আফগানিস্তান বরাবরই গরিব দেশ। সেখানকার ৭০ শতাংশ মানুষের দৈনিক আয় দুই ডলারের কম। অর্থনীতিবিদদের ধারণা, আগামী দিনে দেশটি আরও দরিদ্র হতে চলেছে। সেই দারিদ্রের মোকাবিলা করতে হবে তালিবান শাসকদের। তারা ইতিমধ্যেই বুঝতে পারছেন, দারিদ্রের বিরুদ্ধে লড়াই করা মার্কিন বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালানোর চেয়ে বেশি কঠিন।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল জানিয়েছে, আফগানিস্তানের অর্থনৈতিক সংকট প্রতিবেশী দেশ তুরস্কসহ ইউরোপে শরণার্থী সংকটকে বাড়িয়ে তুলতে পারে। চলতি বছর দেশটির অর্থনীতি প্রায় ৩০ শতাংশ সংকুচিত হবে। ফলে অসংখ্য মানুষ দরিদ্র হয়ে পড়বে। এমনকি মারাত্মক মানবিক সংকটের মুখে পড়তে পারে দেশটি। ইতিমধ্যে তাজিকিস্তান সীমান্তে কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে যে, তারা আর বিপুল পরিমাণ শরণার্থী গ্রহণের সামর্থ্য রাখে না। বিবিসি অনলাইনের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়।
আইএমএফ জানিয়েছে, আফগানিস্তানের প্রতিবেশীরাও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কারণ, তারা বাণিজ্যের জন্য এর তহবিলের ওপর নির্ভর করে। আফগানিস্তানের অর্থনীতি বৈদেশিক সাহায্যনির্ভর ছিল। যুক্তরাজ্য সরকারের তথ্য অনুযায়ী, ওইসিডি দেশগুলো ২০০১ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত আফগানিস্তানকে ৬ হাজার ৫০০ কোটি ডলার অনুদান দিয়েছে, যার বেশির ভাগই ইরান, পাকিস্তান, তুর্কমিনিস্তান ও উজবেকিস্তানে বাণিজ্যের মাধ্যমে ব্যবহৃত হয়েছে।
বিদেশি সম্পদ জব্দ ও অধিকাংশ মানবিক সহায়তা বন্ধ থাকায় আফগানিস্তানে নগদ অর্থের প্রবাহ বন্ধ হয়ে গেছে। আইএমএফ মনে করছে, আফগান শরণার্থীর চাপ প্রতিবেশী দেশগুলোতে জনসাধারণের সম্পদের ওপর চাপের সৃষ্টি করতে পারে। এমনকি জ্বালানি ও শ্রম বাজারের ওপর যে চাপ পড়বে, তা সামাজিক উত্তেজনার দিকে নিয়ে যেতে পারে, যা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সাহায্যের প্রয়োজনীয়তাকে তুলে ধরবে।
ঠিক কত মানুষ শরণার্থী হয়ে গেছে, তা পরিষ্কার না হলেও আইএমএফের পর্যালোচনায় দেখা গেছে, যদি আরও ১০ লাখ মানুষ শরণার্থী হয়ে যায়, তাদের জন্য তাজিকিস্তানের কমপক্ষে ১০ কোটি, ইরানে ৩০ কোটি ও পাকিস্তানের ৫০ কোটি ডলার ব্যয় হবে। গত মাসে তাজিকিস্তান বলেছিল যে আন্তর্জাতিক আর্থিক সহায়তা না পেলে তারা বিপুলসংখ্যক শরণার্থী গ্রহণের সামর্থ্য রাখে না, অন্যদিকে মধ্য এশিয়ার দেশগুলো বলেছে যে, তাদের শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়ার কোনো পরিকল্পনা নেই।
আফগানিস্তানের প্রতিবেশীরাও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কারণ, তারা বাণিজ্যের জন্য এর তহবিলের ওপর নির্ভর করে।
আইএমএফ আরও সতর্ক করেছে যে, দেশটিতে এখন যে তহবিল যাচ্ছে, তা সন্ত্রাসবাদ ও অর্থ পাচারের মতো কাজে ব্যবহৃত হতে পারে।
১৫ আগস্ট তালেবানের কাবুল দখলের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ১০ বিলিয়ন সম্পদ স্থগিত করে রেখেছে। ফলে দেশের অর্থনৈতিক দুর্দশা দিন দিন চরমে উঠছে।
তালিবানদের দেশ দখল আফগান অর্থনীতিতে বড় ধাক্কা দিয়েছে। বিশৃঙ্খলা ও উত্তেজনার মাঝে মার্কিন বাহিনী প্রত্যাহারের ফলে পরিস্থিতি আরও জটিল হতে থাকে দেশটিতে।
তালিবানদের কাবুল দখলের পর অনেক দিন ব্যাংক বন্ধ ছিল; তবে বর্তমানে অনেক ব্যাংক খুলে দেওয়া হলেও নগদ টাকা ওঠানো এখনও বেশ কঠিন।
অনেকেই ব্যবসা বন্ধ করে জীবন ভয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। আর যারা চাকরি করতেন, তাদের অনেকেই মাসের পর মাস বেতন পাননি।
বাজারে নগদ অর্থের প্রবাহ না থাকায় খাদ্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
যেসব নারীরা চাকরি পেয়েছিলেন এবং তাদের পরিবারকে অর্থনৈতিকভাবে সাহায্য করে আসছিলেন, তারা এখন আর কাজ করতে পারছেন না। পুরোপুরি গৃহবন্দি হয়ে অন্যের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন তারা।
কাবুলে শত শত মানুষ এখনও খোলা জায়গায় তাবু টাঙিয়ে বসবাস করছেন। দীর্ঘদিন পশ্চিমাদের, বিশেষ করে মার্কিন সহায়তার উপর নির্ভরশীল আফগানিস্তানের পরিস্থিতি তালিবান দখলের পর থেকে আরও কঠিন হয়ে উঠেছে।
এদিকে গত সপ্তাহে আফগানিস্তানে মানবিক বিপর্যয় এড়াতে সহায়তা দেওয়ার ব্যাপারে একমত হয়েছে বিশ্বের ২০টি প্রধান অর্থনীতির জোট জি-২০। তারা জানায়, এ সহায়তা নিয়ে যদি তালিবানের সঙ্গে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হয়, সেটাও করবে এই জোট। ১০০ কোটি ইউরো (১২০ কোটি মার্কিন ডলার) তহবিল সংগ্রহের লক্ষ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) বৈঠক আহ্বান করে। ওই বৈঠকে একমত হন নেতারা। বলা হয়, এ তহবিল আফগানিস্তানে জরুরি মানবিক চাহিদা পূরণ ও প্রতিবেশী যেসব দেশ পালিয়ে যাওয়া আফগান নাগরিকদের আশ্রয় দিয়েছে, তাদের দেওয়া হবে।
এর আগে জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস অর্থনৈতিক বিপর্যয় এড়াতে আফগানিস্তানে অর্থপ্রবাহ বজায় রাখার জন্য বিশ্বের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন।
জাতিসংঘের এই আহ্বানে সাড়া দিয়েছেন জি-২০ নেতারা। ইতালির প্রধানমন্ত্রী মারিও দ্রাঘি’র আয়োজনে অনুষ্ঠিত এক ভার্চুয়াল সম্মেলনে আফগানিস্তানকে সাহায্যের ব্যাপারে তারা একমত হয়েছেন।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন জোর দিয়ে বলেন, ক্ষমতাসীন তালিবানদের কাছে সরাসরি সাহায্য না পাঠিয়ে, তা স্বাধীন আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর মাধ্যমে পাঠানো উচিত।
তবে, এখন পর্যন্ত আফগানিস্তানে প্রেরিত সাহায্য মূলত জরুরি খাবার এবং ওষুধ সরবরাহের জন্যই পাঠানো হয়েছে।
ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লেইন, আফগানিস্তান এবং এর শরণার্থীদের আশ্রয় দানকারী প্রতিবেশী দেশগুলোকে ১ বিলিয়ন পাউন্ড (১.১৫ বিলিয়ন ডলার) সহায়তা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
গত মাসে নির্বাচনে অংশ না নেওয়ায় নতুন সরকার গঠিত হলে জার্মান চ্যান্সেলর মের্কেল, চ্যান্সেলরের পদ থেকে সরে দাঁড়াবেন; তবে তিনি সরে দাঁড়ানোর আগে জার্মানির পক্ষ থেকে আফগানিস্তানকে ৬০০ মিলিয়ন পাউন্ড সহায়তার প্রতিশ্রুতিকে পুনরায় নিশ্চিত করেছেন।
সাংবাদিকদের তিনি বলেন, আফগানিস্তানের মুদ্রা ব্যবস্থা ভেঙে পড়লে বা আর্থিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়লে আমাদের কারও এখানে লাভের কিছু নেই।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭৪৮
আপনার মতামত জানানঃ