নির্বাচন! তা সংসদ হোক বা উপজেলা— বাংলাদেশের নির্বাচনে শক্তি প্রদর্শন, ক্ষমতার অপব্যবহার, কারচুপি খুব প্রকাশ্য সত্য। ২০১২ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে বাংলাদেশে দুটি সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে৷ সূচকে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশ ৩৮ স্কোর করেছে৷ সে হিসেবে ১৬৬টি দেশের মধ্যে ২১টি দেশের চেয়ে বাংলাদেশের নির্বাচনের মান ভালো৷ দক্ষিণ এশিয়ায় একমাত্র আফগানিস্তানের (৩৪) চেয়ে বাংলাদেশের নির্বাচনের মান ভালো৷ অন্যান্য দেশগুলোর স্কোর ভুটান (৬৬), ভারত (৫৯), নেপাল (৫৬), মালদ্বীপ (৫২), শ্রীলঙ্কা (৫২) ও পাকিস্তান (৪৭)৷
সম্প্রতি বিএনপিসহ কয়েকটি দলের বর্জনের মুখে প্রায় একদলীয় ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনেও বিভিন্ন স্থানে সংঘাত, সংঘর্ষ ও প্রাণহানি ঘটে চলেছে। ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে না যাওয়ার হুমকিও দিচ্ছে ক্ষমতাসীন দল। এমনকি গত ৩০ অক্টোবর অব্দি আগামী ১১ নভেম্বর নির্বাচন সামনে রেখে আট জেলায় প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যকার সংঘর্ষে ২ জনের প্রাণহানি এবং অসংখ্য জনের আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। এর আগে কয়েক দিনের ব্যবধানে মারা গেছেন তিনজন।
সব মিলিয়ে এবারের ইউপি নির্বাচন কেবল প্রশ্নবিদ্ধই হচ্ছে না, এর মূল উদ্দেশ্যও ব্যাহত হচ্ছে। দলীয় প্রতীক কিংবা উন্মুক্ত পদ্ধতি— যেভাবেই নির্বাচন হোক না কেন, তা হতে হবে শান্তিপূর্ণ পরিবেশে, যাতে ভোটাররা নির্বিঘ্নে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেন।
‘ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে যেতে দেওয়া হবে না’
ইউপি নির্বাচনে নৌকা প্রতীকের ভোটার ছাড়া অন্য ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে যেতে দেওয়া হবে না বলে হুমকি দিয়েছেন নাটরের জেলা আওয়ামী লীগের যুব ও ক্রীড়া বিষয়ক সম্পাদক মাসুদুর রহমান মাসুদ। গতকাল শনিবার সন্ধ্যায় নাটোর সদর উপজেলার তেবাড়িয়া ইউনিয়নের বাঙ্গাবাড়িয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে নির্বাচনী প্রচারণা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ হুমকি দেন।
বক্তব্যে বিরোধীদের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, “তারা ১১ তারিখে ভোটকেন্দ্রে গিয়ে ষড়যন্ত্র করবে। যাতে করে সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়, জননেত্রী শেখ হাসিনার ভাবমূর্তি নষ্ট হয়, সংসদ সদস্য শফিকুল ইসলাম শিমুলের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়। তাই এদের ভোটকেন্দ্রে যেতে দেওয়া যাবে না।”
তিনি আরও বলেন, “যারা গণতন্ত্রকে হত্যা করেছে, যারা ভোটের অধিকার কেড়ে নিয়েছিল তাদের আর ভোট দেওয়ার অধিকার নাই বাংলার মাটিতে। বাংলার মাটিতে ভোট দিবে যারা ভোট ও ভাতের অধিকার আদায়ের জন্য জননেত্রী শেখ হাসিনার পাশে ছিল।”
মাসুদুর রহমান আরও বলেন, “আপনাদের মাঝে আমি বলতে চাই নাটোরের আপনাদের আমাদের প্রিয় নেতা শফিকুল ইসলাম শিমুল ম্যাসেজ দিয়েছেন কোনো প্রকার নৌকার বিরোধীরা ১১ তারিখে ভোটকেন্দ্রে যেতে পারবে না। ভোট তো দেওয়া দূরে থাক, ভোটকেন্দ্রের আশেপাশে যেতে পারবে না!”
সভায় বিএনপি দলীয়, স্বতন্ত্র প্রার্থী এবং আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীর ভোটারদের উদ্দেশ্যে একই হুমকি দেন তাঁতী লীগের জেলা সভাপতি মশিউর রহমান, তেবাড়িয়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি বকুল হোসেন। তারাও তাদের বক্তব্যে অন্য প্রার্থীর ভোটারদের কেন্দ্রে না আসতে সতর্ক করে দেন।
এ সময় আরো বক্তব্য রাখেন নাটোর সদর উপজেলা যুবলীগের সভাপতি আব্দুর রাজ্জাক ডাবলু, সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি আহাদ আলী তেতু এবং নৌকা প্রতীকের প্রার্থী ওমর আলী প্রধান।
ভোটারদের হুমকি দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে নাটোরের জেলা প্রশাসক শামীম আহমেদ জানান, এ ধরণের কোনো অভিযোগ তিনি পাননি। অভিযোগ পেলে পুলিশ সুপারকে সঙ্গে নিয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। হুমকির বিষয়ে কোনো প্রমাণ পাওয়া গেলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান জেলা প্রশাসক।
জানতে চাইলে নাটোরের পুলিশ সুপার লিটন কুমার সাহা বলেন, “আচরণ বিধি লঙ্ঘনের বিষয়ে প্রার্থীদের সতর্ক করা হয়েছে। ভোটকেন্দ্রে যেতে ভোটারদের কোনো প্রতিবন্ধকতা যেন কেউ সৃষ্টি করতে না পারে, তা কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করতে পুলিশ দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।”
তিনি বলেন, “ভোটারদের কেউ কোনো বাঁধা সৃষ্টি করতে পারবে না, পুলিশ সেটা নিশ্চিত করবে।”
তেবাড়িয়া ইউপি নির্বাচনে ঘোড়া প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী তেবাড়িয়া ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি সাইফুল ইসলাম বলেন, “নৌকার সমর্থকরা শুধু ভোটারদের হুমকি নয়, পোস্টার ছিঁড়ে ফেলছে, প্রচারণায় বাঁধা দিচ্ছে, এমনকি মারধরের হুমকি দিচ্ছে।”
তিনি আরও বলেন, “আচরণবিধি লঙ্ঘনের বিষয়ে লিখিত অভিযোগ দিয়েও কোনো প্রতিকার পাওয়া যায়নি।”
সন্ত্রাসের রাজত্ব
বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে যেসব খবর আসছে, তাতে দেখা যাচ্ছে ইউপি নির্বাচন নিয়ে সংঘর্ষ হচ্ছে মূলত আওয়ামী লীগের মনোনীত ও বিদ্রোহী প্রার্থীর অনুসারীদের মধ্যে। ১১ নভেম্বর ৮৪৮টি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্যপদে নির্বাচন হওয়ার কথা। এর মধ্যে বিদ্রোহী প্রার্থীর সংখ্যা ৬৯১।
দলীয় মনোনয়ন নিয়ে ক্ষমতাসীন দলও যে স্বস্তিতে নেই, তার প্রমাণ অনেক স্থানে কাউকে মনোনয়ন না দিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা উন্মুক্ত রাখা হয়েছে। এর আগে মাদারীপুরের বেশ কিছু ইউনিয়নে প্রার্থিতা উন্মুক্ত রাখা হয়েছিল। সামনের নির্বাচনেও অন্তত আটজন সাংসদ প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় প্রধানের কাছে তাদের নির্বাচনী এলাকায় কাউকে মনোনয়ন না দিয়ে উন্মুক্ত রাখার অনুরোধ জানিয়েছেন।
এবারের ইউপি নির্বাচনে সংঘর্ষে জড়াচ্ছে আওয়ামী লীগ নিজেরাই। সূত্র মতে, গতকাল শনিবার রাতে ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনকে কেন্দ্র করে পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলায় চেয়ারম্যান প্রার্থী দুই প্রার্থীর মধ্যে সংঘর্ষে অন্তত ১০ জন আহত হয়েছেন। নওমালা ইউনিয়নের আওয়ামী লীগ মনোনীত চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী মো. কামাল হোসেন বিশ্বাসের সমর্থক এবং আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী ও বর্তমান ইউপি চেয়ারম্যান মো. শাহজাদা হাওলাদারের সমর্থকের মধ্যে এই সংঘর্ষ হয়।
এছাড়া পটুয়াখালী শহরে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের জেরে সহিংসতায় স্বতন্ত্র চেয়ারম্যান প্রার্থীসহ পাঁচজন আহত হয়েছেন। হামলায় জড়িত থাকার অভিযোগে নৌকা প্রতীকের চেয়ারম্যান প্রার্থীর ভাই পৌর কাউন্সিলর রেজাউল হাসান লাবুকে আটক করেছে পুলিশ।
আহতদের অভিযোগ, স্থানীয় যুবলীগ নেতা-কর্মীরা তাদের ওপর হামলা চালিয়েছেন। পটুয়াখালী শহরের কাছে লোহালিয়া খেয়াঘাটের পূর্ব পারে গত শুক্রবার রাতে এই সহিংসতার ঘটনা ঘটে।
এদিকে, মুন্সিগঞ্জের শ্রীনগরে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে স্বতন্ত্র চেয়ারম্যান প্রার্থীর প্রচারে নৌকা প্রতীকের প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকদের হামলা ও ভাঙচুরের অভিযোগ পাওয়া গেছে। উপজেলার ব্রাহ্মণ্যখোলা এলাকায় শুক্রবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে এই হামলার ঘটনা ঘটে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
তবে এ বিষয়ে অভিযুক্ত প্রার্থীর বক্তব্য পাওয়া যায়নি। হামলায় আনারস প্রতীকের চেয়ারম্যান প্রার্থী আলী আকবরসহ অন্তত ২০ জন আহত হয়েছেন। এ সময় কয়েকটি অটোরিকশা ভাঙচুর করা হয়। আহত আলী আকবরকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় পাঠানো হয়েছে।
এর আগে যশোরের ঝিকরগাছায় ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনী প্রচারণার সময় বৃহস্পতিবার রাতে ৪ প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে পৃথক সংঘর্ষে কমপক্ষে ২০ জন আহত হয়েছেন। আহতদের ৬ জনকে যশোর জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
আহত স্বতন্ত্রপ্রার্থী বীরমুক্তিযোদ্ধা জহুরুল হক জানান, বৃহস্পতিবার রাতে তিনি নেতা-কর্মীদের নিয়ে নির্বাচনী প্রচারণায় উপজেলার মিশনপাড়ায় যান। তখন তার প্রতিদ্বন্দ্বী ও আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী মতিয়ার রহমান সরদারের সমর্থকরা তাদের ওপর হামলা চালায়। তাকে ও তার কর্মী আবু সাঈদকে কুপিয়ে জখম করা হয়। পরে স্থানীয়রা তাদের উদ্ধার করে যশোর জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করেন।
অভিযুক্ত আওয়ামী লীগ মনোনীত চেয়ারম্যানপ্রার্থী মতিয়ার রহমান সরদার বলেন, “আমার সমর্থকরা কোনো হামলা করেনি। তাদের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে এই সংঘর্ষ হয়েছে। এখানে অযাচিতভাবে আমাকে ও আমার সমর্থকদের দায়ী করা হচ্ছে।”
এদিকে, পানিসারা ইউনিয়নের স্বতন্ত্র চেয়ারম্যান প্রার্থী পিকুল হোসেন নির্বাচনী প্রচারণায় বেজিয়াতলা বাজারে গেলে তার প্রতিদ্বন্দ্বী ও আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী নওশের আলীর সমর্থকরা তাদের ওপর হামলা করে। এতে দু’পক্ষ সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে এবং কমপক্ষে ১৫ জন আহত হন। স্থানীয়রা তাদের উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করেন।
মিছিলে যেতে না চাওয়ায় মারধর
বরগুনায় আসন্ন ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যান প্রার্থীর প্রচারের মিছিলে যেতে না চাওয়ায় এক একজনকে মারধরের অভিযোগ উঠেছে। আবদুল লতিফ ফকির নামের ওই ব্যক্তি জানান, সদর উপজেলার এম বালিয়াতলী ইউনিয়নের পাতাকাটা গ্রামে শনিবার সন্ধ্যা ৬টার দিকে এ ঘটনা ঘটে। তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী এম এ বারিকে সমর্থন দিলেও নাসিরের সমর্থক আবুল কালাম ও মনিরসহ চার পাঁচজন তাকে জোর করে নৌকার মিছিলে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন।
তিনি যেতে না চাইলে তারা তাকে কলার ধরে টেনেহিঁচড়ে নেয়ার চেষ্টা করেন ও একপর্যায়ে মারধর করেন। আবদুল লতিফ অভিযোগ করে বলেন, “তারা আমাকে হুমকি দিয়ে গেছে যদি এখানে কেউ নৌকার বিপক্ষে যায় তাহলে হাত-পায়ের রগ কেটে দেয়া হবে। নির্বাচনের জন্য এই বয়সে এমন অপমান খুবই দুঃখজনক।”
তবে এমন অভিযোগ অস্বীকার করেছেন নৌকার প্রার্থী নাজমুল ইসলাম নাসির। আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী নাসির বলেন, “এরকম কোনো ঘটনার খবর আমি পাইনি। আমার জনসমর্থন দেখে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়ানোর চেষ্টা করছে।”
এসডব্লিউ/এসএস/১৪০০
আপনার মতামত জানানঃ