লাদাখ সীমান্তে এখনও উত্তপ্ত পরিস্থিতি। ভারত-চীন ঠান্ডা যুদ্ধ চলছেই। কেউ এক ইঞ্চি জমি ছাড়তে রাজি নয়। বেইজিং-এর বিরুদ্ধে দফায় দফায় শান্তি চুক্তি ভাঙার অভিযোগ করছে দিল্লি। সীমান্ত সংঘাতের জেরে দুই দেশের মধ্যে সাইবার যুদ্ধও চলছে। গালওয়ানের পরিস্থিতি উত্তপ্ত হওয়ার পরেই শতাধিক চীনা অ্যাপ নিষিদ্ধ করে ভারত। এখন ফের সীমান্তে পরিস্থিতি ঘোরালো হয়ে উঠার পর তথ্য চুরির অভিযোগে চীনা স্মার্টফোন খুলে পরীক্ষা করবে ভারত।
স্মার্টফোনের মাধ্যমে ভারতের নাগরিকদের থেকে চীন তথ্য চুরির চেষ্টা করছে বলে দীর্ঘদিন ধরে সন্দেহ করে আসছে ভারত সরকার। এজন্য একটি আইনও তৈরি করতে চলছে দেশটির কেন্দ্র। নতুন আইনটি পাস হলে সব চীনা স্মার্টফোন খুলে পরীক্ষা করে দেখবে। সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে এ খবর জানা গেছে।
জানা গেছে, স্মার্টফোন পরীক্ষার জন্য বিশ্বাসযোগ্য কিছু কোম্পানির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হওয়ার কথা ভাবছে ভারত। কোনোভাবে চীনের তৈরি স্মার্টফোনের মাধ্যমে দেশটির ওপর নজরদারি চলছে কি না, তা জানার জন্যই মূলত কাজটি করতে চলেছে ভারত সরকার। ভারত-চীন সীমান্তে চীনের আগ্রাসনে মোকাবিলা করতেই এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
প্রথম ধাপে ভারতে টিকটক-সহ ৫৯টি অ্যাপ নিষিদ্ধ করা হয়। পরে দিল্লি জানায়, আরও ২৫০ চীনা অ্যাপ তাদের পর্যবেক্ষণে রয়েছে। পূর্ব লাদাখে ফের ‘চীনের অনুপ্রবেশের চেষ্টা’র পর আরও ১১৮টি অ্যাপ নিষিদ্ধ করে দিল্লি। এবার নিশানায় জনপ্রিয় কয়েকটি চাইনিজ স্মার্টফোন ব্র্যান্ড। তালিকায় রয়েছে শাওমি, অপ্পো, ভিভো ও ওয়ান প্লাস।
চীনের এই ব্র্যান্ডগুলো এই মুহূর্তে ভারতের স্মার্টফোনের বাজারের প্রায় ৫০ শতাংশ দখল করে রেখেছে। তবে দেশটির তৈরি যে কোনও ব্র্যান্ড ভারতীয় ক্রেতাদের জন্য কতটা নিরাপদ সে নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এই স্মার্টফোনগুলোর প্রযুক্তি কেমন, কী কী ধরনের অ্যাপ ইনস্টল করা আছে, কী কী তথ্য আদান প্রদান করা যায় ইত্যাদি সবকিছু বিস্তারিত জানতে চেয়েছে মোদি সরকার। এমনটাই বলছে সূত্র।
গত বছর ভারত একাধিক চীনা অ্যাপ্লিকেশন ব্যান করার পর থেকেই সেদেশের স্মার্টফোন ব্র্যান্ডগুলি বেশ আক্রমণাত্মকভাবে ভারতীয় মার্কেটে ভাগ বসায় এবং দেশে স্থানীয় উৎপাদন এবং বিনিয়োগের পরিমাণও বৃদ্ধি করে। কিন্তু প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কোম্পানিগুলি সরকারকে যে বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তার মধ্যে বেশ কিছু যথাযথভাবে পূরণ না হওয়ায় এই নতুন নোটিশকে এক ধরনের প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপ হিসেবে ধরে নেওয়া হচ্ছে। এই সংস্থাগুলির মধ্যে রয়েছে Oppo, Vivo এবং এর সাব-ব্র্যান্ড iQOO। তবে Xiaomi-কে কেন এই তালিকার অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে সেই বিষয়টি স্পষ্ট নয়, কারণ সংস্থাটি ভারত সরকারকে দেওয়া যাবতীয় বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি পালন করেছে বলে জানা গেছে।
স্মার্টফোন পরীক্ষার জন্য বিশ্বাসযোগ্য কিছু কোম্পানির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হওয়ার কথা ভাবছে ভারত। কোনোভাবে চীনের তৈরি স্মার্টফোনের মাধ্যমে দেশটির ওপর নজরদারি চলছে কি না, তা জানার জন্যই মূলত কাজটি করতে চলেছে ভারত সরকার। ভারত-চীন সীমান্তে চীনের আগ্রাসনে মোকাবিলা করতেই এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
এ কাজে যুক্ত একটি সূত্র সংবাদমাধ্যম ইকনমিক টাইমসকে জানিয়েছে, এ কাজের জন্য চীনের ব্র্যান্ডের স্মার্টফোনগুলোর ওপর আলাদাভাবে নজর দেওয়া হবে। তবে কোম্পানিগুলোকে ভয় দেখানোর জন্য এ সিদ্ধান্ত নেয়নি ভারত। মূলত দেশের মানুষের তথ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতেই কেন্দ্রের পক্ষ থেকে এ সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা ভাবা হচ্ছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গ্রাহকের তথ্য সংগ্রহ না করলে কোম্পানিগুলোর আতংকিত হওয়ার কোনো কারণ নেই।
এ ধরনের আইন প্রণয়নের জন্য ভারতের ইলেকট্রনিক্স এবং তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয় জাতীয় প্রযুক্তিগত গবেষণা সংস্থা ও অন্যান্য রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার সঙ্গে হাত মেলাতে পারে। খবরে বলা হয়েছে, এজন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, শিল্প ও অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যের প্রচার বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে আলোচনা চলছে।
ভারতের গোয়েন্দা সূত্র বলছে, সীমান্তে অনুপ্রবেশে সফল হচ্ছে না চীনের সেনাবাহিনী। তাই ঘুরিয়ে সাইবার হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে বেইজিং। এর আগে তথ্যপ্রযুক্তি আইনে চাইনিজ অ্যাপগুলো নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। কারণ হিসেবে বলা হয়েছিল, এসব অ্যাপ এমন কার্যকলাপে লিপ্ত যা ভারতের সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতা, প্রতিরক্ষা, নিরাপত্তা ও জনস্বার্থের পরিপন্থী।
দিল্লির দাবি, কোটি কোটি ভারতীয় মোবাইল ও ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর নিরাপত্তার স্বার্থেই সেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়। এখন নতুন করে আবারও সেই নিরাপত্তার প্রসঙ্গই উঠে আসছে।
এসব ব্র্যান্ডের মোবাইলের মাধ্যমে ভারতীয় গ্রাহকদের ব্যক্তিগত তথ্য চুরি হতে পারে, ভয়ঙ্কর ম্যালওয়ার ঢুকিয়ে সাইবার হামলা চালানো হতে পারে। এমন আশঙ্কা মোদি সরকারের। ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাইবার ক্রাইম শাখা থেকেও চীনা ব্র্যান্ডগুলোর বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে।
ভারতের গোয়েন্দা সূত্র বলছে, দেশের প্রতিরক্ষার বিষয়টি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। চীন যে বড় ধরনের সাইবার হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে এমন আশঙ্কা আগেও করা হয়েছিল। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সাইবার নজরদারি বিষয়ক একটি সংস্থা সতর্ক করে বলেছিল, চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মির মদতপুষ্ট অন্তত দুইটি হ্যাকার-গোষ্ঠী ভারতের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংস্থা ও সংবাদমাধ্যমের ওয়েবসাইটে হানা দেওয়ার পরিকল্পনা করেছে। তাদের আরও আশঙ্কা ছিল, বর্তমান কোভিড পরিস্থিতিতে কোনও সরকারি সংস্থার ভুয়া পরিচয় দিয়ে গোপনে সাইবার ফাঁদ পাততে পারে চীন। ভুয়া ওয়েবসাইটে ঢোকার চেষ্টা করলে যাবতীয় ব্যক্তিগত ও আর্থিক তথ্য হ্যাকারদের কাছে চলে যাবে।
গত বছর জুনে চীনের সঙ্গে লড়াইয়ে পূর্ব লাদাখের গালওয়ান সীমান্তে ২০ ভারতীয় সেনার মৃত্যু হয়। তারপর পুরো ভারতে চীনা পণ্য বয়কট করার ডাক দিয়েছিলেন অনেকেই। এমন কি রাস্তায় চীন বিরোধী স্লোগান দিতে শুরু করেন মানুষ। কেন্দ্রের পক্ষ থেকে চীনা পণ্য নিষিদ্ধ করা না হলেও প্রতিবাদের কারণে অনেকেই চীনে তৈরি পণ্য কেনা বন্ধ করে দেন। এ কারণে ৫জি নেটওয়ার্ক সরঞ্জামেও চীনা কোম্পানির তৈরি যন্ত্রাংশ বর্জন করে একাধিক কোম্পানি।
এয়ারটেল চেয়ারম্যান সুনীল মিত্তাল জানিয়েছেন, টাটার সঙ্গে হাত মিলিয়ে ৫জি ট্রায়াল শুরু হয়ে যাবে। পরে বাণিজ্যিকভাবে পুরো ভারতে লেটেস্ট নেটওয়ার্ক প্রযুক্তি শুরু করবে কোম্পানিটি। এছাড়া রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি ভারত সঞ্চার নিগম লিমিটেডকে ৪জি স্ট্যাক সরবরাহ করছে টিসিএস। পাশাপাশি আবার ৫টি স্ট্যাক তৈরির কাজ শুরু করে দিয়েছে রিলায়েন্স জিও। ফলে আরও সস্তা হবে ৫জি নেটওয়ার্ক তৈরির কাজ। এয়ারটেল ছাড়াও ভারতীয় প্রযুক্তি ব্যবহার করে ৫জি নেটওয়ার্ক তৈরির কাজ শুরু করেছে দিয়েছে রিলায়েন্স জিও।
লাদাখ অঞ্চলের গালওয়ান উপত্যকায় গত বছর সীমান্ত বিরোধ ভারতে চীনবিরোধী মনোভাবের উত্থানের কারণ করেছে। তার পর থেকে সরকার দেশে চীনা পণ্যের বিরুদ্ধে কিছু ব্যবস্থা নিয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, সরকার চীনা সংস্থাগুলি দ্বারা তৈরি গেমস এবং অ্যাপ্লিকেশনগুলিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। জনপ্রিয়গুলির মধ্যে রয়েছে টেনসেন্টের পিইউবিজি, টিকটোক, ইউসি ব্রাউজার, আলি এক্সপ্রেস ইত্যাদি টেলিযোগাযোগ বিভাগ (ডিওটি) ভারতে ৫জি ট্রেলের সরঞ্জাম সরবরাহের জন্য কোনও চীনা টেলিযোগাযোগ গিয়ার প্রস্তুতকারীকে অনুমোদন দেয়নি। এছাড়াও, সরকার চীন থেকে আমদানিকৃত বৈদ্যুতিক আইটেমগুলিতে অতিরিক্ত শুল্ক প্রবর্তন করে। কেউ কেউ শুল্ক অফিস থেকে ছাড়পত্র পেতে লড়াই করে এবং কারাগারে আটকে থেকে যায়।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩১১
আপনার মতামত জানানঃ