টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিয়ে শেষ নেই দুশ্চিন্তার। শুরুতে টিকা নিতে মানুষের অনাগ্রহের অন্যতম কারণ ছিল এই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। আবার নতুন করে অ্যাস্ট্রাজেনেকা টিকার সম্ভাব্য এক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া পারদ চড়াচ্ছে দুশ্চিন্তার। সম্প্রতি অ্যাস্ট্রাজেনেকা টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার তালিকায় যুক্তরাজ্যের নিয়ন্ত্রকেরা নতুন একটি রোগ যুক্ত করেছেন; এর ফলে আক্রান্তের পায়ের তালু, হাত এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ প্রভাবিত হবে। তবে শুধু অ্যাস্ট্রাজেনেকা নয়, মডার্না এবং ফাইজারের ক্ষেত্রেও এই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে।
দেশটির মেডিসিনস অ্যান্ড হেলথকেয়ার প্রোডাক্ট রেগুলেটরি এজেন্সি জানিয়েছে, এই রোগ গুলেন ব্যারি সিনড্রোম নামে পরিচিত। এর ফলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায় এবং স্নায়ুকোষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
অটোইমিউন ডিসঅর্ডারে ভোগা অধিকাংশ মানুষই পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ওঠেন, তবে পাঁচজনের মধ্যে একজন হাঁটার অসুবিধার মতো দীর্ঘমেয়াদী সমস্যায় ভুগতে পারেন। এমনকি প্রতি ২০ জনে একজন মারাও যেতে পারেন।
টিকা গ্রহণকারীদের এই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দেয়ার সম্ভাবনাও বাড়ছে প্রতিনিয়ত। ইউরোপিয়ান মেডিসিন এজেন্সির তথ্য অনুসারে, গত মাসে এই সিনড্রোমে আক্রান্তের ৮৩৩টি কেস শনাক্ত হয়েছে। তবে নিয়ন্ত্রকেরা জোর দিয়ে বলছেন, এই টিকার সুবিধাগুলো এখনো ঝুঁকির চেয়ে অনেক বেশি।
সূত্র মতে, সেপ্টেম্বর পর্যন্ত টিকা গ্রহণের পর যুক্তরাজ্যে ৩৯৩ জনের এই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া শনাক্তের কথা জানা যায়। তবে নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি নিশ্চিত নয় যে, এ সংখ্যা স্বাভাবিক সময়ের চাইতে সত্যিই অনেক বেশি নাকি! পাশাপাশি এ সময়ের মধ্যে কতজনের দেহে দীর্ঘমেয়াদী জটিলতা দেখা গেছে তা স্পষ্ট না হলেও, তিনজন ব্রিটিশ নাগরিক মারা গেছেন বলে জানা গেছে।
যুক্তরাজ্যের মেডিসিন অ্যান্ড হেলথ কেয়ার প্রোডাক্টস রেগুলেটরি এজেন্সি (এমএইচআরএ) আরও জানিয়েছে, ফাইজারের টিকা গ্রহণকারী ৪৪ জনের মধ্যেও সিনড্রোমের সম্ভাব্য লক্ষণ দেখা গেছে, যাদের মধ্যে একজন মৃত্যুবরণ করেছে। এমনকি বাদ যায়নি মডার্নাও! মডার্না গ্রহণকারী তিনজন শনাক্ত হয়েছেন বলে শোনা যাচ্ছে।
তবে লন্ডন স্কুল অফ হাইজিন অ্যান্ড ট্রপিক্যাল মেডিসিনের ফার্মাকোপিডেমিওলজিস্ট অধ্যাপক ইয়ান ডগলাস বলেছেন, টিকার সুফল ঝুঁকির চাইতে এখনও অনেক বেশি।
তিনি বলেন, “আমিও টিকা নিয়েছি। আমি বিশ্বাস করি না যে এই সংবাদ টিকার অন্যান্য সুবিধার ক্ষেত্রে কোন ঝুঁকি তৈরি করছে। তবে কেউ যদি কোভিড টিকা পাওয়ার পরপরই গুলেন ব্যারি সিনড্রোমের প্রাথমিক লক্ষণগুলোর কোনটি অনুভব করে থাকেন, তবে তার ক্ষেত্রে দ্রুত চিকিৎসা সহায়তা নেওয়ার জন্য এটি সহায়ক হবে।”
তিনি আরও বলেন, “রোগের লক্ষণের মধ্যে রয়েছে অসাড়তা, দুর্বলতা এবং হাত ও পায়ে ঝিঁঝি ধরার মতো অনুভূতি; যত দিন যায় রোগীর অবস্থা ততোই অবনতির দিকে যেতে থাকে।”
প্রসঙ্গত, এই বছরের শুরুর দিকে, অ্যাস্ট্রাজেনেকা টিকার বিরল পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হিসেবে মস্তিষ্কে রক্ত জমাট বাঁধার কথা খবরে উঠে আসে। আবার ফাইজারের টিকার প্রতিক্রিয়া হিসেবে হার্টের প্রদাহ বা মায়োকার্ডাইটিসের বিরল সংক্রমণের কথা বলা হয়। ভয়ের কথা হলো, তরুণদের মধ্যে এসবে আক্রান্তের প্রবণতা সবচেয়ে বেশি।
অন্যদিকে ইউএস ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন জুলাই মাসে জনসন অ্যান্ড জনসনের টিকার সাথেও গুলেন ব্যারি সিনড্রোমে আক্রান্তের ‘বর্ধিত ঝুঁকি’ সম্পর্কে সতর্ক করে।
স্বাস্থ্য নিয়ন্ত্রকেরা অ্যাস্ট্রাজেনেকার সাথে মস্তিষ্কে বিরল রক্ত জমাট বাঁধার যোগসূত্র পেলে, তা নিয়ে বিশ্বব্যাপীই নানা আলোড়নের সৃষ্টি হয়; অনেক দেশ সাময়িকভাবে অ্যাস্ট্রাজেনেকার ডোজ প্রদান স্থগিত ঘোষণা করে। ব্রিটেনের ভ্যাকসিন উপদেষ্টা বিষয়ক যৌথ কমিটি সুপারিশ করে যে, ৪০ বছরের কম বয়সীদের এই টিকার বিকল্প ডোজ দেওয়া হবে।
অপরদিকে অন্য আরেক সমীক্ষায় দেখা গেছে, অ্যাস্ট্রাজেনেকার ডোজ গ্রহণকারীদের তুলনায় আক্রান্তদের মধ্যে বিরল রক্ত জমাট বাঁধার ঝুঁকি ‘অনেক বেশি’। এদিকে অক্সফোর্ডের পরিচালিত এ পর্যন্ত অন্যতম বৃহৎ এক গবেষণায় গবেষকেরা ইংল্যান্ডের ২৯ মিলিয়ন মানুষের মেডিকেল রেকর্ড চেক করে দেখেছেন। এদের সবাই হয় এপ্রিলের মধ্যে করোনা পজেটিভ শনাক্ত হয়েছিলেন অথবা করোনা প্রতিরোধী টিকা নিয়েছিলেন।
সেখানে উঠে আসে, যারা কোভিড শনাক্ত হয়েছিলেন, তাদের মধ্যে প্রতি ১০ মিলিয়নে ১২ হাজার ৬১৪ জনের শিরাতে রক্ত জমাট বাঁধে। অথচ যারা অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা নিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে এই হার উল্লেখযোগ্যভাবে কম, প্রতি ১০ মিলিয়নে ৬৬ জন।
ফাইজারের টিকার সাথে এই গবেষণায় গবেষকেরা টিকা এবং জমাট বাঁধার জটিলতার মধ্যে কোনো সংযোগ খুঁজে পাননি। এক্ষেত্রে উল্লেখ্য, ফাইজার এবং অ্যাস্ট্রাজেনেকা উভয় টিকার জন্য ভিন্ন প্রযুক্তি ব্যবহৃত হয়।
এসডব্লিউ/এসএস/১৮২৫
আপনার মতামত জানানঃ