ইতিহাসের জনক খ্যাত হেরোডোটাসের বিবরণী থেকে জানা যায়, প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতায় ফারাওদের স্ত্রী, অনন্যা রুপসী কোনো রমনী কিংবা প্রখ্যাত নারী যখন মারা যেতেন তাদের মৃতদেহকে সংরক্ষণের জন্য মমিও করা হত। তবে এর পূর্বে তিন থেকে চার দিন রেখে দিয়ে পচন ধরে একটু বিকৃত হওয়ার অপেক্ষা করা হত। এর পেছনে প্রাচীন মিশরীয়দের একটা খারাপ স্বভাবের কথা উল্লেখ করে গবেষকগণ মতামত প্রদান করেছেন। প্রাচীন মিশরের পাপাচারী পুরোহিত, রাজপরিবারের সদস্য এমনকি অনেক সাধারণ মানুষ সুযোগ বুঝে মৃতদেহের সঙ্গে মিলিত হত।
সেক্ষেত্রে যদি কোনো সম্ভ্রান্ত কিংবা অনন্যা সুন্দরী কোনো নারী মারা যেতেন, তবে পরিস্থিতি হত আরো বেশি জঘন্য। তাই এর থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যই মৃতদেহকে একটু পচিয়ে নেয়া হতো। উদ্দেশ্য একটাই যেন উক্ত মৃতদেহ কোনো নেক্রোফেলিক যৌন সঙ্গমের উদ্দেশ্যে কেউ ব্যবহার করতে না পারে। সে জন্যই বেশির ভাগ মিশরীয় নারীর মমিকে অনেকটা বীভৎস, বিকৃত, ক্ষতিগ্রস্ত ও গলিত অবস্থার পরে সংরক্ষণ করা হয়েছিল বলে জানা যায়।
আধুনিক যুগেও বিখ্যাত অনেক খুনি আছেন যারা নেক্রোফিলিয়ায় ভুগে পৈশাচিক কর্মকান্ড ঘটিয়েছেন। এদের একজন অ্যান্থনি মেরিনো। তিনি কাজ করতেন নিউ জার্সির এক হাসপাতালে। আর সেখানেই মৃত রোগীদের সঙ্গে যৌনাচার করতে গিয়ে ধরা পড়েন। এরপর সাত বছরের জেল হয় তার।
আর একজন ভিক্টর আর্ডিসন। ফ্রান্সের এক ছোট শহরে কবর খোঁড়ার কাজ করত। শতাধিক মৃতদেহের সঙ্গে যৌন মিলন করেছে সে। পুলিশ তার ঘরে একটি তিন বছরের বাচ্চা মেয়ের মৃতদেহ পায়। যার সঙ্গে সে যৌনকর্ম করেছিল। এমনকি সে একটি মেয়ের মাথার খুলি সবসময় কাছকাছি রাখত আর সেটিকে বলত ‘আমার বউ’। তার কথায় সে মৃতদেহের সঙ্গে গল্প করার চেষ্টাও করত। তবে যখন মৃতদেহগুলো তার কথার উত্তর দিত না। তখন সে দুঃখ পেত ও হতাশ হয়ে পড়ত। তাকে সারা জীবনের জন্য এক মানসিক রোগীদের হাসপাতালে পাঠানো হয়।
টেড বান্ডি সম্ভবত পৃথিবীর সবচেয়ে কুখ্যাত সিরিয়াল কিলার। তার নিজের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী তিনি খুন করেছেন ৩০ জনকে। আসল সংখ্যা হয়ত আরো অনেক বেশি। এদের অনেকের সঙ্গেই খুন করে যৌনকর্ম করেছেন তিনি। তার প্রথম শিকার লিনেট কালভার নামের বছর বারোর একটি মেয়ে। যাকে সে পানিতে ডুবিয়ে মারে। তারপর মৃতদেহের সঙ্গে করে যৌনমিলন। ১৯৮৯ সালে তার মৃত্যুদণ্ড হয়।
মেডিকেল সায়েন্সের ভাষায়, মৃতদেহের প্রতি এই ধরণের জঘন্য ও বিকৃত রুচির যৌন আসক্তির নাম নেক্রোফিলিয়া। এর শাব্দিক বিশ্লেষণ করতে গেলে আমরা দুটি প্রাচীন গ্রিক শব্দকে খুঁজে পাই। একটি নেক্রোস অর্থাৎ মৃত এবং অন্যটি অর্ফিলিয়া অর্থাৎ ভালবাসা বা আসক্তি। অনেক মনোস্তাত্ত্বিক এটাকে এক ধরণের মানসিক রোগও বলার পক্ষপাতী। এ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি মৃতদেহের উপরে এক ধরণের মারাত্বক ভাবাবেগ অনুভব করে।।একে থ্যানাপ্টোফিলিয়া ও ন্যাক্রোলেগনিয়া ও বলা হয়ে থাকে। এটি মৃতদেহ, মরা, লাশ বা শবদেহের প্রতি এক ধরনের কুরুচিপূর্ণ যৌন আসক্তি।
এটিকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের পরিভাষায় প্যারাফিলিয়া বা অস্বাভবিক ধরণের যৌনাসক্তির পর্যায়েই ধরা হয়। কানাডার টরেন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও প্রখ্যাত ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ ও মনস্তাত্ত্বিক স্টিফেন হাকার। তিনি নেক্রোফিলিয়ার নানা বিষয় সম্পর্কে বলেন, মৃতদেহের প্রতি উত্তেজনা অনুভব করে যৌনক্রিয়ায় আকৃষ্ট হলে তাকে নেক্রোফিলিয়া বলা হয়।
তার মতে, এটা হতে পারে ফ্যান্টাসি বা কল্পনাতে যার সাধারণত কোনো ক্রিয়াগত দিক থাকেনা। কিংবা বাস্তবেও এটি হতে পারে যার ফলাফল অনেক ভয়াবহ। তিনি বাস্তবে এর উদাহরণ হিসেবে বলেছেন মৃতদেহকে আলিঙ্গন করা, চুমু খাওয়া বা সরাসরি মৃতদেহের সঙ্গে মিলিত হওয়া কিংবা পৈশাচিক অর্গ্যাজমিক কিছু বিষয়ের কথা।
স্টিফেন হাকার তার গবেষণা প্রবন্ধে উল্লেখ করেন, এই জঘন্য আসক্তির কারণে আসক্ত ব্যক্তি মৃতদেহের সঙ্গে উদ্ভট ও ন্যক্কারজনক কিছু কাজ করতে পারে যেমন শবদেহের অঙ্গহানি, রক্তপান, মাংস আহার প্রভৃতি।
পরিশেষে নেক্রোফিলিক হোমিসাইড এর মতো নরহত্যার মারাত্মক ঘটনাও ঘটতে দেখা গেছে। যদিও মনে করা হয় এই ধরণের আসক্তরা তাদের কাজ সারার জন্য মৃতদেহকেই বেছে নেয়। তারা হত্যার মতো ঝুঁকি নেয় না। তবে ডা. জোনাথন রসম্যান ও ডা. ফিলিপ রেসনিক একটু ভিন্নমত দিয়েছেন।
তারা দেখাতে চেষ্টা করেছেন, নেক্রোফিলিয়ায় আক্রান্ত রোগী যে শুধু শবদেহের সঙ্গে যৌনক্রিয়া সম্পাদন করে তা নয়। অনেক সময় সে এই হীন উদ্দেশ্যে ভিকটিমকে হত্যা পর্যন্ত করতে দ্বিধা করে না।
পরিসংখ্যানে দেখা যায়, নেক্রোফিলিয়ায় আক্রান্ত এই সব বিকারগ্রস্তদের সিংহভাগই পুরুষ। এদের বয়স ২০ বছর থেকে ৫০ বছর পর্যন্ত। ডা. জোনাথন রসম্যান ও ডা. ফিলিপ রেসনিক তিন প্রকারের নেক্রোফিলিয়া রোগীর উল্লেখ করেছেন।
-
নেক্রোফিলিয়া হোমিসাইড
নেক্রোফাইলদের মধ্যে এরাই সবচেয়ে ভয়ঙ্কর।এরা নেক্রোফিলিয়াতে এতো পরিমাণ আসক্ত হয়ে পড়ে যে এরা খুন করে তারপর যৌনাচার করে।এমন নেক্রোফাইলদের মধ্যে সবচেয়ে বড় উদাহরণ হলো আমেরিকার টেড বান্ডি।তার জীবনের উপর একটি মুভিও নির্মিত হয়েছে।তার স্বীকারোক্তি অনুযায়ী সে ৩০ জনকে খুন করেছে তবে এর সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে।তার প্রথম শিকার ছিল লিনাট কালভার নামে ১২ বছরের একটি শিশু.১৯৮৯ সালে সে ধরা পড়ে।তবে এমন রোগীর সংখ্যা খুব-ই কম।
-
রেগুলার নেক্রোফিলিয়া
যারা বেশি মরদেহের কাছে থাকেন তাদের এমন নেক্রোফিলিয়া হওয়ার আশংকা বেশি।এমন নেক্রোফাইলদের সংখ্যা-ই বেশি।এমন নেক্রোফাইলদের মধ্যে মর্গের ডোম,ডাক্তার, লাশ দাফনকারী বেশি।
-
নেক্রোফিলিক ফ্যান্টাসি
এমন নেক্রোফাইলরা সরাসরি মরদেহের সাথে যৌনাচার করে না।এরা মূলত কল্পনায় মৃতদেহ কে নিয়ে নানারকম ফ্যান্টাসি করে।
বিশ্ব কাঁপানো এমন সব ঘটনার জন্য ইতিহাস ঘাঁটতে হবে না। ২০১০ সালে ফিলিপাইনের জামবোয়াগনা শহরে কবরস্থান থেকে একে একে বেশ কিছু লাশ চুরি হতে থাকে। লাশগুলোর বেশিরভাগই ছিল তরুণীদের। পরে পুলিশ সেসব মৃতদেহ কবরস্থানের পাশের কিছু খুঁটিতে সম্পূর্ণ বিবস্ত্র অবস্থায় ঝুলানো দেখতে পায়। একই সাথে মৃতদেহগুলোর সঙ্গে যৌনক্রিয়া ঘটার চিহ্ন পায় পুলিশ।
কর্তৃপক্ষ এই ঘটনাকে একদল নেক্রোফিলিয়ার কাজ বলে মনে করেন। পরবর্তীকালে এই ঘটনার দায়ে আটক করা হয় সন্দেহভাজন কয়েকজন ব্যক্তিকে। তারা এই অন্যায় স্বীকারও করে নেয়। এদের বেশিরভাগই ছিল মাদকাসক্ত এবং মস্তিষ্ক বিকারগ্রস্ত।
২০১৮ সালের কথা। কামরুজ্জামান সরকার ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব বর্ধমানের কালনার বাসিন্দা। স্ত্রী ও তিন সন্তান নিয়ে ছিল তার পরিবার। তবে সংসারে তার একেবারেই মন ছিল না । তার টার্গেট ছিল নারীরা। ২০১৩ সাল থেকে ১১ জন নারীর উপর হামলা চালিয়েছেন তিনি। এর মধ্যে ৭ জনই খুন হয়েছেন। এলাকায় একের পর এক নারীর উপর হামলা চালিয়ে পুলিশের রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছিলেন তিনি।
শুধু খুন করেই ক্ষান্ত হত না সে। এসব নারীদের খুন করে তাদের সঙ্গে যৌনাচারও করত। ফেরার আগে প্রমাণ হিসেবে নিয়ে যেত মৃতদেহের গায়ের গয়না। ধরা পড়ার পর তার ঘর থেকে পুলিশ উদ্ধার করে অনেক ইমিটেশন গয়না। এতে বোঝা যায় তার দামী দামী সোনাদানার প্রতি অতটাও লোভ ছিলনা। শুধু চিহ্ন হিসেবে মৃতার গায়ের গয়না রেখে দেয়া তার ছিল নেশা।
এসডব্লিউ/এসএস/২০১৩
আপনার মতামত জানানঃ