কিশোর বা প্রাপ্তবয়স্ক তরুণদের মধ্যে মেয়েদের তুলনায় ছেলে ও পুরুষদের মৃত্যু হচ্ছে বেশি। ইউনিভার্সিটি কলেজ অব লন্ডনের নতুন এক গবেষণায় এমন তথ্য উঠে এসেছে।
প্রতিবেদনে সতর্ক করে বলা হয়েছে, তরুণ প্রজন্মে মৃত্যুহারে এই লিঙ্গ পার্থক্য অনেক দেশেই বাড়ছে। সোমবার (১ নভেম্বর) ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ান এখবর জানিয়েছে।
গবেষণা প্রতিবেদন অনুসারে, ২০১৯ সালে বিশ্বে ১০ থেকে ২৪ বছর বয়সীদের মৃত্যুর দুই-তৃতীয়াংশ (৬১ শতাংশ) ছিল ছেলে ও পুরুষ। ১৯৫০ সালের তুলনায় এই বয়সী ছেলেদের মৃত্যুর হার কমেছে ১৫ দশমিক ৩ শতাংশ। কিন্তু এই কমার হার একই বয়সের মেয়েদের তুলনায়। মেয়েদের মৃত্যুর হার কমেছে ৩০ শতাংশ।
ক্যারিবীয় ও লাতিন আমেরিকার ছেলে ও মেয়েদের মৃত্যুর হারে পার্থক্য বেশি। এই দুই অঞ্চলে ২০ থেকে ২৪ বয়সী ছেলেদের মৃত্যুর হার মেয়েদের তুলনায় তিনগুণ। এই অঞ্চলে ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী ছেলেদের মৃত্যুর শীর্ষ কারণ ব্যক্তিগত সহিংসতা ও সংঘাত। গত ২০ বছরে অঞ্চল দুটিতে এই বয়সীদের মৃত্যুর হার কমাতে উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি হয়নি।
২০১৯ সালে ছেলেদের মৃত্যুর প্রধান কারণ বয়স ও অঞ্চলভেদে ভিন্ন। উচ্চ আয়ের দেশগুলো ছাড়া সব অঞ্চলে ১০ থেকে ১৪ বছর বয়সীদের মৃত্যুর শীর্ষ কারণ দুর্ঘটনা। উচ্চ আয়ের দেশগুলোতে এই বয়সীদের মৃত্যুর শীর্ষ কারণ ক্যানসার।
দক্ষিণ এশিয়া ও সাব-সাহার আফ্রিকায় মৃত্যুর শীর্ষ কারণ হচ্ছে দূষিত খাবার ও পানি পান। বিশ্বের সর্বত্র ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সীদের মৃত্যুর শীর্ষ কারণ পরিবহন দুর্ঘটনা।
প্রতিবেদনে সতর্ক করে বলা হয়েছে, তরুণ প্রজন্মে মৃত্যুহারে এই লিঙ্গ পার্থক্য অনেক দেশেই বাড়ছে।
গবেষকরা বলছেন, ছেলে ও তরুণদের মৃত্যুর শীর্ষ কারণগুলো সমাধানে খুব কম অগ্রগতির কারণে বিভিন্ন অঞ্চলে মৃত্যুতে লিঙ্গ বৈষম্য বাড়ছে।
ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের শিশু স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের জোসেফ ওয়ার্ড বলেন, ‘ছেলেদের মৃত্যুর সংখ্যা বেশি হওয়া ইঙ্গিত দেয় সহিংসতায় মৃত্যু, ট্রমা ও মাদকের অপব্যবহার বৃদ্ধি। এটি এই বয়সীদের মৃত্যু ঠেকাতে ব্যর্থতার প্রতিফলন।’
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১০-২৪ বছর বয়সীদের নীতিনির্ধারকরা অবহেলা করেছে এবং করোনা মহামারী মৃত্যুহার কমানোর উদ্যোগকে বাধাগ্রস্ত করেছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, মানুষ যখন চরম মাত্রায় বৈষয়িক ও ভোগবাদিতায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে, তখন সম্পদের মোহ তার নিজের জীবনের চেয়েও কাঙ্ক্ষিত বস্তু হয়ে দাঁড়ায়। এর পেছনে রয়েছে দেশে সামাজিক অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতা, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, বিচারহীনতার সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের সংকট। এসব অবক্ষয় আমাদের নতুন প্রজন্মের মনোজগতে এক ধরণের বিকারগ্রস্ততার জন্ম দিচ্ছে।
সাম্প্রতিক সময়ে শিশু-কিশোরদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা এবং কিশোর গ্যাং কালচার বৃদ্ধি পেয়েছে। পারিবারিক শৃঙ্খলা ও পরিচর্যার মধ্যে বেড়ে ওঠা কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে করোনাকালীন বাস্তবতায় দেশের অধিকাংশ শিশু-কিশোর কোনো না কোনো আসক্তিতে নিমজ্জিত হয়েছে। দীর্ঘদিন স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকায় মোবাইল ফোন আসক্তি, মাদকাসক্তি, বিদেশি বিকৃত সংস্কৃতির দ্বারা প্রভাবিত হয়ে টিকটক, পুলপার্টি, কিশোর গ্যাংয়ের মতো অপরাধপ্রবণ সংঘ গড়ে তুলেছে কিশোর-তরুণরা। এসবের বাইরে আরেকটি গ্রুপ মানসিক বিষন্নতার শিকার হয়ে পড়ছে এবং এদের কেউ কেউ আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে।
সম্প্রতি লাইফস্প্রিং নামের একটি স্বাস্থ্য বিষয়ক বেসরকারী সংস্থার পরিচারিত জরিপে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশে আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ছে। বছরে ক্রমবর্ধমান এ সংখ্যা অর্ধলক্ষাধিক। সবচেয়ে আতঙ্কজনক বিষয় হচ্ছে, কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়ে যাওয়া।
আঁচল ফাউন্ডেশন নামের একটি বেসরকারি সংস্থার গবেষনা জরিপে করোনাকালে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের সময় দেড়শতাধিক শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে বলে জানা গেছে। ইউনেস্কো, ইউনিসেফের মতো বিশ্ব সংস্থার পক্ষ থেকেও দীর্ঘদিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিশু-কিশোরদের মানসিক বিপর্যয় সৃষ্টির আশঙ্কা ব্যক্ত করা হয়েছিল।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বড় শহরগুলোতে শিশু-কিশোরদের জন্য পর্যাপ্ত খেলার মাঠ, শিশুপার্ক, ওপেন স্পেস বা প্রাকৃতিক পরিবেশে বিনোদনের সুযোগ না থাকায় শিশু-কিশোরদের মনোজাগতিক বিকাশ চরমভাবে চাপ ও বাধার সম্মুখীন হচ্ছে। কিশোর-কিশোরী শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার প্রবণতা তাদের বিষন্নতা ও হতাশা থেকে মুক্তি পাওয়ার শেষ চেষ্টা বা বিকৃত অ্যাডভেঞ্চারিজম দ্বারা তাড়িত।
আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা তাদেরকে বেঁচে থাকার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে সঠিক চিন্তা ও ধারণা দিতে সক্ষম হয়নি। আমাদের পারিবারিক ও সামাজিক ব্যবস্থা শিথিল হয়ে পড়া ও পারিবারিক বিচ্ছিন্নতা ও সহিংসতার শিকার হচ্ছে শিশু-কিশোররা। বিচ্ছিন্নভাবে কাউন্সেলিং করে এ অবস্থার উন্নয়নে খুব বেশি সফলতা প্রত্যাশা করা যায় না। এ জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন শিক্ষাব্যবস্থায় নৈতিক মূল্যবোধসম্পৃক্ত করে আমূল ঢেলে সাজানো। পরিবারে শান্তি-শৃঙ্খলা, পারস্পরিক নির্ভরশীলতা, সহমর্মিতা ও আস্থাপূর্ণ পরিবেশ ও সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে পিতা-মাতা ও সন্তানদের মধ্যে ধৈর্য্যশীলতা ও আধ্যাত্মবোধের শিক্ষাকে জাগ্রত করতে হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬৩৯
আপনার মতামত জানানঃ