করোনা (কোভিড-১৯) ঠেকাতে শিগগিরই বাজারে আসছে ট্যাবলেট। মেরেক ও তার সহযোগী প্রতিষ্ঠান রিজব্যাক বায়োথেরাপিউটিকসের মুখে খাওয়া মলনুপিরাভির ওষুধ হাসপাতালে ভর্তি ও মৃত্যুঝুঁকি অর্ধেকে আনবে, এমন আভাস দিয়েছেন গবেষকরা। ট্রায়ালের অন্তর্বর্তী অবস্থায় এরই মধ্যে প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে যোগাযোগ করছে বিভিন্ন দেশ। কোভিডের বিরুদ্ধে সর্বশেষ অস্ত্র, অ্যান্টিভাইরাল ক্যাপসুল ‘মলনুপিরাভির’ এখনো অনুমোদন না পেলেও ইতোমধ্যেই এশীয় দেশগুলো এই ক্যাপসুলের জন্য বুকিং দেওয়া শুরু করেছে।
করোনার চিকিৎসায় তৈরি হওয়া অ্যান্টিভাইরাল ট্যাবলেট ‘মলনুপিরাভির’ কিনতে যাচ্ছে এশিয়ার দেশ থাইল্যান্ড। এর দুই লাখ কোর্স কিনতে ইতোমধ্যে কোম্পানির কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা চূড়ান্ত পর্যায়ে থাইল্যান্ড।
ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে থাইল্যান্ডের জাতীয় চিকিৎসা সেবা বিভাগের মহাপরিচালক সোমসাক আক্কস্লিপ জানিয়েছেন, সরকারের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে আগাম বুকিং দেওয়া হয়েছে।
এদিকে এশিয়ার তাইওয়ান ও মালয়েশিয়ার কর্তৃপক্ষ বলছে, তারা কোভিড প্রতিরোধে তৈরি মুখে খাওয়ার ট্যাবলেট কিনতে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে মার্কিন ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে। আর ফিলিপাইন এই পিলটি তার দেশে ট্রায়াল শুরু করেছে। দেশটির সংশ্লিষ্টরা আশাবাদী, ঘরোয়া চিকিৎসায় সুযোগ তৈরি হবে।
এশিয়ার একাধিক দেশ করোনা চিকিৎসার জন্য এই ওষুধ ক্রয়ে আগাম দরদাম করছে। এক বিবৃতিতে মেরেক-এর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ২০২১ সাল শেষ হওয়ার আগেই ১ কোটি কোর্স পিল প্রস্তুত করবে কোম্পানি। তার মধ্যে ১০ লাখ ৭০ হাজার কোর্স পিল যুক্তরাষ্ট্রে সরবরাহ করতে ইতোমধ্যে মার্কিন সরকারের সঙ্গে চুক্তি করা হয়েছে। প্রতি কোর্স পিলের দাম পড়বে ৭০০ ডলার।
ওষুধ প্রতিষ্ঠানটির সংশ্লিষ্টদের দাবি, তাদের তৈরি ওষুধ মলনুপিরাভির মারাত্মক ঝুঁকিতে থাকা করোনা রোগীদের হাসপাতালে ভর্তি হওয়া কিংবা গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ার হার ৫০ শতাংশ কমাতে সক্ষম।
এই ক্যাপসুলটি তৈরি করছে মার্কিন ওষুধ নির্মাতা প্রতিষ্ঠান মেরেক। ওষুধটির জরুরি ব্যবহারের জন্য অনুমোদন চেয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (এফডিএ) কাছে আবেদন করেছে কোম্পানিটি। অনুমোদন পেলে মলনুপিরাভিরই হবে করোনা চিকিৎসায় প্রথম খাওয়ার ওষুধ।
নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া এবং দক্ষিণ কোরিয়াসহ এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের অন্তত আটটি দেশ ইতোমধ্যে ওষুধটি কিনতে চুক্তি করেছে বা আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। এই রাষ্ট্রদের প্রায় সবাই টিকার দৌড়ে তুলনামূলকভাবে দেরিতে মাঠে নেমেছিল।
নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া এবং দক্ষিণ কোরিয়াসহ এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের অন্তত আটটি দেশ ইতোমধ্যে ওষুধটি কিনতে চুক্তি করেছে বা আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। এই রাষ্ট্রদের প্রায় সবাই টিকার দৌড়ে তুলনামূলকভাবে দেরিতে মাঠে নেমেছিল।
বিশেষজ্ঞরা এই ক্যাপসুলের অগ্রগতি ‘আশাব্যঞ্জক’ বলে উল্লেখ করলেও এখনো টিকাই করোনা থেকে সর্বোচ্চ সুরক্ষা দেবে বলে জানিয়েছেন তারা।
এয়ারফিনিটির তথ্য অনুসারে, এখন পর্যন্ত ১০টি দেশ এই ক্যাপসুলের জন্য আলোচনা চালিয়েছে বা চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। এদের মধ্যে আটটিই এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের।
এ দেশগুলোর মধ্যে কেউ কেউ তাদের অতীতের ভুল এড়ানোর চেষ্টা করছে। সেবার দেরিতে অর্ডার দেওয়ার জন্য এসব দেশে টিকা বিতরণ বিলম্বিত হয়েছিল।
সংক্রামক রোগের চিকিৎসক এবং অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি মেডিকেল স্কুলের মেডিসিনের সহযোগী অধ্যাপক সঞ্জয় সেনানায়েকে বলেন, আমার কাছে মনে হচ্ছে আমরা কেবল এটা নিশ্চিত করতে চাচ্ছি যে (কোভিড চিকিৎসায়) নতুন কিছু আসলে আমরা যেন এবার এগিয়ে থাকি। এখানে কিছু মধ্যম আয়ের দেশ আছে যারা গতবারের মতো একই ফাঁদে না পড়ার চেষ্টা করছে, যখন উচ্চ আয়ের দেশগুলোই সমস্ত টিকা জমা করে রেখেছিল।
ওষুধটির উৎপাদন প্রক্রিয়া সহজ হলেও মেরেক এর পূর্ণ পেটেন্ট নিয়ন্ত্রণ করে এবং কোন দেশে, কী মূল্যে ওষুধ সরবরাহ করা হবে, তার সবই নির্ধারণ করবে তারা।
তবে বিশ্বব্যাপী অনেক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞই এই ব্যাপারে পেটেন্ট-সম্পর্কিত বিধিনিষেধ মওকুফের আহ্বান জানিয়ে আসছেন, যাতে করে বিশ্বের সব দেশই এ ওষুধ তৈরি ও সংরক্ষণ করতে পারে। এই এক সিদ্ধান্তই করোনায় মৃত্যুর সংখ্যা অনেকটুকু কমিয়ে আনতে পারে।
এর আগে, করোনার টিকা বাজারে আসার পরও অনেকে টিকার পেটেন্ট-সম্পর্কিত বিধিনিষেধ মওকুফের জন্য অনুরোধ করেছিল। কিন্তু যুক্তরাজ্যসহ কয়েকটি উচ্চ-বিত্ত রাষ্ট্র সেই অনুরোধকে নাকচ করে দিয়েছিল।
সেনানায়েকে জানান, আবারও ধনী দেশগুলো তাদের ন্যায্য অংশের চেয়ে বেশি পাবে বলে আশঙ্কা করছেন তিনি।
তিনি বলেন, কোভিডের ক্ষেত্রে আপনাকে স্বার্থপর হওয়ার জন্য হলেও নিঃস্বার্থ হতে হবে। অন্যথায়, আপনি যদি শুধু আপনার নিজের ছোট্ট অঞ্চল, নিজের ছোট্ট দেশটিকে সুরক্ষিত রাখেন, তাহলে অন্য কোনো দেশ থেকে (কোভিডের) নতুন ধরণ বেরিয়ে আসতে পারে যা থেকে টিকাও রক্ষা করতে পারবে না আপনাকে।
কোভিডের মুখে খাওয়ার ওষুধ নিয়ে ইতোমধ্যেই গবেষণা চলছে। টিকা প্রস্তুতকারী সংস্থা ফাইজারও এই রকম একটি ওষুধ নিয়ে গবেষণা চালাচ্ছে বলে দাবি করেন কার্ল ডাইফেনবাক। নজরে রয়েছে রসে ও অ্যাটিয়া ফার্মাসিউটিক্যালসের একটি ট্যাবলেটও। ওই বিশেষজ্ঞরা দাবি করছেন, পরীক্ষার স্তর পেরোলে ও ছাড়পত্র মিললেই বাজারে আসবে এই ওষুধ। শরীরে কোভিড ধরা পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই এই ধরনের ওষুধ খাওয়া শুরু করে দেওয়া যেতে পারে। এতে উপসর্গ বড় আকার নিতে পারে না। উত্তর ক্যারোলাইনা চ্যাপেল হিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরোলজিস্ট টিমোথি সিয়াহান বলেন, শুধু নিজেকে সুস্থ করে তোলাই নয়, অন্যের শরীরে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়া রুখতেও কার্যকরী হয়ে উঠতে পারে এই ওষুধ।
রেমডেসিভিরের প্রাক-ক্লিনিক্যাল গবেষণার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন সিয়াহান। তিনি বলেন, ইঁদুরের শরীরে মোলনুপিরাভির প্রয়োগ করে দেখা গেছে, সার্স-কোভ-২ প্রজাতি রুখে দিচ্ছে ওই ওষুধ। পরে ওই পদ্ধতিতেই ট্যাবলেট তৈরি করা শুরু করে মেরেক ও রিজব্যাক। ২০২ জন ব্যক্তির ওপর ওই ওষুধ প্রয়োগ করে দেখা গেছে, শরীরে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়া অনেকটাই কমে যাচ্ছে ওই ওষুধ প্রয়োগের পর।
সেপ্টেম্বরের শুরুতেই ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের শেষ পর্যায়ের গবেষণা শুরু করেছে ফাইজার। দ্বিতীয় পর্যায়ের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের প্রতিবেদন শিগগির হাতে আসবে বলে জানিয়েছে ওষুধ প্রস্তুতকারী সংস্থা অ্যাটিয়াও।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪২৭
আপনার মতামত জানানঃ