কান্ডারি হুঁশিয়ার
ভারতের রাম মন্দির উদ্বোধনের ঘটনা নিয়ে বাকি বিশ্বের মুসলমানেরা তত বিরক্ত নয় যতটা বিরক্ত বাংলাদেশের মুসলমানেরা। মৌলবাদী মুসলমান তো রাম মন্দির ইস্যুতে সারাক্ষণ লাফাচ্ছেই, তাদের সাথে পাল্লা দিয়ে নিজেকে প্রগতিশীল বলে দাবী করা মুসলমানেরাও পুরো বিষয়টা নিয়ে সমানে বিষ উগলে দিয়ে যাচ্ছে। তারা এমন একটা বয়ান তৈরি করেছে যার সার কথা হচ্ছে, বাবরি মসজিদ বনাম রাম মন্দির গোলযোগটা আসলে বিজেপি/ আরএসএস তাদের নিজের রাজনৈতিক ফায়দার জন্য তৈরি করেছে। এর আগে এ বিষয় নিয়ে কোথাও কোন সমস্যা ছিল না, বিজেপি/ আরএসএসই যত নষ্টের গোড়া। তাই মসজিদ ভেঙে মন্দির নির্মাণের এই ঘটনাকে সমর্থন করা মানে বিজেপিকেই শক্তিশালী করা ও তাদের হয়ে দালালি করা। আসলেই কি তাই?
এই বিষয়টা বুঝার জন্য আমি দুইটা প্রশ্ন পাঠকের সামনে হাজির করব। প্রথম প্রশ্ন হচ্ছে, বহিরাগত মুসলমান শাসকরা তো আরও অনেক মন্দিরকেই ভেঙেছে, লুটপাট করেছে, অনেক জায়গাতেই মন্দির ভেঙে মসজিদ নির্মাণ করেছে তাহলে সেগুলো নিয়ে খুব একটা হৈ চৈ নেই কিন্তু রাম মন্দির নিয়ে এত ঘটনা ঘটছে কেন? এর উত্তরটা পেতে হলে পাঠককে জানতে হবে ভারতের একটা বিরাট সংখ্যক সনাতন ধর্মাবলম্বী জনগণের মনে ভগবান বিষ্ণুর সপ্তম অবতার রামকে নিয়ে ব্যাপক শ্রদ্ধা ও আবেগ কাজ করে। এই বিষয়টা বাঙালি হিন্দুদের দেখে বুঝা যাবে না। বাঙালি হিন্দুদের ঘরে যদি আপনি যান তাহলে সেখানে শ্রী কৃষ্ণের ছবি/ মুর্তি দেখতে পাবেন কিংবা মা কালী অথবা মহাদেব শিবের ছবি দেখতে পাবেন। রাম সীতার ছবি ঘরে রাখা বা উপাসনা করা বাঙালি হিন্দুদের মধ্যে খুব একটা চর্চিত নয়। তার মানে এই না যে রামকে তারা ভগবানের অবতার হিসেবে মানে না। আমি বলছি শুধু ধর্ম চর্চার প্রধান ধারার কথা। ভারতের উত্তর অংশে বিষয়টা পুরোপুরি অন্যরকম। সেখানে রামই প্রধান আরাধ্য। রামনামকে তারা জীবনের সকল ক্ষেত্রে একেবারে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নিয়েছেন। পরষ্পরের সাথে দেখা হলে তারা সম্বোধন জানাতে “জয় সিয়ারাম” কিংবা “রাম রাম” শব্দদুটি উচ্চারণ করে। যখন মৃত ব্যক্তিকে শ্মশানে নিয়ে যায়, তখন রাস্তা দিয়ে “রাম নাম সত্য হ্যায়” বাক্যটি জপতে জপতে যায়। এদের বাড়িতে রামের ছবি মুর্তি তো থাকেই এমনকি পাড়া মহল্লা কিংবা নগরের গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলিতেও রাম মন্দির স্থাপন করে এবং নিত্যদিন পূজাপাঠ চালিয়ে যায়।
তাহলে বাবরি মসজিদ নিয়ে কেন তাদের মনে এত দুঃখ? কারণ তারা বিশ্বাস করে, যে মন্দিরকে ভেঙে বাবরি মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছে সেটা তাদের আরাধ্য ইশ্বর রামের জন্মস্থান। ঠিক ঐ জায়গাতেই ভগবান রাম জন্ম গ্রহণ করেছিলেন। এখন এই আলোচনা তুলা বাতুলতা যে, আসলেই কি ঠিক ঐ স্থানটাতে রামের জন্ম হয়েছিল কি না। কেননা, রামের জন্মগাঁথা এত সহস্র বছরের পুরনো যে এই বিষয় নিয়ে কোন বিজ্ঞানভিত্তিক প্রমাণ বা প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপত্য পাওয়া সম্ভব নয়, আর তা জানতে চাওয়া সমীচীনও নয়। মক্কায় যখন মুসলমানেরা হজ্জ করতে গিয়ে শয়তানের স্তম্ভে পাথর ছুড়ে মারে তখন কেউ জানতে চায় না ঐ স্তম্ভে আসলেই শয়তান বিরাজমান রয়েছে কিনা। পাথর ছুড়ে মারলে শয়তান ব্যাথা পায় কিনা। এগুলো এক একটা বিশ্বাস। মানুষ কোন একটা বিষয়ে বিশ্বাস করে, ভালোবাসে, শ্রদ্ধা করে, এটাকেই সভ্য রাষ্ট্রগুলি গুরুত্ব দেয়ার জন্য যথেষ্ট মনে করে এবং মানুষের এই বিশ্বাসের চর্চাকে যথাযথ নিরাপত্তা দেয়ার ব্যবস্থা করে। ভারতের সুপ্রিম কোর্টও এই বিষয়টাকে এভাবেই দেখেছে। যদিও বিপক্ষের উকিল বাবরি মসজিদের ঐ বিশেষ স্থানটাতেই রামের জন্ম হয়েছিল কিনা সে বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন কিন্তু বিচারকরা মানুষের বিশ্বাসকে গুরুত্ব দিয়ে সেই প্রশ্নকে খারিজ করে দিয়ে মসজিদের স্থানে পুর্বে কোন মন্দির ছিল কিনা সেই বিষয়টাকেই গুরুত্ব দিয়েছে।
এখন দ্বিতীয় প্রশ্ন হচ্ছে, এই যে রামমন্দির নিয়ে এত এত ভাংচুর আমরা দেখলাম, এত উন্মাদনা ১৯৯২ সাল থেকে সারা উপমহাদেশে ছড়িয়ে পড়ল এবং এখনো ছড়াচ্ছে তার কি কোন পূর্ব ধারাবাহিকতা আছে নাকি পুরো ব্যাপারটা আসলে বিজেপি/ আরএসএস দ্বারা সৃষ্ট এক রাজনৈতিক চক্রান্ত? এই প্রশ্নের উত্তর দেয়ার আগে আমি কিছু ঘটনার উল্লেখ করব যার লিখিত দালিলিক প্রমাণ রয়েছে এবং যেগুলো আদালতে বিচারের সময় দাখিল করা হয়েছে।
মসজিদ মন্দির বিতর্কের প্রথম লিখিত দলিল খুঁজে পাওয়া যায় ইউরোপিয়ান খৃস্টান মিশনারি এবং ভূতত্ব বিশারদ জোসেফ টিফেন্থালের বই, “Description Historiqueet Geographique Del‘inde” তে। তিনি ১৭৪৩ থেকে ১৭৮৫ সাল পর্যন্ত ভারত ভ্রমণ করেন এবং ভারত ভ্রমণ সংক্রান্ত এই বইখানা লিখেন। এই বইতে অযোধ্যা ও রাম মন্দির নিয়ে অনেক বিষয় জানা যায়। এই বইটি ল্যাটিন ভাষায় লিখিত হয়েছিল, পরে তা ভারতের উচ্চ আদালতের নির্দেশে ইংরেজিতে অনুবাদ করা হয়। সেই বইতে তিনি বাবরি মসজিদের ভেতর এবং বাইরের বেশ বিস্তারিত বর্ণনা দেন। তার লেখাতে তিনি জানিয়েছেন মসজিদের একটা অংশের নাম সীতা রসুই, আরেকটা অংশের নাম বেদি। সেই মন্দিরের পিলারগুলি দেবতা হনুমানের দ্বারা সুদূর শ্রীলঙ্কা থেকে নিয়ে এসে স্থাপিত করা হয়েছে, এমনটা বিশ্বাস জনমনে প্রচলিত রয়েছে। তিনি আরও জানিয়েছেন বছরের একটা দিন সেখানে রামের জন্মদিন খুব ঘটা করে পালন করা হয় এবং দূর দুরান্ত থেকে অনেক মানুষ সেখানে সমবেত হন। আরও অনেক কিছুই লেখা আছে মসজিদ মন্দির নিয়ে তৎকালীন সমাজের বিতর্ক নিয়ে। আগ্রহী পাঠকরা চাইলে পড়ে দেখতে পারেন। লিংক কমেন্টে দেয়া থাকবে। (পৃষ্ঠা নং ৬৬৪ – ৬৬৬)
এরপরের দালিলিক তথ্য পাওয়া যায় ১৮৩৮ সালে প্রকাশিত বৃটিশ উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা রবার্ট মন্টেগোমেরি মার্টিনের সার্ভে রিপোর্ট থেকে। কারণ, মন্দির মসজিদ নিয়ে জনগণের মধ্যে মারামারি আর দ্বন্দে সদ্য শাসন ক্ষমতায় যাওয়া বৃটিশ রাজ অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছিল। তাই ঐ মসজিদ আসলেই কোন মন্দির ভেঙ্গে তৈরি হয়েছিল কিনা তা খোঁজার জন্য সার্ভে করার দায়িত্ব দেয়া হয়। তো মার্টিন সাহেব তার রিপোর্টে বলেন যে জায়গায় মসজিদের কথা বলা হচ্ছে সেখানে তার আগে থেকে একটা মন্দির ছিল কিন্তু মসজিদটি মন্দির ভেঙ্গে তৈরি হয়েছিলো নাকি খালি জমিতে তৈরি হয়েছিলো তা তিনি নিশ্চিত করে বলতে পারেন নি। এই ঘটনা থেকে আমরা জানতে পারি মন্দির মসজিদ নিয়ে হিন্দু মুসলমানের মধ্যে ঝামেলা তখনো চলমান ছিল। (পৃষ্ঠা নং ৬৬৯–৬৭১)
এই রিপোর্ট প্রকাশের পর থেকে কিছুদিন পরপরই ছোট বড় লড়াই হতে থাকে হিন্দু মুসলমানে। তবে লড়াইয়ের প্রথম রিপোর্ট সরকারিভাবে রেকর্ড হয় ১৮৫৩ সালে যখন নির্মোহী আখড়ার সাধুরা জোর করে মন্দিরটির দখল নিতে যায়। সেই লড়াই একটানা দুই বছর থেমে থেমে চলতে থাকে। দুই বছরের মাথায় ১৮৫৫ সালে মুসলিমদের নেতা শাহ গোলাম হুসেন রাম মন্দির নিয়ে হিন্দুদের দাবীর পাল্টা দাবী হিসেবে আওয়াজ তুলেন, নির্মোহী আখড়া পরিচালিত হনুমান গড়ি মন্দির আসলে মসজিদ ভেঙে দিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে। এরপর তিনি আনুমানিক ৫০০ জন মুসলমান সহযোদ্ধা নিয়ে মন্দির দখল করতে যান এবং আখড়ার সাধুদের সাথে মারামারিতে পরাজিত হয়ে প্রায় ৭৫ জন মুসলমান মারা যায়। এই তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে সর্বপ্ললী গোপাল রচিত বই “Anatomy of confrontation” তে, যা সুপ্রিম কোর্ট বিবেচনায় নিয়েছে। (পৃষ্ঠা নং ৬৭৫)
একের পর এক দাঙ্গা হাঙ্গামায় ব্যতিব্যস্ত বৃটিশ সরকার সমাধান হিসেবে ১৮৫৭ সালে বাবরি মসজিদের পুরো প্রাঙ্গনের মধ্যিখানে একটা ছয় ফিট উঁচু দেয়াল নির্মাণ করে একভাগ হিন্দুদের পূজা অর্চনার জন্য দেয়া হয়, আরেক ভাগকে মুসলমানদের নামায পড়ার জন্য রেখে দেয়া হয়। বলাই বাহুল্য এই ব্যবস্থায় হিন্দু মুসলমান কেউই খুশি ছিল না কিন্তু বৃটিশদের ডান্ডার ভয়ে মেনে নেয়া ছাড়া উপায়ও ছিল না।
এর এক বছর পরে একটা ইন্টারেস্টিং ঘটনা ঘটে। ১৮৫৮ সালের ২৮ নভেম্বর তারিখে শিখ ধর্মগুরু মহন্ত নিহাং সিং ফকির আরও ২৫ জন সহযোদ্ধা নিয়ে পাঞ্জাব থেকে অযোধ্যা গিয়ে পৌঁছান এবং বাবরি মসজিদের দখল নিয়ে সেখানে যজ্ঞ করা শুরু করেন। তিনি পুরো মসজিদের দেয়াল জুড়ে কয়লা দিয়ে রাম নাম লিখে দেন এবং সেখানে সশস্ত্রভাবে অবস্থান করা শুরু করেন। এই ঘটনাটি নিয়ে অভিযোগ আকারে থানায় দায়ের করেন মসজিদের মুয়াজ্জিন সৈয়দ মুহম্মদ খাতিব সংশ্লিষ্ট থানার দারোগা শীতেল দুবের কাছে। এরপর পুলিশ গিয়ে শিখ যোদ্ধাদের সেখান থেকে বের করে দেয়। উল্লেখ্য যে, রাম শুধু সনাতনীদের কাছে নয় শিখদের কাছেও শ্রদ্ধাস্পদ হিসেবে পূজিত হন, কারণ শিখ ধর্মের প্রথম গুরু নানক তীর্থ দর্শনে অযোদ্ধা গিয়ে সরযু নদীতে স্নান করে পবিত্র হয়েছিলেন এবং ভগবান রামের মন্দির দর্শন করেছিলেন। শিখদের ধর্মীয় বই “গুরু গ্রন্থ সাহিব” এ ঘটনার কথা উল্লেখ আছে। এই পর্যায়ে মন্দির মসজিদ লড়াইয়ে সনাতনীদের সাথে শিখ ধর্মাবলম্বীরাও অফিশিয়ালি যুক্ত হয়ে গেলেন।
সেই ঘটনার ২৫ বছর পরে আবার একটা একটা আলোড়ন তৈরি হয়। ১৮৮৩ সালে মসজিদ প্রাঙ্গনের যে অংশে সনাতনীরা পূজাপাঠ করতেন সেই অংশে পূজারি মহন্ত রঘুবীর দাস একটা মন্দির নির্মাণের জন্য সরকারের কাছে আবেদন করেন। সরকার তার সেই আবেদনে সাড়া না দিলে তিনি এই দাবীতে সরকারের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করে দেন ১৮৮৫ সালে। সেই মামলার রায় হয় ১৮ মার্চ ১৮৮৬ সালে এবং সেই রায়ে ডিস্ট্রিক্ট জজ অত্র এলাকায় শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখতে তার দাবিকে নাকচ করে দেন।
আরেকটা শতাব্দী পেরিয়ে যায়, নতুন শতাব্দীর আগমন হয় কিন্তু হিন্দু মুসলমান উত্তেজনা আর শেষ হয় না। অনেক দিন ধরে ছোট ছোট দাঙ্গা হাঙ্গামা চলতে চলতে ১৯৩৪ সালে এসে সেটা আবার বিশাল আকার নেয়া শুরু করে। অযোধ্যা নগরের মুসলিম অধ্যুষিত এলাকা শাহাজানপুরে মুসলমানরা একদিন একটা গরু জবাই করে(সাধারণত সেই অঞ্চলে গরু জবাই হত না)। সেই গোহত্যার ঘটনায় হিন্দুরা এত উত্তেজিত হয় যে তারা গিয়ে বাবরি মসজিদের দখল নিয়ে ভেঙ্গে দেয়ার জন্য সেখানে হামলা করে বসে। সেই হামলায় মসজিদের এক পাশের দেয়াল এবং উপরের ডোম ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরে অবশ্য বৃটিশ সরকার সেই ভাঙা জায়গা মেরামত করে দেয়। এই ঘটনার পর থেকে মুসলমানরা আস্তে আস্তে মসজিদে নামায পড়া বন্ধ করে দেয়।
এরপরে ভারত স্বাধীন হয়, বৃটিশরা চলে যায়। ১৯৪৯ সালে অখিল ভারতীয় রামায়ন মহাসভার আয়োজনে সেই জায়গায় ৯ দিন ব্যাপী রামচরিত মানসের অনুষ্ঠান চলে। এই অনুষ্ঠানের শেষের দিন ২২ ডিসেম্বর রাতে এক সাধু রাতের বেলা চুপিসারে মসজিদের ভেতর প্রবেশ করে সেখানে রামের মুর্তি রেখে দিয়ে বাইরে প্রচার করেন ভগবান রাম মসজিদের ভেতর আত্ম প্রকাশ করেছেন। ঘটনার পরের দিন হাজার হাজার ভক্তগণ দূর দুরান্ত থেকে সেখানে সমবেত হতে শুরু করেন এবং রামের দর্শন লাভের জন্য উন্মুখ হয়ে পড়েন। এই ঘটনায় সুন্নি ওয়াকফ বোর্ড ১৯৪৯ সালের ২৯ ডিসেম্বর থানায় একটি অভিযোগ দায়ের করেন। আবারো পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠে, যেকোন সময় দাঙ্গা শুরু হয়ে যেতে পারে এই ভয়ে ভারত সরকার মসজিদকে তালাবদ্ধ করে সেখানে সাধারণ মানুষের আসা যাওয়া বন্ধ করে দেয়। ভারতের তৎকালীন প্রধান মন্ত্রী জহর লাল নেহেরু ইউপির মুখ্যমন্ত্রীকে নির্দেশ দেন মসজিদের ভেতর থেকে রামের মুর্তি সরিয়ে দেয়ার জন্য। সেই কাজ সম্পাদনের জন্য আদেশ দেয়া হয় ডেপুটি কমিশনার কে কে নায়ারকে কিন্তু নায়ার সেই আদেশ পালনে অস্বীকার করেন এবং সরকারকে জানান যে এই কান্ড যদি করা হয় তাহলে সেটা আগুন নিয়ে খেলা হবে। হাজার হাজার ভক্তের মাঝখান থেকে কারোরই সাহস হবে না মুর্তিকে সেখান থেকে সরিয়ে নেয়, এমনই ছিল তার বক্তব্য কিন্তু সরকার তার কথা না শুনে পূর্বের আদেশই বলবত রাখে। ফলস্বরুপ কমিশনার নায়ার পদত্যাগ করেন। এই সমস্ত কথাবার্তা লিখিতভাবেই হচ্ছিল এবং এই লিখিত রেকর্ডগুলো কোর্টের কাছে জমা দেয়া হয়েছে।
লেখাটা অনেক বড় হয়ে যাচ্ছে, দাঙ্গা হাঙ্গামার গল্প আমি আর বাড়াবো না। এই প্রসঙ্গ শেষ করি এই কথা বলে যে, বাবরি মসজিদ নাকি রাম মন্দির সেই বিতর্কে স্বাধীন ভারতে প্রথম মামলা হয় ১৯৫০ সালের পাঁচই জানুয়ারি তারিখে স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে। এরপরে বিভিন্ন সময়ে আরও বহু মামলা বহু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে করা হয়। এইসব মামলার চূড়ান্ত রায় দীর্ঘ সত্তর বছরের পথ পরিক্রমা শেষ করে বের হয় ২০১৯ সালের ৯ নভেম্বর। তাহলে এত বিশাল ইতিহাস টানার উদ্দেশ্য কি? উদ্দেশ্য হল পাঠকের কাছে এটা তুলে ধরা যে, বাবরি মসজিদ এবং রাম মন্দির নিয়ে হিন্দু মুসলমানে টানা হ্যাচড়া করা ও রক্তপাত ঘটানো কোন একটা নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের উদ্যোগে নয়, কিংবা গত শতাব্দীর শেষ ভাগ থেকেও নয়, এটা গত পাঁচশ বছর ধরে বিরাজমান একটা জনগ্ণের লড়াই। একদম সাধারণ খেটে খাওয়া জনতা দুই ভাগ হয়ে এই স্থানকে কেন্দ্র করে গত পাঁচশ বছর ধরেই লড়ছে। তাহলে বিজেপির এখানে ভূমিকা কি ছিল?
বিজেপি হল এই লড়াইয়ে একটা পক্ষ নেয়া রাজনৈতিক শক্তি মাত্র। ভারতের সনাতন ধর্মাবলম্বীদের দীর্ঘ দিনের লড়াই থেকে উৎসরিত আবেগকে পুঁজি করে এই রাজনৈতিক শক্তি অতি অল্প সময়ে আশাতীতভাবে ফুলে ফেঁপে উঠে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, অনেকগুলো ছোটবড় রাজনৈতিক দল মিলে বিজেপি যখন প্রথম গঠিত হল ১৯৮০ সালে তখন তাদের আদর্শ ছিল গান্ধীবাদী চিন্তাধারা। সেই আদর্শকে সামনে রেখে ভারতের পার্লামেন্টে তারা মাত্র দুইখানা আসনে জয় লাভ করতে পেরেছিলো। এর পরে তারা গান্ধীবাদী দর্শন থেকে সরে এসে রাম মন্দির ও রাম জন্মভুমিকে উদ্ধার করাকে মূল রাজনৈতিক কর্মসূচি হিসেবে নির্ধারণ করল এবং কট্টর হিন্দুত্ববাদী আদর্শে দলকে শিফট করল। সেই থেকে তাদের অভূতপুর্ব উত্থান হল। ১৯৮৯ সালে যখন তারা দ্বিতীয়বার ইলেকশান করল তখন তারা ৮৬টা আসনে জয়লাভ করল। বুঝাই যায়, ভারতের জনগণ চাইছিল তাদের মনের দুঃখ কেউ বুঝুক। তাদের শত শত বছরের লড়াইয়ে কোন রাজনৈতিক শক্তি শামিল হোক। ভারতীয় জনতা পার্টি বিজেপি সেই সুযোগটাই নিয়েছে। কাজেই বাবরি মসজিদ বনাম রাম মন্দির লড়াইকে কোন একটা রাজনৈতিক দলের এজেন্ডা বললে সেটা আসলে মূল ব্যাপারটাকে আড়ালে লুকিয়ে ফেলা হয় এবং একটা ঐতিহাসিক ঘটনার ব্যাপকতাকে খাটো করে ফেলা হয়।
আদালতে বিচার শেষ হওয়ার পরে যদিও এ ব্যাপারে আর কোন কথা থাকার কথা না। বাংলাদেশের প্রগতিশীল ঘরানার মুসলমান লোকজন যদি এরপরেও বাবরি মসজিদ ভেঙে রাম মন্দির নির্মাণ করার ব্যাপারটার নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে তাহলে উত্তর দেয়ার আগে আমি একটা দৃশ্যকল্প উপস্থাপন করতে চাই। আমি চাই উত্তরটা দেয়ার আগে একটা দৃশ্য কল্পনায় নিয়ে আসুন, দেখুন, ভাবুন তারপর উত্তরটা তৈরি করুন। দৃশ্যটা এরকম, মনে করুন আজকের শক্তিশালী ইজরায়েল রাষ্ট্র আর মুসলমানদের প্রধান তীর্থভূমি সৌদি আরবের মধ্যে একটা রক্তক্ষয়ী লড়াই হল এবং সেই লড়াইয়ে সৌদি আরবকে ইজরায়েল পরাজিত করে মক্কা মদিনার সকল মসজিদ ও কাবা ঘর ভেঙে দিয়ে সেখানে ইহুদীদের প্রার্থনাঘর সিনাগগ নির্মাণ করে ফেললো এবং সেখানে মুসলমানদের বদলে ইহুদিরা নামায পড়তে লাগলো। মুসলমানরা এ নিয়ে বছরের পর বছর, প্রজন্মের পর প্রজন্ম, শতাব্দীর পর শতাব্দী ইহুদিদের বিরুদ্ধে লড়তে লাগলো, যেমন করে লড়েছিল ভারতের হিন্দুরা। এরকম করে লড়ালড়ির পাঁচশ বছর পরে আদালতের মাধ্যমে মুসলমানরা মক্কা মদিনায় তাদের দখল বুঝে পেলো এবং পুনরায় সেখানে কাবাঘর স্থাপন করল এবং মসজিদ নির্মাণ করল। এখন বাঙালি মুসলমান প্রগতিশীলদের কাছে আমার প্রশ্ন, এমতাবস্থায় আপনারা কি ইহুদীদের সিনাগগ ভেঙে মুসলমানদের কাবাঘর পুনঃস্থাপনের কাজকে আপনারা নিন্দা করবেন নাকি স্বাগতম জানাবেন? এই উপলক্ষ্যে সারা পৃথিবীতে আনন্দরত মুসলমানদের আপনারা অমানবিক জুলুমবাজের দোসর ভাববেন নাকি মজলুমের বিজয়োৎসব ভাববেন? তাড়াহুড়ো করে উত্তর দেয়ার দরকার নেই। খুব ঠান্ডা মাথায় ভাবুন, সময় নিয়ে ভাবুন, তারপর মনের গহীন থেকে আপনার উত্তরটা খুঁজে বের করুন।
আপনার মতামত জানানঃ