১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের পর তৎকালীন সরকার ১৮৬১ সালে এই উপমহাদেশে প্রথম পুলিশ আইন তৈরি করে। উপমহাদেশ থেকে সর্বোচ্চ রাজস্ব আদায় এবং ব্রিটিশদের বাণিজ্যিক স্বার্থ সংরক্ষণের হাতিয়ার হিসেবে তৈরি করা হয় পুলিশ বাহিনী। ওই বাহিনী দিয়েই ব্রিটিশরা ৮৬ বছরের বেশি তাদের স্বার্থ সংরক্ষণ ও লালন-পালন করেছে। ১৮৮৪ সালে বেঙ্গল পুলিশ ম্যানুয়াল নামে পুলিশের প্রথম প্রবিধিমালা প্রকাশ করে। তবে ব্রিটিশ সরকার ১৯৩৫ ও ১৯৪৩ সালে আরও দুই দফায় পুলিশ আইনটি সংশোধন করে। তারপর থেকে আর সংশোধন হয়নি।
যুগ যুগ ধরে বাংলাদেশ একটি অতি পুরাতন পুলিশ আইন নিয়ে চলছে। যা আধুনিক গণতান্ত্রিক সমাজের জন্য উপযুক্ত নয়। উপনিবেশিক আমলে পুলিশ ছিল প্রভুদের সেবাদাস। আর স্বাধীনতা উত্তরকালে গত কয়েক যুগ যাবত রাজনৈতিক ক্ষমতাবানরা অবৈধ প্রভাবের মাধ্যমে পুলিশকে নিয়ন্ত্রণ করে তাদের সেবায় নিয়োজিত রেখেছে।
অপরাধ বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ব্রিটিশ আমলের আইনটি সংশোধন হলে পুলিশকে রাজনৈতিক কাজে ব্যবহার করতে সমস্যা হবে। পুলিশকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার সুযোগ কমে আসবে। সেই সঙ্গে বন্ধ হয়ে যাবে পুলিশেরও রাজনৈতিককরণ। পুলিশ চাচ্ছে আইনটি সংশোধন হোক, আর রাজনৈতিক নেতারা চাচ্ছেন না হোক। তবে দেশের কথা চিন্তা করে ব্রিটিশ আইনটি দ্রুত সংশোধন করতে হবে। এটি হলে একদিকে পুলিশের কাজের জবাবদিহি বাড়বে, অন্যদিকে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তরা দ্রুত আইনের আওতায় আসবে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পুলিশ বাহিনীর পুনর্গঠনের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ পুলিশ এবং ইউনাইটেড ন্যাশন্স ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম বা জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি খসড়া প্রণয়ন কমিটি গঠন করা হয়েছিল। যে কমিটির চেয়ারম্যান করা হয়েছিল সাবেক আইজিপি ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এ. এস. এম. শাহজাহানকে। এই কমিটি ২০০৭ সালের মে মাসে কাজ শুরু করে। পরে তারা একটি খসড়া সংস্কার আইন জমাও দিয়েছিল। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ২০১৩ সালে পুরনো আইনটি সংশোধন করে একটি খসড়া তৈরি করে পুলিশ সদর দপ্তর। পরে সেখান থেকে প্রস্তাব আকারে সেটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠনো হয়। ওই সময় পুলিশ আইন নিয়ে ব্যাপক আলোচনা ছিল। গণমাধ্যমেও একের পর এক সংবাদ প্রকাশিত হয়। পুলিশ সদর দপ্তর থেকে পাঠানো আইনের খসড়া পাওয়ার পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কমিটি গঠন করে। কমিটির বৈঠকগুলোতে পুলিশপ্রধানের বর্তমান পদবি ‘ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশ’-এর জায়গায় ‘চিফ অব পুলিশ’ করার বিষয়ে আপত্তি তোলা হয়। এ ছাড়া খসড়ার আরো কিছু বিষয়ে আপত্তি তোলার কারণে নতুন আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়া আর খুব বেশি দূর এগোয়নি।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, আইনটি সংস্কার করা জরুরি। পুলিশ সদর দপ্তরের প্রস্তাবগুলো ভালো। আইনটি সংস্কার হলে রাজনৈতিক নেতাদের পাশাপাশি পুলিশের কতিপয় কর্মকর্তাও রাজনীতির বেড়াজালে থাকতে পারবেন না। সরকার চাইলে ছয় মাসের মধ্যেই আইনটি সংস্কার করা সম্ভব। এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, এগুলো নিয়ে কাজ হচ্ছে। কয়েকটি মিটিংও হয়েছে। বর্তমানে কী অবস্থায় আছে দেখে বলতে হবে।
পুলিশ পুনর্গঠন ও নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে প্রণীত খসড়া অধ্যাদেশে বলা হয়, পুলিশকে পেশাগতভাবে দক্ষ, সেবা নিবেদিত, জনগনের প্রতি বন্ধু ভাবাপন্ন, বাহ্যিক প্রভাবমুক্ত এবং আইন, আদালত ও জনগনের প্রতি দায়বদ্ধ হতে হবে। পুলিশি ব্যবস্থার নতুন চ্যালেঞ্জসমূহ, আইনের শাসন ও সুশাসনের নীতিসমূহ বিবেচনা করে পুলিশের ভুমিকা, কর্তব্য ও দায়িত্ব পুনঃসংজ্ঞায়িত করা সমীচীন। দক্ষতার সঙ্গে অপরাধ প্রতিরোধ, উদঘাটন ও দমন, জন শৃঙ্খলা শান্তি ও নিরাপত্তা সংরক্ষণের জন্য পুলিশ পুনর্গঠন প্রয়োজন।
ফাআ/মিই/
আপনার মতামত জানানঃ