দুর্গাপুজোর আর মাত্র দুই সপ্তাহ বাকি৷ অতীত অভিজ্ঞতার কারণে এবার নিরাপত্তার বিষয়টি সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে৷ গত বছরের দুর্গাপুজো দুঃখজনক অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে কেটেছে৷ আর সেই অভিজ্ঞতার আলোকে এবার সরকার পুজোর নিরাপাত্তায় কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলেছে৷ কিন্তু তারপরও কি নিরাপদ থাকবে পুজো?
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেছেন, নিরাপত্তার কোনো ত্রুটি রাখা হবে না৷ বুধবার রাতে তার কাছে সেই নিরাপত্তার বিস্তারিত জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘সেটা তো আমি গত ১১ তারিখেই বলে দিয়েছি৷ এর কোনো ব্যত্যয় হবে না৷’’
গত বছর পুজোর সময় কুমিল্লার একটি মন্দিরে পবিত্র কোরআন অবমাননার সাজানো অভিযোগ তুলে ব্যাপক হামলা চালানো হয়৷ কুমিল্লায় অনেকগুলো মন্দির ও পুজোমণ্ডপ ভাঙচুর করা হয়৷ হিন্দুদের বাড়িতেও হামলা চালানো হয়৷ কোরআন অবমাননার কথিত ঘটনাার প্রতিক্রিয়ায় চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ, চট্টগ্রাম, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, কক্সবাজার, নোয়াখালী ও রংপুরেও হিন্দুদের ঘরবাড়ি ও উপাসনালয়ে হামলার ঘটনা ঘটে৷
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘‘যদি কুমিল্লায় স্বেচ্ছাসেবক থাকতো, তাহলে ওই ঘটনা ঘটতো না৷ কুমিল্লার মণ্ডপে একজন নিরাপত্তাকর্মী ছিল৷ তা-ও সে রাতে মণ্ডপ থেকে অনেক দূরের বেঞ্চে ঘুমিয়ে ছিল৷’’
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ১১ সেপ্টেম্বর তার মন্ত্রণালয়ে দুর্গা পুজোর নিরাপত্তা নিয়ে বৈঠকের পর এক সংবাদ সম্মেলনে সার্বিক নিরাপত্তা পরিকল্পনা তুলে ধরেন৷
সেগুলো হলো
১. পুজোমণ্ডপে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর নিরাপত্তা ছাড়াও ২৪ ঘণ্টা আনসার বাহিনী দায়িত্ব পালন করবে৷
২. গোয়েন্দা বিভাগের সদস্যরা নজরদারি করবেন৷
৩. সব পুজোমণ্ডপে বাধ্যতামূলভাবে সিসি ক্যামেরা লাগাতে হবে৷
৪. এমন জায়গায় পুজোমণ্ডপ করা যাবে না, যেখানে গাড়ি প্রবেশ করতে পারে না৷
৫. পুজোমণ্ডপের স্বেচ্ছাসেবকদের বাধ্যতামূলকভাবে হাতে আর্মব্যান্ড পরতে হবে৷
৬. পুজোয় যে-কোনো ধরনের গুজবের ব্যাপারে সতর্ক নজর রাখা হবে৷ বিশেষ করে ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম মনিটরিং করা হবে৷ কোনো ধরনের গুজব ছড়ানোকে কঠোর হাতে দমন করা হবে৷
৭. পুজোর সময় পুলিশ সদর দপ্তর এবং জেলা পর্যায়ে কন্ট্রোল রুম খোলা হবে৷ ২৪ ঘণ্টা কন্ট্রোল রুমে যোগাযোগ করা যাবে৷
৮. থাকবে ভ্রাম্যমাণ আদালত৷
৯. আজানের সময় পুজোমণ্ডপে বাদ্যযন্ত্রের শব্দ সহনীয় রাখতে বলা হয়েছে৷
দেশে এবার ৩২ হাজার ১৬৮টি মণ্ডপে পুজোর প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে৷ গত বছর ৩২ হাজার ১১৮টি মণ্ডপে পুজো হয়েছে৷ এবার মণ্ডপগুলোতে সব মিলিয়ে এক লাখ ৯২ হাজার আনসার থাকবেন৷ তবে মোট কতজন পুলিশ থাকবেন তা এখানো নির্ধারণ করা হয়নি৷
গত বছর কোভিডের সময় পুলিশ সদস্যদের ৩০ ভাগ আক্রান্ত বলে পুলিশ কম দেয়া হয়েছে৷ কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে আনসারের ‘খরচ’ কারা বহন করবে৷
পুজো উদযাপন পরিষদের সাবেক সভাপতি কাজল দেবনাথ বলেন, ‘‘আনসারের মহাপরিচালক বলেছেন, পর্যাপ্ত আনসার আছে৷ কিন্তু বাজেট লাগবে৷ বাজেট কি আমরা দেবো? সরকার যদি বহন করে, তাহলে তো ভালো৷ এটা সরকারেরই দায়িত্ব৷’’
তার কথা, ‘‘আমাদের দিক থেকে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি প্রত্যেক মণ্ডপে ২৪ ঘণ্টা আমাদের পাঁচজন থাকবেন৷ কিন্তু দায়িত্ব সরকার ও রাষ্ট্রের৷ সরকার যদি ‘মিন’ করে তাহলে নিরাপত্তা দেয়া সম্ভব৷’’
তিনি বলেন, ‘‘গত বছর পুলিশের দায়িত্বহীন আচরণের কারণে কুমিল্লার ঘটনা ঘটেছে৷ পবিত্র কোরআন রাখার কথিত ঘটনার লাইভ যদি পুলিশ করতে না দিতো তাহলে ওই পরিস্থিতি হতো না৷’’
তিনি আরো বলেন, ‘‘পুজোর পাঁচ দিন শুধু নয়, আমরা সারা বছরের নিরাপত্তা চাই৷ পুজো শুরুর আগে এখন আমরা প্রতিদিনই প্রতিমা ভাঙচুরের খবর পাচ্ছি৷ এটা থামাবে কে?’’
পুজো উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক চন্দ্রনাথ পোদ্দার বলেন, ‘‘আমরাও আমাদের দিক থেকে নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলার জন্য মণ্ডপগুলোকে ২১ দফা নির্দেশনা দিয়েছি৷ কিন্তু সব মণ্ডপে কি সিসি ক্যামেরা লাগানো সম্ভব? এখানে খরচের বিষয়ও আছে৷ তার কথা, ‘‘সিসি ক্যামেরা, স্বেচ্ছাসেবক না থাকলে হামলা হবে- এটা তো মেনে নেয়া যায় না৷ তাহলে বোঝাই যায় হামলার পরিবেশ আছে৷ আমাদের নিরাপত্তার মধ্যে থাকতে হবে৷’’
তিনি বলেন, ‘‘আমরা সব জেলার পুজো উদযাপন কমিটির নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছি৷ তাদের ২১ দফা নির্দেশনা দিয়েছি৷ আমাদের দিক থেকে যতটুকু ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব, তা নিচ্ছি৷ কিন্তু মূল দায়িত্ব তো রাষ্ট্রের৷’’
ঢাকার ধানমন্ডি এলাকার বাসিন্দা কাকলী মৃধা কলাবাগান মাঠে পুজো বন্ধের সিদ্ধান্তে দুঃখ পেয়েছেন৷ তিনি বলেন, ‘‘বছরের পর বছর আমরা কলাবাগান মাঠে পুজো হতে দেখে এসেছি৷ কিন্তু গত বছর ওই মাঠে পুজো বন্ধ ছিল৷ এবারও হবে না৷ কী কারণে এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে, কারা নিয়েছেন আমরা জানি না৷ তবে আমি দুঃখ পেয়েছি৷’’
তার কথা, ‘‘আমি কলাবাগান মাঠের পুজোয় প্রতি বছর অঞ্জলি দিতাম৷ সেটা আর পারছি না৷ চার-পাঁচটি দিনই তো৷ কী এমন ক্ষতি হতো ওই মাঠের পুজো বন্ধ না করলে!’’
মিরপুর ১০ নাম্বার এলাকায় থাকেন বিপ্লব কুন্ডু৷ তিনি বলেন, ‘‘১০০ মুসলিম পরিবারের মধ্যে এখানে আমি একমাত্র হিন্দু পরিবার৷ এখানে আমি রাজা৷ আমার কোনো সমস্যা নেই৷ কিন্তু সারাদেশের চিত্র কি এরকম?’’
তার কথা, ‘‘আমাদের নিয়ে রাজনীতি করা হচ্ছে৷ আমাদের বলা হচ্ছে তোমাদের সিসি ক্যামেরা রাখতে হবে, ভলান্টিয়ার রাখতে হবে৷ তোমরাই নিরাপত্তার ব্যবস্থা করো, আমরা সহযোগিতা করবো৷ কিন্তু কেন? সব রাজনৈতিক দলই বলে, সাম্প্রদায়িক শক্তি হামলা করতে পারে৷ তাহলে তোমরা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নাও না কেন?’’
বরিশালে উজিরপুরের সাতলা ইউনিয়নের বাসিন্দা অসীম কুমার বালা৷ তিনি জানান, ‘‘আমাদের এলাকা হিন্দু অধ্যুষিত হওয়ায় পুজোর সময় কোনো ঝামেলা হয় না৷ কিন্তু আশপাশে বা সারা দেশে হিন্দুরা যেখানে সংখ্যালঘু, সেখানে সমস্যা হয়৷’’
তার কথা, ‘‘সরকার তো প্রতি বছর নিরাপত্তার আশ্বাস দেয়৷ কিন্তু আমরা তো নিরাপত্তা পাই না৷ যদি অতীতের ঘটনাগুলোর বিচার হতো তাহলে হয়ত বারবার হামলার ঘটনা ঘটতো না৷’’
তিনি মনে করেন, ‘‘সমাজ ও রাষ্ট্রেও উগ্রবাদীরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে৷ প্রশাসনে উগ্রবাদীরা আছে৷’’
হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্তের কথা হলো, ‘‘স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যা বলছেন তার মানে হলো পুলিশ আছে, পুজো আছে৷ পুলিশ নেই, পুজোও নেই৷ এইরকম পরিস্থিতি তো আমরা চাই না৷ পুলিশ পাহারা দিয়ে যদি পুজো উদযাপন করতে হয়, তাহলে পরিস্থিতি কেমন তা বোঝাই যাচ্ছে৷’’
তার অভিযোগ, ‘‘গত দুই সপ্তাহে সারা দেশে প্রতিমা ভাঙচুরের সাত-আটটি ঘটনা ঘটেছে৷ আর গত পুজোর সময় হামলার পর এই এক বছর হিন্দুরা হামলার বাইরে ছিলেন না৷ হামলা তো বন্ধ হয়নি৷ নানা গুজব ছড়িয়ে তো মন্দির, হিন্দুদের বাড়ি-ঘরে অনেক হামলা হয়েছে৷ তাহলে পরিবেশের তো কোনো উন্নতি দেখতে পাচ্ছি না৷’’
আর কাজল দেবনাথ বলেন, ‘‘স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যে নিরাপত্তার কথা বলেছেন, তার ফল তো পুজোয় দেখা যাবে৷ সেটা দেখেই আসলে বলা যাবে আমরা কতটা নিরাপদ ছিলাম৷’’
উল্লেখ্য, বাংলাদেশে ১ অক্টোবর ষষ্ঠী পুজো দিয়ে দুর্গোৎসব শুরু হবে৷ ৫ অক্টোবর বিজয়া দশমীর মধ্য দিয়ে শেষ হবে৷
আপনার মতামত জানানঃ