সরকার দেশের গণপরিবহন নেটওয়ার্কের মধ্যে একটি স্মার্ট টিকেট ব্যবস্থা চালুর উদ্যোগ নিয়েছে। এ স্মার্ট টিকেট কার্ড দিয়ে ইউটিলিটি বিল, সড়ক ও সেতুর টোল, সুপার মার্কেটের কেনাকাটা থেকে শুরু করে শিক্ষার্থীদের বেতন পরিশোধ করা যাবে। প্রাথমিক পর্যায়ে একক এই পেমেন্ট ব্যবস্থার সুবিধা শুধু ঢাকার বাসিন্দারা নিতে পারবেন। তবে পর্যায়ক্রমে সারাদেশে এ সুবিধা চালু হবে।
বহুমুখী এই কার্ডের নাম হলো ‘র্যাপিড পাস’। এটি দিয়ে বিভিন্ন ধরনের সরকারি পরিষেবার বিলও পরিশোধ করা যাবে। গ্রাহকরা তাদের ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ড এবং মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস) অ্যাকাউন্ট থেকে কার্ডটি রিচার্জ করতে পারবেন।
সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক সচিব এবং সরকারের পরিবহন সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের এক বৈঠকে র্যাপিড পাসকে সর্ব-অন্তর্ভুক্তিমূলক স্মার্ট কার্ডে রূপান্তরের সিদ্ধান্ত হয়েছে। এই পাসের মাধ্যমে যাত্রীরা নির্বিঘ্নে সারাদেশে ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট (এমআরটি), বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি), বিআরটিসি বাস, সরকারি ও বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত সব বাস, নৌপরিবহন এবং ট্রেনসহ বিদ্যমান পরিবহন পরিষেবার সব ধরনের ভাড়া পরিশোধ করতে পারবেন।
র্যাপিড পাস হলো একটি স্মার্ট কার্ডের মাধ্যমে ভাড়া পরিশোধের ব্যবস্থা; বর্তমানে যা ঢাকা মেট্রোরেলের যাত্রীরা ব্যবহার করছেন। এ বছরের অক্টোবর থেকে বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) এবং বিআরটিসি বাসের জন্যেও র্যাপিড পাস চালু করা হবে।
এ বিষয়ে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এ বি এম আমিন উল্লাহ নূরী ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘মেট্রোরেল ও বিআরটিতে এই র্যাপিড পাস পাইলটিং করা হয়েছে। এখন বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন করপোরেশন (বিআইডব্লিউটিসি), রেলওয়েসহ অন্যান্য খাতে চালু করা হবে।’
চালুর মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে ক্যাশলেস (নগদ টাকাহীন) লেনদেনের সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে জনসাধারণের সময় বাঁচানো। পাশাপাশি ঝঞ্ঝাটমুক্ত ভ্রমণ নিশ্চিত করা। এছাড়া গণপরিবহনে স্বচ্ছতা ও শৃঙ্খলা নিশ্চিত করার মাধ্যমে সরকারের রাজস্ব সংগ্রহ বাড়ানোও এর লক্ষ্য। এজন্য সব সংস্থাকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
পাশাপাশি বেসরকারি পরিবহনকেও এতে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। এজন্য সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা করা হচ্ছে বলেও জানান আমিন উল্লাহ নূরী।
ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) এসব কার্যক্রমের সমন্বয় করবে। প্রাথমিকভাবে ডিটিসিএ’র ক্লিয়ারিং ব্যাংক ডাচ বাংলা ব্যাংকের নির্দিষ্ট কিছু শাখায় কার্ড গ্রহীতার নাম ও মোবাইল নম্বরসহ ৪০০ টাকা জমা দিয়ে নিবন্ধনের মাধ্যমে র্যাপিড পাস সংগ্রহ করা যাবে। পরবর্তীতে তা সব শাখা থেকেই করা যাবে। এ বছরের জুলাই পর্যন্ত ঢাকায় ৬৬ হাজার ১৮০ জন এই কার্ড নিয়েছেন। প্রতি মাসে এই কার্ডের গ্রাহক বাড়ছে ২০ শতাংশ হারে।
সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় বলছে, এই স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা পরিবহনের ভাড়া আদায় নিশ্চিত করবে। একইসঙ্গে যাত্রা শুরু ও গন্তব্যের (অরিজিনেশন-ডেস্টিনেশন বা ওডি) ডেটা তৈরি করবে, যা ব্যবহার করে বাস্তবসম্মত কৌশলগত নগর পরিবহন পরিকল্পনা করা সম্ভব হবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, সরকার মনে করছে, স্মার্ট বাংলাদেশের অন্যতম অনুষঙ্গ হচ্ছে স্মার্ট পরিবহন ব্যবস্থা। যে কারণে এ ধরনের একটি কার্ড প্রচলনের জন্য স্মার্ট বাংলাদেশ টাস্কফোর্স সংক্রান্ত নির্বাহী কমিটির দ্বিতীয় সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছে। তার পরিপ্রেক্ষিতে এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, কয়েক বছর আগে থেকেই র্যাপিড পাস উদ্যোগ চলমান রয়েছে। এজন্য ডিটিসিএ পরিচালিত একটি প্রকল্পের আওতায় ট্রান্সপোর্ট ক্লিয়ারিং হাউজ স্থাপন করা হয়। এই প্রকল্পের লক্ষ্য একটি স্বয়ংক্রিয় ভাড়া আদায় ব্যবস্থা চালু এবং তার সঙ্গে ভাড়া আদায় ব্যবস্থার সমন্বয়। এ প্রকল্পের আওতায় বিআরটিসি, এইচআর ট্রান্সপোর্ট, ঢাকা চাকা ও ওমামা বাস সার্ভিসে পাইলটিং হিসেবে র্যাপিড পাসের মাধ্যমে ভাড়া আদায় ও নিষ্পত্তি করা হয়েছে।
এস্টাবলিশমেন্ট অব ক্লিয়ারিং হাউজ ফর ইন্টিগ্রেটিং টিকেটিং সিস্টেম ইন ঢাকা সিটি অ্যান্ড অ্যাডজাসেন্ট ডিস্ট্রিক্টস শীর্ষক এই প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়ের বাস্তবায়ন বর্তমানে ডিটিসিএ’র মাধ্যমে করা হচ্ছে। আগামী বছরের জুনের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। দ্বিতীয় পর্যায়ের ব্যয় প্রায় ৮৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকার অবকাঠামো ও নেটওয়ার্কের জন্য দিচ্ছে ৫৪ কোটি টাকা এবং জাইকা দিচ্ছে ২৯ কোটি টাকা যা পরামর্শক ফি হিসেবে ব্যবহার করা হবে।
ইতোমধ্যে ক্লিয়ারিং হাউজ সিস্টেমের সঙ্গে প্রথম গণপরিবহন অপারেটর (পিটিও) হিসেবে মেট্রোরেল লাইন-৬ এর অন্তর্ভুক্তি শেষ হয়েছে। র্যাপিড পাসের মাধ্যমে মেট্রোরেল লাইন-৬ এর ভাড়া আদায় ও নিষ্পত্তি করা হচ্ছে।
ক্লিয়ারিং হাউজ (দ্বিতীয় পর্যায়) প্রকল্পের পরিচালক মামুনুর রহমান বলেন, ‘এই প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ের ফেইজের মাধ্যমে ক্লিয়ারিং হাউজ স্থাপন করা হয়েছে। ক্লিয়ারিং ব্যাংক হিসেবে ডাচ-বাংলা ব্যাংককে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এখন দ্বিতীয় পর্যায় চলছে।’
আপাতত ডাচ-বাংলা ব্যাংকের শাখা ও ডিটিসিএ অফিস থেকে গ্রাহকরা এই কার্ড সংগ্রহ করতে পারবেন। প্রকল্প পরিচালক জানান, চেষ্টা রয়েছে জনসাধারণ যাতে খুব সহজে এই কার্ড সংগ্রহ করতে পারেন। সেজন্য রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকসহ সব ব্যাংক থেকে এই কার্ড যাতে ইস্যু করা যায়, সেজন্য কাজ চলছে।
বাস, ট্রেন, লঞ্চের কাউন্টারে এই কার্ড পাঞ্চ (টাচ বা ট্যাপ) করার ব্যবস্থা থাকবে। পাশাপাশি পরিবহনগুলোতে বিশেষ ডিভাইস থাকবে, যেখানে যাত্রী গন্তব্য উল্লেখ করে নিজের ভাড়া নিজেই পরিশোধ করে রসিদ নিতে পারবেন।
এই কার্ড পরিবহনে ওঠা ও নামা উভয় সময়ই ব্যবহার করতে হবে। নাহলে পরবর্তী যাত্রায় কার্ড ব্যবহার করা যাবে না। কার্ড থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে কেটে নেওয়া টাকা জমা হবে ক্লিয়ারিং হাউজে। সেখান থেকে সপ্তাহ শেষে কোনো পরিবহনের মাধ্যমে কত টাকা জমা হয়েছে তা হিসাব করে সংশ্লিষ্ট পরিবহনের মালিক বা কর্তৃপক্ষকে দেওয়া হবে বলে জানান প্রকল্প পরিচালক মামুনুর রহমান।
এই ক্লিয়ারিং হাউজে বাস সার্ভিসের জন্য সর্বোচ্চ ১ হাজার বাস ভ্যালিডেটরের ব্যবস্থা করা হবে। এসব ডিভাইসের মূল্য প্রাক্কলন করা হয়েছে সর্বোচ্চ ১ হাজার ৩০০ ডলার। ক্লিয়ারিং হাউজের মাধ্যমে ভাড়া নিষ্পত্তি ও বিতরণ করা হবে। এজন্য সরকারি গণপরিবহন পরিচালনাকারী সংস্থাগুলোকে (বাংলাদেশ রেলওয়ে, আরডিএইচ, বিআরটিসি, বিবিএ ও ডিএমপি)-কে ক্লিয়ারিং হাউজ ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত হতে হবে।
সড়ক বিভাগ মনে করছে, উত্তরা থেকে কমলাপুর পর্যন্ত মেট্রোরেল চালু হলে আগামী ডিসেম্বর নাগাদ প্রতিদিন ৪ লাখ ৮৩ হাজার মানুষ আধুনিক এই পরিবহনে যাতায়াত করবে। গত জুনে গড়ে প্রতিদিন ৭৭ হাজার মানুষ মেট্রোরেলে যাতায়াত করেছে।
আপনার মতামত জানানঃ