চাঁদ নিয়ে রহস্যের অন্ত নেই। প্রাচীনকালে মানুষ মনে করত, চাঁদ প্রত্যেক রাত্রি মরে ছায়ার জগতে চলে যায়। অন্যান্য সংস্কৃতিতে বিশ্বাস করত যে চাঁদ সূর্যকে পিছু করছে। পিথাগোরাসের সময়ে, চাঁদকে একটি গ্রহ হিসেবে বিবেচনা করা হতো। মধ্যযুগে কিছু মানুষ বিশ্বাস করত যে চাঁদ হয়তো একটি নির্ভুলভাবে মসৃণ গোলক যা অ্যারিস্টটলের তত্ত্ব সমর্থন করত এবং অন্যান্যরা মনে করত সেখানে সাগর আছে (সাগর বলতে চাঁদের উপরিতলের অন্ধকার অঞ্চলকে বোঝায় যা চিত্র শব্দতে এখনও ব্যবহার করে)।
১৬০৯ সালে গ্যালিলিও যখন তার দূরবীক্ষণ চাঁদের দিকে ধরলেন, তিনি দেখলেন যে চাঁদের উপরিতল মসৃণ ছিল না। তা ক্ষুদ্র কালো রেখা, উপত্যকা, পর্বত এবং খাদের গঠিত হয়। সেই মুহূর্ত থেকে তিনি অনুভব করতে শুরু করেন যে এটিতেও পৃথিবীর মতোই একটি কঠিন গলিত পদার্থ ছিল যা পরে এই রূপ নেয়।
১৯২০ সালেও মনে করত যে চাঁদের শ্বাস গ্রহণের উপযোগী বায়ুমণ্ডল আছে (অথবা ঐ সময় বিজ্ঞানের কাল্পনিক বানোয়াট গল্প বলত) এবং কিছু জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা একটি ক্ষুদ্র বায়ু স্তরের উপস্থিতি আছে বলে অনুমান করত কারণ চাঁদ পর্যবেক্ষণ সময় তারা অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু উড়ন্ত বস্তু দেখে ছিল।
সৌরজগতের গ্রহগুলো অবয়ব পেতে শুরু করার পরও পৃথিবীর চাঁদের অস্তিত্ব পেতে আরও এক মিলিয়ন বছর লেগে গেছে। আমাদের গ্রহের এই উপগ্রহটির সৃষ্টি নিয়ে তিনটি তত্ত্ব আছে: বিপুল সংঘাত তত্ত্ব, সহসৃষ্টি তত্ত্ব এবং দখল তত্ত্ব।
বিপুল সংঘাত তত্ত্ব
বিপুল সংঘাত তত্ত্ব মোতাবেক আদিম পৃথিবীর বুকে কোনো একটি মহাজাগতিক বস্তু আছড়ে পড়ার কারণেই চাঁদের সৃষ্টি। অন্যান্য গ্রহের মতো পৃথিবীও সূর্যকে ঘিরে ঘুরন্ত মহাজাগতিক ধুলো এবং মেঘ থেকে জন্ম নিয়েছে। আদিম সৌরজগৎ ছিল উত্তাল। সেই সময়ের তৈরি বেশ কয়েকটি বস্তুই শেষ পর্যন্ত গ্রহের কৌলীন্য পায়নি। সেগুলোরই একটা হয়তো গ্রহের জন্মের অল্প পরেই এর পিঠে আছড়ে পড়েছিল।
মঙ্গল গ্রহের সমান থেইয়া নামে এমনি একটি সৌরবস্তুর সাথে পৃথিবীর সংঘর্ষে নতুন পথিবীপৃষ্ঠের বস্তুকণা মহাশূন্যে ছিটকে যায়। অভিকর্ষ শক্তি নিক্ষিপ্ত এসব বস্তুকণাকে একত্র করে মূল গ্রহের বিচারে বৃহত্তম উপগ্রহ চাঁদের জন্ম। চাঁদ সৃষ্টির এই তত্ত্ব উপগ্রহটির পৃথিবীর তুলনায় প্রধানত হালকা উপাদানে তৈরি এবং কম ঘনত্বের কারণ ব্যাখ্যা করে; পৃথিবী পৃষ্ঠ থেকে এসেছে এর কাঁচামাল, গ্রহের পাথুরে অভ্যন্তর অনস্পর্শিত থেকে গেছে।
থেইয়ার অবশিষ্টাংশ ঘিরে বিভিন্ন উপাদান জড়ো হওয়ার সময় সেটা পৃথিবীর ক্রান্তিতলে বা আজকের দিনে আকাশের গায়ে চাঁদের কক্ষপথে পৃথিবীর কাছাকাছি কেন্দ্রীভূত হয়ে থাকবে।
নাসার মতে, ‘নতুন পৃথিবী এবং এই দুর্বৃত্ত মহাজাগতিক বস্তুর সংঘাতের সময় আরও বহু দিন পর পৃথিবীর বুক থেকে ডাইনোসর বিলুপ্তির জন্যে দায়ী বিপুল শক্তির তুলনায় ১০০ মিলিয়ন গুণ বেশি শক্তি উৎপন্ন হয়েছিল।’
সবচেয়ে জনপ্রিয় তত্ত্ব হলেও এটি অবিতর্কিত নয়। বেশির ভাগ মডেল চাঁদের ৬০ ভাগেরও বেশি থেইয়ার উপাদানে তৈরি হওয়ার আভাস দেয়। কিন্তু বিভিন্ন অ্যাপোলো মিশন থেকে পাওয়া পাথরের নমুনা ভিন্ন কথা বলে।
স্পেসডটকমকে হাইফার ইসরায়েল ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির জ্যোতির্পদার্থবিদ আলেসসান্দ্রা মাস্ত্রোবুওনো-বাতিস্তি বলেছেন, ‘গঠনের দিক থেকে পৃথিবী এবং চাঁদ প্রায় যমজ, লক্ষ ভাগের এক ভাগ ক্ষেত্রে এদের গঠনে পার্থক্য দেখা যায়। এমনি গঠন বিপুল সংঘাতের মডেলের ওপর দীর্ঘ ছায়া ফেলেছে।’
মাস্ত্রোবুওনো-বাতিস্তির দল থেইয়া এবং পৃথিবীর ভেতর অতীতের ধারণা অনুযায়ী তেমন পার্থক্য না থাকার আভাস দেওয়া একটি মডেল তৈরিও করতে পেরেছেন।
২০১৭ সালে ইসরায়েলি গবেষকেরা চাঁদ সৃষ্টির জন্যে পৃথিবীর বুকে খুদে মহাজাগতিক আবর্জনার বৃষ্টিপাতের কথা বলেছেন।
ইসরায়েলের ওয়েইসম্যান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্সের গবেষক রালুকা রুফু বলেন, ‘একাধিক সংঘাত তত্ত্ব চাঁদের গঠন ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে অনেক বেশি স্বাভাবিক উপায়। সৌরজগতের গোড়ার দিকে সংঘাত ছিল বেশুমার। সুতরাং বিশেষ একটির চেয়ে একাধিক সংঘাতের ফলে চাঁদ সৃষ্টি হওয়াই স্বাভাবিক।’
সহসৃষ্টি তত্ত্ব
মূল গ্রহের সাথে একই সময়েও উপগ্রহ সৃষ্টি হতে পারে। এই ধরনের ব্যাখ্যা মোতাবেক অভিকর্ষ শক্তি পৃথিবী সৃষ্টির উপাদান জড়ো করার সময়ই আদিম সৌরজগতের উপাদান জড়ো করার পেছনে ক্রিয়াশীল ছিল। এই ধরনের একটি চাঁদ তার মাতৃগ্রহের মতো মাল-মসলায় তৈরির এবং আমাদের চাঁদের বর্তমান অবস্থানের ব্যাখ্যা জোগাবে।
অবশ্য, পৃথিবী এবং চাঁদ মোটামুটি একই উপাদানের অংশীদার হলেও চাঁদের ঘনত্ব আমাদের গ্রহের ঘনত্বের চেয়ে বেশ কম, কিন্তু দুটিরই সৃষ্টি একই রকম অভ্যন্তরীণ ভারী বস্তুতে শুরু হয়ে থাকলে এমন হওয়ার কথা নয়। পৃথিবীর ঘনত্ব ৫.৫৭ এবং সে’তুলনায় চাঁদের ঘনত্ব ৩.৩৪; যা প্রায় পৃথিবীর বহিঃস্থ স্তরের ঘনত্বের সমতুল্য।
২০১২ সালে টেক্সাসের সাউথওয়েস্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের গবেষক রবিন কানুপ মঙ্গল গ্রহের চেয়েও পাঁচ গুণ বড় দুটি বিশাল বস্তুর সংঘর্ষের ফলে যুগপৎ পৃথিবী ও চাঁদ সৃষ্টি হওয়ার প্রস্তাব রেখেছেন।
নাসা বলছে, ‘সংঘর্ষের পর একই আকারের দুটি বস্তুর ভেতর ফের সংঘাত বাধে, ফলে বিভিন্ন উপাদানের একটি বলয় নিয়ে আদিম পৃথিবীর সৃষ্টি হয়। সেই বলয়টিই পরে একসাথে হয়ে চাঁদ তৈরি করে। ফিরতি সংঘাত এবং পরবর্তী সম্মিলন দুটো বস্তুতে আজকের দিনের একই রকম রাসায়নিক গঠন যুুগিয়েছে।’
দখল তত্ত্ব
সৌরজগতের অন্যান্য উপগ্রহের মতো সম্ভবত পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ শক্তি কোনো চলমান বস্তুকে আটকে ফেলে। মঙ্গলের উপগ্রহ ফোবোস ও দিমোসের বেলায় এমন হয়েছিল। দখল তত্ত্বমতে সৌরজগতের অন্য কোথাও সৃষ্টি একটি পাথুরে বস্তু পৃথিবীর কক্ষপথে আটকা পড়ে থাকতে পারে।
দখল তত্ত্ব পৃথিবী এবং এর চাঁদের গঠনের পার্থক্যের ব্যাখ্যাও দিতে পারে। অবশ্য, এই ধরনের উপগ্রহগুলো সাধারণত বেঢপ আকারের হয়, চাঁদের মতো গোলাকার নয়। এদের চলার পথ চাঁদের বিপরীতে মাতৃগ্রহের কক্ষপথের সাথে খাপ খায় না।
সহসৃষ্টি এবং দখল তত্ত্ব চাঁদের বুকে অস্তিত্ববান কিছু উপাদানের কারণ ব্যাখ্যা দিলেও অনেক প্রশ্নেরই উত্তর জোগাতে পারে না।
আপাতত বিপুল সংঘাত তত্ত্বই এসব প্রশ্নের অনেকগুলোরই উত্তর জুগিয়ে চাঁদ সৃষ্টির বৈজ্ঞানিক প্রমাণের মডেলের সাথে খাপ খেয়ে যায় বলে মনে হয়।
এসডব্লিউ/এসএস/১৫৩০
আপনার মতামত জানানঃ