সম্প্রতি পূজা মণ্ডপে কোরআন অবমাননাকে ঘিরে ঘটে গেল নারকীয় ঘটনা। বাংলাদেশের সংখ্যালঘু হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের উপর কয়েকদিন ধরে তাণ্ডব চালায় দেশটির মুসলিম উগ্রবাদীরা। যদিও গতকাল কুমিল্লার ওই অঞ্চলের সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, কোনও হিন্দু নয়; কোরআন অবমাননার কাজটা করছিলেন ইসলাম ধর্মাবলম্বী একজন, নাম ইকবাল। ঘটনাটি যিনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল করেছিলেন, উনিও মুসলিম। হামলাও চালিয়েছেন মুসলিমরা। শাহবাগে আন্দোলন করছেন মুসলিমরা। হিন্দুরা শুধু ভুক্তভোগী।
অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের এই চেহারা আজকের নয়। ধর্মের নামে সংখ্যালঘুরা দেশটিতে বারবার অত্যাচারিত হয়েছে। তাদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয়ক হয়েছে। হত্যা করা হয়েছে। ধর্ষণ করা হয়েছে। জোর করে দখল করা হয়েছে জায়গা জমি। অথচ আক্রমণকারীদের সাজা হয়নি। প্রসঙ্গত, ফেইসবুকে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে মন্দিরসহ হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে হামলা-ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় প্রায় পাঁচ বছর চলে গেলেও শেষ হয়নি তদন্ত। ফেইসবুকে রসরাজ দাস নামে এক তরুণের আইডি থেকে ধর্ম অবমাননাকর ছবি পোস্টের জেরে ২০১৬ সালের ৩০ অক্টোবর নাসিরনগর উপজেলা সদরে হিন্দুদের ১৫টি মন্দির ও অর্ধশতাধিক ঘর-বাড়িতে হামলা, ভাঙচুর ও আগুন দেওয়া হয়। এসব ঘটনায় নাসিরনগর থানায় আটটি মামলা হয় সে সময়। অথচ অভিযুক্ত রসরাজ জানেনই না ফেসবুক কী জিনিস।
মূলত ১৯৭১ সালের কয়েক বছরের মধ্যেই ধর্মনিরপেক্ষতা নীতি ক্রমেই দুর্বল হতে শুরু করে দেশটিতে। ১৯৭৪ সালে লাহোরে অনুষ্ঠিত ইসলামিক রাষ্ট্রসংস্থার সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের যোগদান থেকেই এই প্রক্রিয়ার সূচনা। কিন্তু এক্ষেত্রে প্রথম মৌলিক পরিবর্তন ঘটে সামরিক বাহিনীর প্রধান এবং পরবর্তীতে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের শাসনামলে (১৯৭৭-১৯৮১), যখন বাংলাদেশের সংবিধানে কোরআনের বাণী ‘বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম’ সংযোজন করা হয় এবং সকল রাষ্ট্রীয় কার্যের শুরুতেই এই বাণী পাঠের বিধান চালু হয়।
জিয়াউর রহমানের ইসলামী ব্যবস্থা আরও এগিয়ে যায় যখন সামরিক শাসিত বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ১৯৮৮ সালে একটি সাংবিধানিক সংশোধনীর মাধ্যমে ইসলামকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করেন। এই ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশে মুসলমান কর্তৃক হিন্দুসহ অন্যান্য সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীর উপর পীড়ন মাত্রা তীব্রতর হয়। ভারতের উত্তর প্রদেশের অযোধ্যার ‘রাম মন্দির’ বিতর্ককে কেন্দ্র করে ১৯৮৯ সালে একটি হিন্দু বিরোধী প্রোগ্রাম শুরু হয় যার ফলশ্রুতিতে অত্যন্ত বৃহৎ পরিসরে হিন্দুদের মন্দির ধ্বংস ও হিন্দুদের উপর নির্যাতন শুরু হয়।
এরপর ১৯৯০ সালের ২৯ অক্টোবর, বাংলাদেশের ইসলামী রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামী অর্থায়িত সংবাদপত্র ‘দৈনিক ইনকিলাবের’ শিরোনাম ছাপায় ‘বাবরী মসজিদ ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে’। ভারতের অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ ধ্বংস করার এই খবরে বাংলাদেশি মুসলমান ও হিন্দু সম্প্রদায়ের মাঝে শুরু হয় দাঙ্গা। হিন্দুদের উপর ৩০ অক্টোবর থেকে হামলা শুরু হয় এবং বিরতিহীন ভাবে ২ নভেম্বর পর্যন্ত তা চলতে থাকে।
এছাড়া এই ঘটনার সূত্র ধরে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত সমগ্র বংলাদেশ জুড়ে হিন্দুদের উপর বিরামহীন অত্যাচার, নির্যাতন, লুটপাট, হত্যা, ধর্ষণ, অপহরণের মত জঘন্য নিষ্ঠুরতা চালাতে থাকে মুসলিমরা। বিশেষ করে ১৯৯২ সালের পুরোটা সময় ধরে এই বীভৎসতার মাত্রা ছিল বর্ণনাতীত।
৩০ অক্টোবর, বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ তার বাসভবন বঙ্গভবনে যখন একটি যুব সম্মেলনে ভাষণ প্রদান করছিলেন ঠিক তখনও বঙ্গভবনের দক্ষিণে অবস্থিত একটি গৌড়ীয় মঠে আগুন ধরিয়ে দেয় সশস্ত্র মুসলিমরা এবং হিন্দু মালিকানাধীন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে নির্বিচারে লুটপাট ও হামলা চালায় তারা।
ঢাকার লালবাগে অবস্থিত বাংলাদেশের জাতীয় মন্দির ঢাকেশ্বরী মন্দিরসহ তৎসংলগ্ন অন্যান্য ভবনগুলোতে মুসলিমরা লুটপাট চালায় এবং অগ্নি সংযোগ করে। মন্দিরের পুরোহিত এবং আরও দশটি হিন্দু পরিবারের উপর চালানো হয় বর্বর পৈশাচিক নির্যাতন। চার ঘণ্টা জুড়ে বাধাহীন ভাবে এই নিষ্ঠুরতা চলতে থাকে। লালবাগের একটি দুর্গা মন্দির, পুস্পরাজ সাহা লেনের গিরিগোবর্ধন জিউ মন্দির, হরনাথ ঘোষ লেনের রঘুনাথ জিউ আখড়া,কামরাঙ্গিচর শ্মশান সহ অসংখ্য হিন্দু উপাসনালয় লুটপাট ও ধ্বংস করে মুসলিমরা।
হাজারীবাগের ভাগলপুর লেনের তিনটি হিন্দু মন্দির লুটপাট ও ভাংচুর করা হয়। বেলতলী লেনে ১৭ জন নিরীহ হিন্দুকে কুপিয়ে জখম করে তারা। নগর বেলতলী এবং হাজারীবাগে কমপক্ষে ১০০ টি হিন্দু বাড়ি-ঘর,ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান লুটপাট করে স্থানীয় মুসলিমরা এবং এক ডজনেরও বেশি হিন্দু মন্দির ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করে তারা। সুত্রাপুরে প্রত্যেকটি হিন্দু বাড়ি,ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান লুটপাট, ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করে তারা। ১০০ টিরও বেশি বাড়িঘর ও দোকানপাটে লুটপাট চালানো হয় এবং সবগুলো ক্ষেত্রে লুটপাটের পরে আগুন ধরিয়ে দেয়া হত।
চট্টগ্রামে তখন প্রায় ৩০% হিন্দুর বসবাস ছিল। সেখানে বিভিন্ন রাস্তায় মুসলিমরা স্লোগান সহকারে মিছিল বের করলে, পুলিশ ফাঁকা গুলি করে তাদের ছত্রভঙ্গ করে এবং সান্ধ্য আইন জারি হয়। কিন্তু ৩০ অক্টোবর মধ্যরাতের পরে প্রায় ২,০০০ মুসলিম ছুরি, লোহার রড, রাম দা, খোন্তা সহ বিভিন্ন ধরনের মারণাস্ত্রসহ কৈবল্যধাম মন্দিরের চারপাশের প্রায় ৩০০ হিন্দু বাড়িঘরের উপর উন্মত্তভাবে হামলে পড়ে এবং আগুন ধরিয়ে দেয়। আগুন নেভাতে অগ্নিনির্বাপক কর্মীরা যখন সেখানে প্রবেশ করতে চাইলে, স্থানীয় মুসলিমরা তাদেরকে প্রবেশ করতে বাধা দেয়।
মধ্যরাতে মুসলিমদের ভয়াবহ আক্রমণে চকবাজারের প্রায় ১,৫০০ হিন্দু জেলে পরিবার তাদের বাড়ি-ঘর ছেড়ে জীবন বাঁচাতে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। প্রায় ২০০ মুসলিম রিয়াজউদ্দিন বাজারের হিন্দু মন্দির ভেঙ্গে ফেলে এবং হিন্দু মালিকানাধীন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো লুটপাট করে। মুসলিমরা চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজেও অগ্নিসংযোগ করে। ৫০ টি জেলে পরিবারের খড়ের ঘরে আগুন লাগিয়ে ভস্মীভূত করে দেয়। একটি হিন্দু মালিকানাধীন গ্যারেজে আক্রমণ করে পাঁচটি গাড়ি লুট করে নিয়ে যায়।
৩১ অক্টোবর সকালে প্রায় ১০০ মুসলিম জনতার একটি দল কার্ফু ভঙ্গ করে একটি হিন্দু মন্দিরে হামলা করে সেটি অপবিত্র করে। ২ নভেম্বর শুক্রবারে জুম্মার নামাজের জন্য কার্ফু কিছুটা শিথিল করা হয়। কিন্তু এই সুযোগে প্রায় ৫০০ মুসলিমের একটি দল ছুরি, রাম দা, লাঠি, লোহার রড এবং ঘরে তৈরি বোমা নিয়ে শহরতলীর একটি মন্দিরে আক্রমণ করে। পাথরগঞ্জ, বোয়ালখালী, আনোয়ারা, হাটহাজারীতে প্রায় ১০০ হিন্দু মুসলিমদের আক্রমণে আহত হয়।
বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা ছাড়াও কমপক্ষে ১২ টি শহরের হিন্দুরা সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের শিকার হয়ে। যশোর, নড়াইল, গাইবান্ধা, ময়মনসিংহ, সুনামগঞ্জ, সিলেটের হিন্দুদের উপর মারাত্মক নির্যাতনের সংবাদ দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
১৯৯০ সালের হিন্দু নিধন প্রোগ্রাম ছিল বাবরী মসজিদধ্বংসের প্রতিবাদে বাংলাদেশের মুসলিম জনগোষ্ঠীর বিদ্রোহ। এই ঘটনার সূত্রপাত ১৯৯০ সালে হলেও ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত এর ধারাবাহিকতা চলতে থাকে। ১৯৯০ ও ১৯৯২ সালে বাংলাদেশের জাতীয় মন্দির ঢাকেশ্বরী মন্দির আক্রান্ত হয়। ১৯৯২ সালে চার জাতির সার্ক ক্রিকেট টুর্নামেন্ট শেষ পর্যন্ত সম্পন্ন করতে পারেনি আয়োজক হিসেবে বাংলাদেশ।
১৯৯০ ও ১৯৯২ সালের সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের শিকার হয়ে ভোলা জেলার হাজার হাজার হিন্দু বাস্তুচ্যুত হয় এবং পালিয়ে চলে যায়। ফলে হিন্দু অধ্যুষিত ভোলা জেলা প্রায় হিন্দুশূন্য বর্তমানে। সারা দেশ ব্যাপী অনেক হিন্দু জীবনের নিরাপত্তার জন্য তাদের জায়গা,সম্পত্তি,বাড়ি-ঘর ছেড়ে ভারতে আশ্রয়ের জন্য পালিয়ে চলে যায়।
এসডব্লিউ/এসএস/১৩৩২
আপনার মতামত জানানঃ