কাবুলে সামরিক হাসপাতালে সন্ত্রাসী হামলায় অন্ততপক্ষে ২৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। স্থানীয় আইএস শাখা এর দায় স্বীকার করেছে। বিস্ফোরণের পর আইএস সন্ত্রাসীরা গুলি চালাতে থাকে। তালিবান কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এই বিস্ফোরণে আহত হয়েছেন অন্তত ৪৩ জন।
আল-আরাবিয়ার খবরে বলা হয়েছে, কাবুলের কেন্দ্রে অবস্থিত ৪০০ শয্যা বিশিষ্ট সরদার মোহাম্মদ দাউদ খান হাসপাতালের প্রবেশপথে এই বিস্ফোরণ ঘটে।
হতাহতের সঠিক সংখ্যা জানা না গেলেও তালিবানের এক নিরাপত্তা কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, কমপক্ষে ১৯ জন নিহত এবং ৪৩ জন আহত হয়েছেন।
ইতালিয়ান জরুরি সহায়তা গ্রুপ ঘটনাস্থল থেকে তিন কিলোমিটার দূরে একট ট্রমা হাসপাতাল পরিচালনা করে। তারা জানিয়েছেন, তাদের হাসপাতালে আহত ৯ জনকে ভর্তি করা হয়েছে।
তালিবান মুখপাত্র জানিয়েছেন, ১৫ মিনিটের মধ্যে সব আইএস সন্ত্রাসীকে মারা সম্ভব হয়। সন্ত্রাসীরা হাসপাতালের ভিতরে ঢুকতে পারেনি। সশস্ত্র তালিবান যোদ্ধাদের হেলিকপ্টার করে হাসপাতালে নিয়ে এসে নামিয়ে দেয়া হয়। তারাই আইএস সন্ত্রাসীদের মোকাবিলা করে।
তালিবান আফগানিস্তান দখল করার পর থেকে সেখানে আইএস সন্ত্রাসীরা সক্রিয়। তারা একের পর এক আক্রমণ শানাচ্ছে। হাসাপাতালে মোট ছয়জন আইএস আক্রমণকারী ছিল।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র জানিয়েছেন, সাধারণ মানুষের পাশাপাশি তালিবান যোদ্ধাও মারা গেছেন। বাসিন্দাদের শেয়ার করা ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, হাসপাতালের সামনে থেকে ধোঁয়ার কুণ্ডলী উঠছে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, দুইটি হেলিকপ্টার ঘটনাস্থলে যায়।
গত ১৫ আগস্ট তালিবান আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখল করার পর আইএস খোরাসান শাখা নিজেদের অস্তিত্ব ও শক্তিমত্তা জানান দিতে হামলা বাড়িয়েছে।
হাসপাতালের একজন স্বাস্থ্যকর্মী বিস্ফোরণ থেকে রক্ষা পেয়েছেন। তিনি বলেন, বন্দুকের গুলির শব্দের কয়েক মিনিটর পর বড় ধরনের বিস্ফোরণ হয়। এর ১০ মিনিট পর ওয়াজির আকবর খান এলাকায় আরও বড় ধরনের বিস্ফোরণ হয়।
এর আগেও ২০১১ ও ২০১৭ সালে ওই হাসপাতাল আক্রান্ত হয়েছিল। ২০১১ সালে তালিবান আত্মঘাতী দলের এক সদস্য হাসপাতালে ঢুকে বিস্ফোরণ ঘটায়। ২০১৭ সালে চিকিৎসাকর্মীর পোশাক পরে এক সন্ত্রাসী ভিতরে ঢুকে গুলি চালাতে থাকে। সেবার ৩০ জনের মৃত্যু হয়েছিল।
এর আগে গত মাসের মাঝামাঝি জুমার নামাজের সময় আফগানিস্তানের কান্দাহারে বিবি ফাতিমা মসজিদে বিস্ফোরণের ঘটনায় অন্তত ৩৩ জন নিহত এবং ৯০ জন আহত হয়৷
আফগানিস্তানে কুন্দুজের একটি শিয়া মসজিদে একই ধরনের বোমা বিস্ফোরণের ঘটনার ঠিক এক সপ্তাহের মাথায় এ ঘটনা ঘটে। কান্দাহারের এক স্থানীয় সাংবাদিক বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে জানান, প্রত্যক্ষদর্শীরা তিন আত্মঘাতী হামলাকারীর হামলা চালানোর বর্ণনা দেয়৷ এক হামলাকারী মসজিদের প্রবেশপথে নিজেকে উড়িয়ে দেয় এবং অন্য দুইজন মসজিদের ভেতরে বিস্ফোরক ডিভাইসের বিস্ফোরণ ঘটায়৷
আইএসকে ও তালিবানের শত্রুতা
আফগানিস্তানের তালিবান মুখপাত্র জবিউল্লাহ মুজাহিদ উগ্র জঙ্গিগোষ্ঠী আইএসকে তাদের শত্রু বলে অভিহিত করেন। তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেন, আইএস আমাদের শত্রু এবং সব মুসলিম দেশ এই গোষ্ঠীর বিরোধী।
তালিবানের সঙ্গে এই জঙ্গিগোষ্ঠীর কোনো রকম সম্পর্ক নেই বলে জবিউল্লাহ মুজাহিদ দাবি করেছেন।
প্রসঙ্গত, তালিবান গোষ্ঠী আফগানিস্তানে যেমন মার্কিন জোট বাহিনীর বিরুদ্ধে দুই দশক ধরে লড়াই করে এসেছে, ঠিক তেমনি তারা আরেক প্রতিদ্বন্দ্বী ইসলামিক স্টেট জঙ্গি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধেও আরও একটি পৃথক যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে।
আইএসআইএস-কে নামে পরিচিত, ইসলামিক স্টেটের আফগান বাহিনী, আফগানিস্তানের কিছু অংশকে মধ্যপ্রাচ্যের মতো করে বিস্তৃত খেলাফতের অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা করছে।
সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের আফগানবিষয়ক বিশেষজ্ঞ সেথ জোনস বলেন, ‘আইএস ও আইএস-কের লক্ষ্য ইসলামিক আমিরাত প্রতিষ্ঠা। তালিবানও ইসলামিক আমিরাতের কথা বলে। তা সত্ত্বেও আল-কায়েদা ও তালিবানের প্রতিদ্বন্দ্বী আইএস ও আইএস-কে।
যদিও সম্পদ ও অঞ্চল নিয়ে তালিবান ও আইএস-কের মধ্যে অহরহই সংঘর্ষ বাধে। সংঘর্ষের অন্যতম কারণ মতাদর্শগত ভিন্নতা বলে প্রচার করা হলেও, তার যৌক্তিক কারণ স্পষ্ট নয়। তবে সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের ভাষ্য, ‘মতাদর্শগত ভিন্নতা ও সম্পদের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা তালিবান ও আইএস-কের মধ্যকার শত্রুতার মূল কারণ।
তালিবানের বিরুদ্ধে আইএস-কের অভিযোগ, ইসলামের সর্বজনীন বিশ্বাসের মাধ্যমে জনমনে আস্থা তৈরি না করে সংকীর্ণ জাতিগত ও জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে তালিবান জনমনে বৈধতা অর্জন করে।
সিএনএন বলছে, তালিবানর জাত শত্রু আইএস-কে। ফোর্বসও একই কথা বলছে। কিন্তু বিবিসি বলছে ভিন্ন কথা। এই সংবাদমাধ্যমের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে তালিবানের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে আইএস-কে। সেই সংগঠনটি হলো হাক্কানি নেটওয়ার্ক।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, তালিবানের গুরুত্বপূর্ণ শাখা হাক্কানি নেটওয়ার্কের সঙ্গে আইএসের সম্পর্ক রয়েছে। হাক্কানি নেটওয়ার্কের নেতা সিরাজুদ্দিন হাক্কানি তালিবানেরও নেতা।
এশিয়া প্যাসিফিক ফাউন্ডেশনের হয়ে কাজ করছেন সাজান গোহেল। আফগানিস্তানের জঙ্গি নেটওয়ার্কগুলো পর্যবেক্ষণ করেন তিনি। তার কথায়, ২০১৯ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত বেশ কিছু হামলা তালিবানের হাক্কানি নেটওয়ার্ক ও আইএস-কে একসঙ্গে চালিয়েছে।
তালিবানের সঙ্গে আইএস-কের যে সম্পর্ক রয়েছে, তার আরেকটি প্রমাণ মেলে তালিবানের সাম্প্রতিক এক পদক্ষেপে। ১৫ আগস্ট কাবুলের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর পুল-ই-চরকি কারাগারের তালা খুলে দেয় তারা। সেই কারাগারে যারা ছিলেন, তাদের অধিকাংশ আল-কায়েদা ও আইএসের সদস্য। এ থেকে বিশ্লেষকদের অনুমান, ভেতরে–ভেতরে তালিবানের সঙ্গে বেশ ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকতে পারে আইএসের এই শাখার।
২০১৪ সালে আইএসের তৎকালীন প্রধান আবু বকর আল-বাগদাদির প্রতি আনুগত্য জানান পাকিস্তানি হাফিজ সাঈদ খান। সাঈদের হাত ধরে বেশির ভাগ পাকিস্তানি যোদ্ধা নিয়ে আফগানিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় নানগারহার প্রদেশে ছোট সংগঠন হিসেবে আইএস-কের কর্মকাণ্ড শুরু হয়। পাকিস্তানি তালিবান ও আফগান তালিবানের কয়েকজন যোদ্ধাও ওই সময় আইএস-কেতে যুক্ত হয়।
ইরাক ও সিরিয়ায় ঘাঁটি থাকা আইএসের মতো আইএস-কেও আফগানিস্তানের পুরো অঞ্চল দখল করতে চায়। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৫ সালে আফগানিস্তানে কাজ করা শুরু করে আইএস-কে।
২০১৯ সালে জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস সতর্ক করে বলেন, সিরিয়া ও ইরাকে আইএস অঞ্চল হারানোর পর আফগানিস্তানে তাদের অঙ্গসংগঠন আইএস-কের হাতে সন্ত্রাসবাদ অর্থায়নের জন্য কোটি কোটি টাকা রয়েছে।
তবে আফগানিস্তানে অঞ্চল দখলে আইএস-কে কখনো সফল হয়নি। মসজিদ, স্কুল, বিয়ে অনুষ্ঠানে বেসামরিক নাগরিকদের হামলাই সংগঠনটির মূল লক্ষ্য। আফগানিস্তানে বেসামরিক নাগরিকদের ওপর নৃশংস হামলার জন্য সুপরিচিত আইএস-কে। শিয়া সম্প্রদায়ের মানুষজন প্রায়ই তাদের হামলার শিকার হয়।
২০১৫ সালের দিকে আইএস-কের প্রতিষ্ঠাতা সাঈদসহ মূল নেতারা যুক্তরাষ্ট্রের বিমান হামলায় প্রাণ হারান। তা সত্ত্বেও আফগানিস্তানে আইএস-কের বিনাশ হয়নি।
জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, আফগানিস্তানের কোনার ও নানগারহার প্রদেশে আইএস-কের দেড় হাজার থেকে দুই হাজারের বেশি যোদ্ধা রয়েছে। এ ছাড়া ছোট ছোট দলে তারা আফগানিস্তান জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৬০০
আপনার মতামত জানানঃ