‘এক দল, এক নেত্রী’র রাজনীতিতে নিজের কাছেই নিজে হেরে যাচ্ছে আওয়ামী লীগ। দলীয় বিবাদ, হানাহানি আর দোষারোপের সংস্কৃতিতে যুক্ত হলো বিদ্রোহীরা। চলমান ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থীর সংখ্যা দলটির মনোনীত প্রার্থীর সংখ্যা ছাড়িয়ে গেছে।
বিদ্রোহী প্রার্থী ঠেকাতে আওয়ামী লীগের নানা উদ্যোগ কোনো কাজে আসছে না। প্রথম দুই ধাপে শতাধিক দলীয় পদধারীকে বহিস্কারের পরও তৃতীয় ধাপে মনোনীত প্রার্থীর তুলনায় বিদ্রোহীর সংখ্যা বেশি দেখা যাচ্ছে।
আ’লীগ নিজেই নিজের প্রতিপক্ষ
সূত্র মতে, তৃতীয় ধাপের নির্বাচনে এক হাজার তিনটি চেয়ারম্যান পদের ৯৮১টিতে আওয়ামী লীগ মনোনীতরা মনোনয়নপত্র দাখিল করেছেন। আর দলটির ‘বিদ্রোহী’ হিসেবে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন ৯৯৯ জন। অর্থাৎ মনোনীতদের থেকে বিদ্রোহীদের সংখ্যা বেশি। যা কিনা দলটির মধ্যকার অস্থিতিশীলতাকে সবার সামনে নিয়ে এসেছে।
বিদ্রোহ ঠেকাতে সর্বশেষ উদ্যোগ হিসেবে দলের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের গত মঙ্গলবার দলের তৃণমূল নেতাদের কাছে চিঠি পাঠিয়েছেন। প্রতিটি সাংগঠনিক জেলা, মহানগর, উপজেলা ও থানার সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক, আহ্বায়ক এবং যুগ্ম আহ্বায়কদের কাছে জরুরি ভিত্তিতে এই চিঠি পাঠানো হয়েছে। ওই চিঠিতে সংশ্নিষ্টদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণের বার্তাও দেওয়া হয়েছে। তবে কাজের কাজ কতটা হলো, তা বেশ অনুমেয়। উন্নয়নের তলে ভেঙে যাচ্ছে আওয়ামী লীগের ঐক্য।
এদিকে, নির্বাচন কমিশন কার্যালয় সূত্র জানিয়েছে, তৃতীয় ধাপের এক হাজার তিনটি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ৫৩ হাজার ৮০১ জন মনোনয়নপত্র দাখিল করেছেন। তাদের মধ্যে চেয়ারম্যান পদে ৫ হাজার ২৮৫ জন, সংরক্ষিত সদস্য পদে ১১ হাজার ৪৬৯ জন এবং সাধারণ সদস্য পদে ৩৭ হাজার ৪৭ জন রয়েছেন।
তৃতীয় ধাপে ৯৮১টি ইউনিয়ন পরিষদে আওয়ামী লীগ মনোনীতরা মনোনয়নপত্র দাখিল করেছেন। বাকি ২২টিতে দলটির প্রতীকের কোনো প্রার্থী নেই। এ ধাপে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টিসহ ২০টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরা অংশ নিয়েছেন।
ঘনিয়ে এসেছে একদলীয় রাজনীতির দিন
গত ২ নভেম্বর এ ধাপের নির্বাচনে মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ দিন ছিল। আগামী ২৮ নভেম্বর এসব ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। তৃতীয় ধাপে পাঁচ হাজার ২৮৫ জন চেয়ারম্যান প্রার্থীর মধ্যে তিন হাজার ৫৩৮ জনই স্বতন্ত্র প্রার্থী।
ইসি সূত্র জানায়, নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ১৮৭টি ইউনিয়ন পরিষদে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন জাতীয় পার্টির প্রার্থীরা। এ ছাড়া ৪৩৮টিতে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, জাকের পার্টি ৬৪টিতে, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল ২৫টিতে এবং জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম ১০টি ইউনিয়ন পরিষদে প্রার্থী দিয়েছে।
বাকি দলগুলোর প্রার্থী সংখ্যা ১০ জনের কম। এ ছাড়া সংরক্ষিত সদস্য পদে ১১ হাজার ৪৬৯ জন এবং সাধারণ সদস্য পদে ৩৭ হাজার ৪৭ জন মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন।
ইসি ঘোষিত তপশিল অনুযায়ী, জমা হওয়া মনোনয়নপত্র বৃহস্পতিবার যাচাই-বাছাই করছেন সংশ্নিষ্ট রিটার্নিং কর্মকর্তারা। বাছাইয়ে বাতিল বা বৈধ হওয়া মনোনয়নপত্রের বিরুদ্ধে আপিল দায়েরের শেষ তারিখ আগামী ৭ নভেম্বর। আপিল নিষ্পত্তির শেষ সময় আগামী ১০ নভেম্বর।
প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ দিন আগামী ১১ নভেম্বর। আগামী ১২ নভেম্বর চূড়ান্ত প্রার্থীদের মধ্যে প্রতীক বরাদ্দ দেওয়া হবে। ওই দিন থেকেই শুরু হবে আনুষ্ঠানিক প্রচার। বিদ্রোহীরা প্রার্থিতা থেকে সরে দাঁড়াতে চাইলে ১১ নভেম্বরের আগেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
বিএনপির নতুন কৌশল
বিএনপি কেন্দ্রীয়ভাবে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিলেও দলটির নেতাকর্মীরা প্রার্থী হচ্ছেন স্বতন্ত্র পরিচয়ে। তৃতীয় ধাপে এক হাজার তিনটি চেয়াম্যান পদে স্থানীয় বিএনপির পদধারী প্রার্থী রয়েছেন ৪০৩ জন। তারা দলীয় প্রতীক ছাড়াই ভোটে অংশ নিচ্ছেন।
এদিকে বিএনপির পক্ষ থেকে একাধিকবার বর্তমান সরকার ও এই নির্বাচন কমিশনের অধীনে আর কোনো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না বলে ঘোষণা দেওয়া হয়। ঢাকা-১৮ উপনির্বাচনের পর থেকে তারা এই ঘোষণা দিয়ে আসছে।
কিন্তু এবারের ইউপি নির্বাচনে দলের পক্ষ থেকে কৌশলী অবস্থান নিতে দেখা যাচ্ছে। এরই অংশ হিসেবে কেন্দ্র থেকে ভোট বর্জনের ঘোষণা দেওয়া হলেও কেউ নির্বাচনে অংশ নিলে তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।
কেন্দ্রের এমন সিদ্ধান্ত জানার পর বিএনপির স্থানীয় নেতাদের নির্বাচনের প্রতি আগ্রহ বেড়েছে। এর প্রতিফলন দেখা গেছে তৃতীয় ধাপের মনোনয়নপত্র দাখিলে। প্রায় অর্ধেক ইউপির চেয়ারম্যান পদে স্থানীয় বিএনপির পদধারীরা প্রার্থী হয়েছেন।
বিএনপি সূত্র জানায়, প্রথম ধাপের ইউপি নির্বাচনেও অনেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ভোটের মাঠে ছিলেন। কেউ কেউ জয়লাভও করেছেন। দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনেও একই চিত্র দেখা গেছে। যেসব ইউপিতে আওয়ামী লীগের একক প্রার্থী সেখানে বিএনপির তৎপরতা কিছুটা কম। তবে যেখানে ক্ষমতাসীনদের বিদ্রোহী প্রার্থী রয়েছে সে সব ইউপিতে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মাঠে বেশি সক্রিয়।
সংঘাত-সংঘর্ষের নির্বাচন
দেশজুড়ে ইউপি নির্বাচনের পর থেকেই সংঘাত-সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেই চলছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) এক হিসাবে দেখা গেছে, এ বছরে ইউপি ভোটকে কেন্দ্র করে ২১০টি সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এতে মারা গেছেন ৪০ জন এবং আহত হয়েছেন দুই হাজার ৫৪৩ জন।
এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নির্বাচন কমিশন বিব্রত বলে ইতোমধ্যে প্রকাশ্যে মন্তব্য করেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদা।
সংশ্নিষ্টরা মনে করছেন, এই রক্তক্ষয়ের অন্যতম প্রধান কারণ ক্ষমতাসীন দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল। মনোনয়নবঞ্চিতদের বিদ্রোহী প্রার্থী হওয়াকে কেন্দ্র করেই সংঘাতের সূত্রপাত ঘটছে।
ইউপি নির্বাচন ছাড়াও চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত সারা দেশে আধিপত্য বিস্তার ও কমিটি গঠনকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষে জড়িয়েছে ৬৭ বার। এতে আহত হয়েছেন প্রায় ৫০০ জন। নিহত হন ৮ জন।
এর বাইরেও আওয়ামী লীগের সঙ্গে তার সহযোগী সংগঠনগুলোরও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাব অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে ৩২১টি। এতে নিহত হয়েছেন ৬৪ জন। আহত হয়েছেন ৪৪০৫ জন। অধিকাংশ সহিংসতাই আওয়ামী লীগের নিজেদের মধ্যে।
আসকের সাধারণ সম্পাদক এবং মানবাধিকার কর্মী নূর খান মনে করেন, দিন দিন আদর্শিক রাজনীতি দূরে চলে যাওয়ায় এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। দলগুলোর ভেতরে আরেকটি দল, নানা উপদল সৃষ্টি হয়েছে স্বার্থের কারণে। আর সে স্বার্থ নিয়েই দলের নানা উপদল অভ্যন্তরীণ সংঘাতে জড়িয়ে পড়ছে।
তার মতে, কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থার কারণে সরকার সমর্থক দলে এটা বেশি। বিরোধী দলগুলোও রাজনীতি না থাকায় অভ্যন্তরীণ সংঘাতে জড়িয়ে পড়ছে।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুদারের মতে, রাজনীতি এখন জনকল্যাণের জন্য নেই। এটা ব্যক্তি স্বার্থের জন্য হচ্ছে। তাই প্রকৃত রাজনীতি না থাকলেও সংঘাত-মারামারি আছে। এই সংঘাত ব্যক্তিগত সুবিধা আদায়ের জন্য। ক্ষমতাসীনরা সংঘাত-সংঘর্ষ করছে এখন সুবিধা পাওয়ার জন্য। কেউ পাচ্ছে আবার কেউ কম পাচ্ছে বা পাচ্ছে না। সেটা নিয়ে সংঘাত হচ্ছে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৬০০
আপনার মতামত জানানঃ