স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও বাংলাদেশের সংখ্যালঘুরা ধর্ম পালনের মৌলিক অধিকারের দাবি জানাচ্ছে। অথচ সংবিধান ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ নির্বিশেষে বাংলাদেশের সব নাগরিকের সমানাধিকারের নিশ্চয়তা দেয়। কিন্তু পতিস্থিতি বলছে ভিন্ন কথা। দেশের বেশ কিছু জেলায় দুর্গাপূজা চলাকালীন মন্দির ও প্রতিমার ওপর হামলাই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, তাদের ধর্ম পালনের অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে। ধর্মান্ধ মোল্লাদের চালানো আক্রমণ দেশের ভাবমূর্তি এবং আইনের শাসনেও বড় ধরনের প্রভাব ফেলেছে। এই বর্বরোচিত হামলাগুলো প্রমাণ করে দেয় যে, সংবিধানকে রক্ষা ও সমুন্নত রাখতে রাষ্ট্র ব্যর্থ।
দেশের ৩৫টি জেলার নিরাপত্তায় বিজিবিসহ বিপুল সংখ্যক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যের মোতায়েনও এই ব্যর্থতা ঢাকতে পারেনি। ভীতসন্ত্রস্ত অবস্থায়, যেকোনো মুহূর্তে আক্রমণের আশঙ্কা মনে নিয়ে হিন্দুরা শারদীয় উৎসব পালন করেছে। গৃহহীন হচ্ছে, প্রাণভয়ে লুকিয়ে থাকতে হচ্ছে, সংঘবদ্ধ হামলার শিকার হচ্ছে।
অথচ সংবিধানের ৪১ অনুচ্ছেদে স্পষ্ট ভাষায় বর্ণনা রয়েছে ধর্মীয় স্বাধীনতার। সেখানে বলা হয়েছে, ‘প্রত্যেক নাগরিকের যে কোনো ধর্ম অবলম্বন, পালন বা প্রচারের অধিকার রহিয়াছে; প্রত্যেক ধর্মীয় সম্প্রদায় ও উপ-সম্প্রদায়ের নিজস্ব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের স্থাপন, রক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার অধিকার রহিয়াছে।’
নৃতাত্ত্বিক দিক বিবেচনায় এই বঙ্গে হিন্দু জাতির বাস ছিল গৌতম বুদ্ধের জন্মেরও আগে থেকে। ঋগ্বেদের ঐতরেয় আরণ্যকে তিনটি জাতিগোষ্ঠীর নাম পাওয়া যায়। ‘বঙ্গ’, ‘বগধ’ ও ‘চের’। হিন্দু ধর্মের সক্রিয়তায় এসব জাতিগোষ্ঠীর জীবনাচরণে পূজাপার্বণ, উৎসব-অনুষঙ্গ ছিল নিত্য। হিন্দু ধর্মের এই প্রভাব ছিল প্রাচীন পুন্ড্র-গৌড়-সুহ্ম-রাড়-তাম্রলিপি-সমতট-বঙ্গ-বঙ্গাল-হরিকেল প্রভৃতি ভৌগলিক ও রাষ্ট্রিয় অবস্থানে।
তবে কালের পরিক্রমায় এসব ভূখণ্ড এক হয়ে নিজ নিজ নাম বাদ দিয়ে এক বঙ্গ বা বাঙলা নামে অভিহিত হতে শুরু করে। আর প্রাচীনকাল থেকেই বহু মিশ্রণে-সংঘাতে-সংশ্লেষে-সমন্বয়ে এগিয়ে গেছে এই বাঙলার ইতিহাস। এরই মধ্যে বাঙলা ও বাঙালির জনজীবনে পড়েছে বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাব। হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মের মিশ্রিত প্রভাবের সঙ্গে যোগ হয়েছে ইসলামের সুফি ধারার সমন্বিত প্রয়াস। যা বাঙালির জনজীবনে দিয়েছে ধর্ম-বর্ণ আর সংস্কৃতির পারস্পরিক সহাবস্থানের উদারনৈতিক এক দ্যোতনা। যা কারও চাপিয়ে দেওয়া নয়।
তাই তো ধর্মের ভিত্তিতে গড়ে তোলা রাষ্ট্র পাকিস্তানকে প্রত্যাখ্যান করতে এতটুকু বেশি সময় লাগেনি এ দেশের সাধারণ মানুষের। পাকিস্তান জন্মের বছর না ঘুরতেই বাংলাদেশের মানুষ বুঝতে শুরু করে ধর্মের নামে তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে নানাবিধ শোষণ-শাসন আর নিপীড়ন। ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারের মধ্য দিয়ে শাসন-শোষণের রাষ্ট্রিক প্রক্রিয়া প্রত্যাখ্যানের মধ্য দিয়ে এল স্বাধীনতা। স্বাধীন বাংলাদেশ ছিল ধর্মনিরপেক্ষ।
“বাংলাদেশ হবে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। ধর্মনিরপেক্ষ মানে ধর্মহীনতা নয়। মুসলমান মুসলমানের ধর্ম পালন করবে। হিন্দু তার ধর্ম পালন করবে। খ্রিস্টান তার ধর্ম পালন করবে। বৌদ্ধও তার নিজের ধর্ম পালন করবে। এ মাটিতে ধর্মহীনতা নাই, ধর্মনিরপেক্ষতা আছে। এর একটা মানে আছে। এখানে ধর্মের নামে ব্যবসা চলবে না। ধর্মের নামে মানুষকে লুট করে খাওয়া চলবে না। ধর্মের নামে রাজনীতি করে রাজাকার, আলবদর পয়দা করা বাংলার বুকে আর চলবে না। সাম্প্রদায়িক রাজনীতি করতে দেওয়া হবে না।” [১৯৭২ সালের ৭ জুন রেসকোর্স ময়দানে দেওয়া ভাষণ]
আর ধর্মকে রাষ্ট্র থেকে আলাদা করা প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু বললেন: “সকলে জেনে রাখুন, বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে। আর তার ভিত্তি কোনো বিশেষ ধর্মীয় ভিত্তিক হবে না। রাষ্ট্রের ভিত্তি হবে জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা।” [১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি পাকিস্তান থেকে দেশে ফেরার পর রেসকোর্সে দেওয়া ভাষণ]
তবে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক নানা চাপে নিজ অবস্থান অনেকটাই ধরে রাখতে পারেননি বঙ্গবন্ধু। রাষ্ট্রিকভাবেই যোগ দেন লাহোরে অনুষ্ঠিত ওআইসি শীর্ষ সম্মেলনে। প্রতিষ্ঠা করেন ইসলামি ফাউন্ডেশন। গড়ে তোলেন ধর্ম মন্ত্রণালয়। তাতে অত্যন্ত নিঃশব্দে হলেও ভিত্তি পায় বাঙালির কাছে যারপরনাই ঘৃণিত-প্রত্যাখ্যাত ধর্মের রাষ্ট্রিক ব্যবহার। যদিও বাঙালির হাজার বছরের বহু ধর্ম-বর্ণ-গোষ্ঠী-সংস্কৃতিভিত্তিক জীবনাচরণের প্রতি অগাধ বিশ্বাস বঙ্গবন্ধুর মনে ছিল। আর বিশ্বাসবোধ থেকে তিনি নিজেই বলেছিলেন:
“রাজনৈতিক কারণে ধর্মকে ব্যবহার করা যাবে না। যদি কেউ ব্যবহার করে তাহলে বাংলার মানুষ তাকে প্রত্যাঘাত করবে। এ বিশ্বাস আমি করি।” [১৯৭২ সালের ১২ অক্টোবর গণপরিষদে দেওয়া ভাষণ]
আজকের পরিস্থিতির জন্য অনেক বিশেষজ্ঞই ইসলামকে রাষ্ট্রধর্মের মর্যাদাকে দায়ী করছেন। সংবিধান অনুযায়ী বাংলাদেশের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম৷ অথচ শুরুতে সংবিধানে রাষ্ট্রধর্মের কোনো বিধান ছিল না৷ বরং সংবিধানের চার মূলনীতির অন্যতম ছিল ধর্মনিরপেক্ষতা৷ কিন্তু ১৯৮৮ সালে এরশাদের শানমালে সংবিধানের চরিত্র পাল্টে দেয়া হয়৷
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর, ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের সংবিধান প্রণীত হয়, যা কার্যকর হয় ঐ বছরেরই ১৬ ডিসেম্বর থেকে৷ সেই সংবিধানের রাষ্ট্র পরিচালনার চারটি মূলনীতি ছিল— ১. জাতীয়তাবাদ, ২. গণতন্ত্র, ৩. সমাজতন্ত্র এবং ৪. ধর্মনিরপেক্ষতা৷ অর্থাৎ সংবিধানের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল ধর্মনিরপেক্ষতা৷
তাছাড়া সংবিধানের ১২ নং অনুচ্ছেদেও বলা হয়েছে যে, ধর্মনিরপেক্ষতা নীতি বাস্তবায়নের জন্য সব ধরনের সাম্প্রদায়িকতা, রাষ্ট্র কর্তৃক কোনো ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদা দান এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মীয় অপব্যবহার বিলোপ করা হবে।
সংবিধানের ৩৮ নং অনুচ্ছেদে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল ও সংগঠন গঠনের ওপরও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে নৃশংসভাবে হত্যা করে তার সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর পথ হারায় বাংলাদেশ। প্রথম সামরিক শাসনামলে সংবিধান থেকে উঠিয়ে দেওয়া হয় ধর্মনিরপেক্ষতা এবং ১২ নং অনুচ্ছেদ। ধর্মভিত্তিক রাজনীতির ওপর যে সাংবিধানিক নিষেধাজ্ঞা ছিল, তাও তুলে নেওয়া হয়।
পঁচাত্তর থেকেই ‘বাঙালি’ হয়ে যায় ‘বাংলাদেশি’। বহু ধর্মের এই দেশের রাষ্ট্রিক সংগঠনে ভিত্তি করে নেয় বিশেষ একটি ধর্ম। পাশাপাশি, অন্য ধর্ম ও সম্প্রদায়ের সামাজিক জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিতেও যাবতীয় প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা অঘোষিতভাবেই বাতিল করে রাষ্ট্র। পরিকল্পিতভাবে বাঙালি মুসলমানের জনজীবনে প্রবিষ্ট করানো হয় ধর্মের নামে অন্য ধর্ম ও সম্প্রদায়ের প্রতি ঘৃণা, বিদ্বেষ আর সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প।
পরে ১৯৮৮ সালে, আরেক স্বৈরশাসক জেনারেল এরশাদ সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করেন। কাজটি তিনি করেছিলেন রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য। নিজের শাসনের বিরুদ্ধে প্রবল গণআন্দোলনের মুখে ক্ষমতায় টিকে থাকতে জনগণের ধর্মীয় আবেগকে পুঁজি করতে চেয়েছিলেন তিনি। যদিও তার ইসলাম ধর্মকে ব্যবহার করে ক্ষমতায় টিকে থাকার ওই ফন্দি শেষ পর্যন্ত সফল হয়নি। নব্বইয়ের গণঅভ্যূত্থানের মাধ্যমে তার পতন হয়। কিন্তু তার ইসলামকে রাষ্ট্র ধর্মের স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়টি পরবর্তী গণতান্ত্রিক সরকারের সময়ও বাতিল করা সম্ভব হয়নি।
এরপর ২০১১ সালে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে ধর্মনিরপেক্ষতা ফিরিয়ে আনা হয়, ১২ নং অনুচ্ছেদ পুনর্বহাল করে নিষিদ্ধ করা হয় রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের ব্যবহারও। কিন্তু ইসলাম এখনও রাষ্ট্রধর্মের মর্যাদা ভোগ করছে।
মহানবী (সা.) মদিনা রাষ্ট্রে কখনও ইসলাম ধর্মকে রাষ্ট্র ধর্ম হিসেবে স্বীকৃতি দেননি। এমনকি খোলাফায়ে রাশেদীনের সময়েও ইসলামকে রাষ্ট্র ধর্ম হিসেবে ঘোষণা করা হয়নি। প্রশ্ন উঠতে পারে— মহানবীর (সা.) ও তার সাহাবিদের ইসলাম ধর্মের প্রতি ভালোবাসা কি স্বৈরশাসক এরশাদের চেয়ে কম ছিল? এরশাদ বুঝলেন, ইসলামকে রাষ্ট্র ধর্ম করতে হবে; কিন্তু মহানবী (সা.) ও তার সাহাবিরা কেন বুঝলেন না? আগেই বলেছি, এরশাদ ইসলামকে রাষ্ট্র ধর্ম হিসেবে সংবিধানে স্থান দিয়েছিলেন স্রেফ ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ১৯৮৮ সালের আগে রাষ্ট্রধর্ম যখন ইসলাম ছিল না, তখনও এ দেশের মানুষ ধর্ম পালন করতেন৷ রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম করার পরেও মানুষ ধর্ম পালন করেন৷ ধর্ম পালনে আগেও কোনো সমস্যা ছিল না, এখনও নেই৷ সব ধর্ম-বর্ণের মানুষকে নিয়ে রাষ্ট্র৷ সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ মুসলিম৷ তারা অধিকারও বেশি ভোগ করেন৷ আলাদা করে রাষ্ট্রের কোনো ধর্মীয় পরিচয়ের প্রয়োজন হয় না৷ রাষ্ট্রের ধর্মীয় পরিচয় না থাকলে, কোনো ক্ষতি হয় না৷ ধর্মীয় পরিচয় থাকলে, অন্য ধর্মের (সংখ্যায় তারা কম হলেও) মানুষ নিজেদের নিরাপত্তাহীন ভাবেন৷ সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের দায়িত্ব সংখ্যায় যারা কম তাদের দেখে রাখা৷ নিজের অধিকারের নামে তাদের মনে ভীতি তৈরি করা নয়৷ বর্তমানে বাংলাদেশে ভীতি তৈরির সংস্কৃতি চলছে৷
এসডব্লিউ/এসএস/১২১১
আপনার মতামত জানানঃ