অর্থাৎ এতে কিলোমিটার প্রতি যাত্রীকে বাড়তি ৫৮ পয়সা গুনতে হবে। ভাড়া বৃদ্ধির এ হার ৪০.৮৫ শতাংশ। এ কারণে দূরপাল্লার একজন যাত্রীকে প্রতি পাঁচ কিলোমিটারে ২ টাকা ৯০ পয়সা বেশি ভাড়া দিতে হবে।
আর মহানগরে বাসের বর্তমান ভাড়া কিলোমিটারে ১.৭০ পয়সা, প্রস্তাব হয়েছে ২.৪০ পয়সা করার। এতে ৭০ পয়সা ভাড়া বাড়বে। বাড়তি ভাড়ার এ শতকরা হার ৪১.১৮ শতাংশ। যআর ফলে মহানগর এলাকায় একজন বাসযাত্রীকে পাঁচ কিলোমিটার ভ্রমণের জন্য বাড়তি ৩ টাকা ৫০ পয়সা গুনতে হবে।
এছাড়া মহানগরে মিনিবাসের বর্তমান ভাড়া প্রতি কিলোমিটারে ১.৬০ পয়সা। এটি বাড়িয়ে ২.৪০ পয়সা করার প্রস্তাব হয়েছে। এতে ভাড়া বাড়ে কিলোমিটারপ্রতি ৮০ পয়সা। ভাড়া বৃদ্ধির এ হার ৫০ শতাংশ। এর ফলে মহানগর এলাকায় চলাচলকারী মিনিবাসের ভাড়া পাঁচ কিলোমিটারে ৪ টাকা বাড়বে।
প্রসঙ্গত, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম ঊর্ধ্বগতির কারণে ভারতসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও ডিজেল-কেরোসিনের দাম পুনর্নির্ধারণ করে সরকার।
গত ৩ নভেম্বর রাতে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটারে ১৫ টাকা বাড়ানোর ঘোষণা দেয়া হয়। নতুন দাম ভোক্তা পর্যায়ে ৬৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৮০ টাকা করা হয়েছে। যা বৃহস্পতিবার থেকে কার্যকর হয়।
ডিজেল-কেরোসিনের দাম বাড়ানোর বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পরদিনই পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা এ নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেন। এরপর ৫ নভেম্বর সকাল ছয়টা থেকে রাজধানীসহ সারাদেশে অনির্দিষ্টকালের পরিবহন ধর্মঘট শুরু করে বাস, ট্রাকসহ পণ্যবাহী যানবাহনের মালিকেরা।
সূত্র মতে, পরিবহন মালিকরা শুরু থেকেই হয় ভাড়া সমন্বয় অথবা ডিজেলের দাম কমানোর দাবি জানাচ্ছিলেন। এরই মধ্যে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম বাড়ানোর কারণে গণপরিবহনের ভাড়া পুনর্নির্ধারণের বিষয়ে গত বৃহস্পতিবার (৪ নভেম্বর) বিআরটিএকে চিঠি দেয় বাংলদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি।
পরিবহনে ভাড়া নৈরাজ্য
বাস কোম্পানিগুলো এবং পরিবহন শ্রমিকদের স্বেচ্ছাচারী লোক ঠকানো আচরণের জন্য রাজধানীর সিটিং বাস সার্ভিসগুলোর ওপর অত্যন্ত বিরক্ত সাধারণ মানুষ। রাজধানী ঢাকা শহরে সিটিং বাস সার্ভিসের নামে গণপরিবহন মালিকদের ভাড়া নৈরাজ্য থামছেই না। সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে উদাসীন বলে মনে করেন রাজধানীর প্রাত্যহিক গণ-পরিবহন ব্যবহারকারীরা।
শ্যামলী থেকে শাহবাগ, এই যাত্রাপথের দূরুত্ব ৬.৪ কিলোমিটার। সরকার নির্ধারিত হারে এই পথটুকুর জন্য তার ভাড়া দেওয়ার কথা ১০ টাকা ৮৮ পয়সা। কিন্তু দিশারী পরিবহনে তার কাছ থেকে রাখা হয় ২০ টাকা, যা প্রায় দ্বিগুণ। এছাড়া সরকার নির্ধারিত সর্বনিম্ন ভাড়া ৭ টাকা হলেও বেশিরভাগ বাসেই সর্বনিম্ন ভাড়া কমপক্ষে ১০ টাকা নিতে দেখা যায়।
বিএএফ শাহীন কলেজ বাসস্ট্যান্ড থেকে আগারগাঁও আইডিবি পর্যন্ত ৪.৫ কিলোমিটার রাস্তা। সরকার নির্ধারিত ভাড়া দাঁড়ায় ৭ টাকা ৬৫ পয়সা। কিন্তু ওই রুটে চলাচলকারী বৈশাখী, ভুঁইয়া ও আলিফ পরিবহন ওই পথটুকুর জন্য ভাড়া আদায় করে ২০ টাকা। যা সরকার নির্ধারিত ভাড়ার দ্বিগুণেরও বেশি। যেসব বাস এই বাড়তি ভাড়া আদায় করছে সেগুলোর মানও কিন্তু লোকাল বাসের থেকে খুব একটা উন্নত না।
শাহীন কলেজ বাসস্ট্যান্ড থেকে কলাবাগানের দূরত্ব ৪.৬ কিলোমিটার। সরকার নির্ধারিত হারে ভাড়া হওয়ার কথা ৭ টাকা ৬৩ পয়সা। তবে এই রুটে চলাচলকারী বিকাশ পরিবহন ওই পথটুকুর জন্য ভাড়া আদায় করে ২৫ টাকা। ফার্মগেট থেকে আসাদগেটের দূরত্ব ১.৯ কিলোমিটার। সরকার নির্ধারিত ভাড়া হওয়ার কথা ৩ টাকা ২৩ পয়সা। তবে লাব্বাইক ও আয়াত পরিবহনের যাত্রীদের গুনতে হচ্ছে ১০ থেকে ১৫ টাকা।
মোহাম্মদপুর থেকে সায়েন্সল্যাবের দূরত্ব ৫.২ কিলোমিটার, যার সরকার নির্ধারিত ভাড়া হওয়ার কথা ৬ টাকা ৯০ পয়সা। কিন্তু এই রুটে রজনীগন্ধা, সিটি লিংক, মিডলাইন ও মালঞ্চ পরিবহনের যাত্রীদের ভাড়া গুনতে হয় ১০ টাকা। যাত্রাবাড়ী থেকে শাহবাগের দূরত্ব ৬.৮ কিলোমিটার। সরকার নির্ধারিত ভাড়া হওয়ার কথা ১১ টাকা ৫৬ পয়সা। তবে এই রুটে চলাচলকারী যাত্রীদের কাছ থেকে ২০ টাকা ভাড়া আদায় করছে ট্রান্স সিলভা পরিবহন, যা ৮ টাকা ২৪ পয়সা বেশি।
গাবতলী থেকে ফার্মগেটের দূরত্ব ৬.১ কিলোমিটার। সরকার নির্ধারিত ভাড়া হওয়ার কথা ১০ টাকা ৩৭ পয়সা। কিন্তু এই রুটে চলাচলকারী লাব্বাইক ও আয়াত পরিবহনে যাত্রীদের কাছ থেকে ভাড়া নেওয়া হয় পরিবহনভেদে সর্বনিম্ন ১৫ টাকা, যা ৪ টাকা ৬৩ পয়সা বেশি।
এক গবেষণায় দেখা গেছে, নগরীতে চলাচলরত ৯৬ শতাংশ বাস, মিনিবাস ভাড়া নৈরাজ্যের সঙ্গে জড়িত। তাতে বলা হয়েছে, সিটিং সার্ভিস নামে কোনো কিছু সড়ক পরিবহন নীতিমালা বা বিধিমালার কোথাও কিন্তু নেই। যে বিদ্যমান ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে সেটাই কিন্তু সিটিং সার্ভিস। আবার সিটিংয়ের কথা বলে বাড়তি ভাড়া আদায়ের কোনো সুযোগ নেই।
সংশ্লিষ্টদের মতে, সরকার অতিরিক্ত ভাড়া আদায় না করার নির্দেশ দিয়েই ঘরে বসে রয়েছে। তাদের নির্দেশ পালিত হচ্ছে কিনা দেখার প্রয়োজন বোধ করছে না। এই সরকার ৬০ ভাগ ভাড়া বৃদ্ধির সময় কারো সঙ্গে কথা না বলেই ঘোষণা দিয়েছিল; এখন সে দায় যাত্রীদের বহন করতে হচ্ছে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৭২০
আপনার মতামত জানানঃ