নগরের বায়েজিদ এলাকায় রয়েছে অসংখ্য পাহাড়। কোলাহলপূর্ণ নগরের পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার দায়িত্ব যেন এসব পাহাড়ের উপর। কিন্তু দিনে দিনে বিলীন হচ্ছে বায়েজিদ এলাকার পাহাড়গুলো। রাজনৈতিক নেতা, প্রভাবশালী, পুলিশের লোকজনের হাতে প্রতিনিয়ত ধ্বংস হচ্ছে পাহাড়। বিশাল পাহাড় কেটে করা হচ্ছে সমতল। বানানো হচ্ছে ভবন।
রাজনৈতিক নেতা ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের পাশাপাশি পুলিশের দুই ডজনেরও বেশি সদস্যের হাতে প্রতিনিয়ত ধ্বংস হচ্ছে বায়েজিদের পাহাড়। রাজনৈতিক নেতা ও প্রভাবশালীদের সঙ্গে যোগসাজশে তারা পাহাড়ের একরের পর একর জমি দখলে নিচ্ছে। মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা পাহাড়গুলো পরিণত হচ্ছে সমতলে, বসতিতে।
স্থানীয়রা জানান, বায়েজিদ বোস্তামী থানায় কর্মরত ছিল এমন পুলিশ সদস্যই পাহাড় কাটা ও দখলের সঙ্গে জড়িত। দখলি জমি প্লট হিসাবে বা ভবন বানিয়ে ভাড়া দিয়ে থাকেন তারা। কখনো নিজেদের নামে, কখনো স্ত্রী-সন্তানদের নামে এ বেচাবিক্রি চলে। এমনকি কিছু প্লট (দখল) বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে স্ট্যাম্পের মাধ্যমেও। তবে খাস এসব জমি নিবন্ধন করার সুযোগ নেই।
জানা যায়, চৌধুরীনগর হাসান সাহেবের খামারবাড়ি এলাকায় পাহাড় কেটে টিনশেডের (সেমিপাকা) ঘর করেছেন বায়েজিদ থানার সাবেক এসআই ওয়াদুদ চৌধুরী ও এএসআই রেজাউলসহ কয়েকজন। গত কয়েক বছরে তারা পাহাড় দখল করে তা কেটে সমতল বা বসবাসের উপযোগী করেছে। চৌধুরীনগর রূপসী পাহাড়ে পাহাড় কেটে প্লট করে বিক্রি করেছেন বায়েজিদ বোস্তামী থানার সাবেক এসআই আফসার উদ্দিন রুবেল, এএসআই ইব্রাহিম, এএসআই মঞ্জু ও এএসআই সাঈদ। চন্দ্রনগর নাগিন পাহাড় ফুলকলি কারখানার পেছনে এসআই রিতেন শাহ পাহাড় কেটে তৈরি করেছেন প্লট। নাগিন পাহাড় এলাকায় রয়েছেন আরও কয়েকজন পুলিশ সদস্য। বায়েজিদ-ফৌজদারহাট রিং রোড এলাকায় পাহাড় কেটে বায়েজিদ থানার সাবেক এএসআই মিটু, এস আই দীপংকর প্লট করেছেন। এর বাইরে ডজনেরও বেশি পুলিশ সদস্য নামে-বেনামে পাহাড় কেটে ভবন নির্মাণ ও প্লট তৈরি করে বিক্রিতে যুক্ত। তারা ছাড়াও বেশ কয়েকজন পরোক্ষভাবে এ বাণিজ্যে যুক্ত। তবে এ অপকর্মে জড়িত নন বলে দাবি করেছেন তারা।
পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, গত বছর চন্দ্রনগর কিষোয়ান ফ্যাক্টরির পেছনের গ্রিনভিউ আবাসিক সংলগ্ন নাগিনী পাহাড় এলাকায় পাহাড় কাটেন বায়েজিদ বোস্তামী থানার সাবেক এসআই রিতেন শাহ। পরে পরিবেশ অধিদপ্তরের তদন্তেও এর সত্যতা মেলে। ওই বছরই শুনানি শেষে তাকে ৬ লাখ টাকা জরিমানা করে পরিবেশ অধিদপ্তর।
বায়েজিদ বোস্তামী থানায় কর্মরত ছিল এমন পুলিশ সদস্যই পাহাড় কাটা ও দখলের সঙ্গে জড়িত। দখলি জমি প্লট হিসাবে বা ভবন বানিয়ে ভাড়া দিয়ে থাকেন তারা। কখনো নিজেদের নামে, কখনো স্ত্রী-সন্তানদের নামে এ বেচাবিক্রি চলে। এমনকি কিছু প্লট (দখল) বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে স্ট্যাম্পের মাধ্যমেও।
পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম মেট্রো অঞ্চলের পরিচালক মোহাম্মদ নুরুল্লাহ নুরী দৈনিক যুগান্তরকে বলেন, ‘এসআই রিতেন শাহের পাহাড় কাটার বিষয়টি আমাদের তদন্তেও উঠে আসে। তাকে ৬ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। পরে তিনি উচ্চ আদালতে রিট করেন। এখনো উচ্চ আদালতের কাগজ আমরা হাতে পাইনি। পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘শুনানিতে কেউ অংশ না নিলে আমরা তার বিরুদ্ধে থানায় মামলা করি। যদি করিম শুনানিতে অংশ না নেন তাহলে আমরা তার বিরুদ্ধেও মামলা করব।’
পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম মেট্রো অঞ্চলের উপ-পরিচালক মিয়া মাহমুদুল হক বলেন, ‘সম্প্রতি বায়েজিদ বোস্তামী থানাধীন নাগিন পাহাড় ভিজিট করেছি। সেখানে ৬০ থেকে ৭০ জন দখলদার পেয়েছি। তাদের পেশাগত পরিচয় আমরা নিইনি। তাদেরকে আমরা অবৈধ দখলদার হিসাবে নোটিশ করেছি, জরিমানা করছি। পর্যায়ক্রমে বায়েজিদ এলাকার সব অবৈধ দখলদারের তালিকা করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
নগর পুলিশের উপপুলিশ কমিশনার (উত্তর) মোখলেসুর রহমান বলেন, ‘ইতঃপূর্বে বায়েজিদ এলাকায় কার কার জমি-বাড়ি আছে, এ সম্পর্কে একটি তথ্য নিয়েছি। যাদের জমি-বাড়ি আছে, তারা সবাই বায়েজিদ থানার সাবেক পুলিশ সদস্য। বর্তমানে কর্মরত আছেন এমন কারও নেই। যাদের আছে, তারা সেগুলো কিনে নিয়েছেন বলে জানিয়েছেন।’
বায়েজিদ বোস্তামী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ কামরুজ্জামান বলেন, ‘বায়েজিদ এলাকায় অনেক পুলিশ সদস্যের জমি-বাড়ি আছে বলে শুনেছি। তবে তারা কে কীভাবে এসব জমি-বাড়ির মালিক হয়েছেন তা আমার জানা নেই। এ বিষয়ে আমার কাছে কেউ অভিযোগ নিয়ে আসেনি।’
২০১১ সালে চট্টগ্রামের পাহাড় কাটা নিয়ে ‘হিল কাটিং ইন অ্যান্ড অ্যারাউন্ড চিটাগং সিটি’ শীর্ষক একটি গবেষণা প্রকাশিত হয়। এতে বলা হয়, বেশিরভাগ পাহাড় কাটা হয় পাহাড়তলী, খুলশী, বায়েজিদ, লালখান বাজার মতিঝর্ণা, ষোলশহর এবং ফয়’স লেকে।
১৯৭৬ থেকে ৩২ বছরে চট্টগ্রাম নগর ও আশেপাশের ৮৮টি পাহাড় সম্পূর্ণ এবং ১৯৫টি আংশিক কেটে ফেলা হয় বলে গবেষণায় উল্লেখ করা হয়। ১৯৭৬ সালে নগরের পাঁচ থানা এলাকায় মোট পাহাড় ছিল ৩২ দশমিক ৩৭ বর্গকিলোমিটার। ২০০৮ সালে তা কমে হয় ১৪ দশমিক ০২ বর্গকিলোমিটার। এ সময় ১৮ দশমিক ৩৪৪ বর্গকিলোমিটার পাহাড় কাটা হয়। এটা মোট পাহাড়ের প্রায় ৫৭ শতাংশ। নগরের বায়েজিদ, খুলশী, পাঁচলাইশ, কোতোয়ালি ও পাহাড়তলী থানা এলাকায় এসব পাহাড় কাটা হয়। সবচেয়ে বেশি ৭৪ শতাংশ কাটা পড়ে পাঁচলাইশে।
পরিবেশবিদরা বলছেন, চট্টগ্রাম এলাকায় বর্ষাকালে প্রাণঘাতী ভূমিধস ও কাদার প্রবাহ নেমে আসার প্রধানতম কারণ হলো পাহাড় কাটা। এর বিরুদ্ধে আইনের কঠোর প্রয়োগের বিষয়ে ঔদাসীন্য রয়েছে। এ ঔদাসীন্য কাটিয়ে ওঠা প্রয়োজন।
তারা বলেন, চট্টগ্রামের ঐতিহ্য পাহাড়। কিন্তু প্রশাসন ও বিভিন্ন দপ্তরের সমন্বয়হীনতার কারণে চট্টগ্রামের পাহাড়গুলো দিন দিন দখলে গিয়ে বিলাসবহুল প্রকল্প তৈরি হচ্ছে। কেউ দখল করে রাজনৈতিক ফায়দা নিতে ভাড়া দিচ্ছে। আবার কেউ আবাসন প্রকল্পের নামে পাহাড় কেটে সুউচ্চ আবাসন ভবন তৈরি করে চড়া দামে বিক্রি করছে।
এ পাহাড়ের ওপর প্রকল্পগুলোর নকশা সিডিএ কিভাবে অনুমোদন দেয়, সেটাই অন্ধকারে রয়ে গেছে। নগরীর সৌন্দর্য ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য পাহাড় সংরক্ষণ করা জরুরি।
পরিবেশকর্মীরা বলছেন, পাহাড় ও বন কাটার সঙ্গে জড়িত শ্রমিকদের মাঝেমধ্যে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। কিন্তু মূল হোতারা থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। পাহাড় কাটার বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে বা পরিবেশ আদালতে মামলা করেই যেন পরিবেশ অধিদপ্তর দায়িত্ব শেষ। এ কথা ভুলে গেলে চলবে না যে আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করা এবং পাহাড় ধ্বংসকারীদের আইনানুগ শাস্তি নিশ্চিত করার দায়িত্ব পরিবেশ অধিদপ্তরের। জরিমানা ছাড়াও পাহাড় বেষ্টনী দিয়ে বনায়ন করতে হবে।
তারা বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে যেসব আইন প্রণয়ন করা হচ্ছে, সেগুলোতে একই অপরাধ বারবার হলে শাস্তির মাত্রা কয়েক গুণ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। পরিবেশ আইনে যদি এমন দুর্বলতা থাকে, তাহলে তা দূর করা এবং আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ নিশ্চিত করা প্রয়োজন। প্রয়োজনে শাস্তির মাত্রা বাড়িয়ে পরিবেশ ধ্বংসকারী দুর্বৃত্তদের নিবৃত্ত করতে হবে। অন্যথায় বাংলাদেশ দ্রুতই পাহাড়শূন্য হয়ে যাবে, প্রাকৃতিক বনাঞ্চল বলে কিছু থাকবে না।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪৪০
আপনার মতামত জানানঃ