দক্ষিণ কলকাতার রুবি মোড়ে অখিল ভারত হিন্দু মহাসভার দুর্গাপূজাকে ঘিরে শোরগোল পড়ে গিয়েছে গোটা পশ্চিমবঙ্গে। উত্তপ্ত হচ্ছে রাজনীতিও। হিন্দু মহাসভার পূজা মণ্ডপে যে দুর্গার মূর্তি পূজা করা হচ্ছে, সেখানে মহাত্মা গান্ধীর আদলে তৈরি করা হয়েছে মহিষাসুরকে। আর এ নিয়েই শুরু হয়েছে বিতর্ক। যদিও পরে পুলিশ এসে অসুর বদলে দিয়েছে।
আনন্দবাজার পত্রিকা জানায়, দুর্গাপূজা বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব। এই উৎসবের সঙ্গে আপামর বাঙালির আনন্দ, আবেগ জড়িয়ে রয়েছে। বাঙালিরা মহিষাসুরকে যে আদলে দেখে অভ্যস্ত, হিন্দু মহাসভা ঠিক উল্টো পথে হেঁটে গান্ধীজির আদলে রূপ দিয়েছে মহিষাসুরকে। যা নিয়ে রাজ্য জুড়ে শুরু হয়েছে তর্ক-বিতর্ক, উঠছে সমালোচনার ঝড়।
রবিবার সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে রুবি পার্কের অখিল ভারতীয় হিন্দু মহাসভার দুর্গাপূজার ছবি। সেই ছবিতে দেখা গিয়েছে, দুর্গাপ্রতিমার সঙ্গে যে অসুর রয়েছে তার চেহারার সঙ্গে মিল রয়েছে মহাত্মা গান্ধীর। ঘটনাচক্রে রবিবার মহাত্মা গান্ধীর ১৫৩তম জন্মদিবস পালিত হয়েছে ভারতজুড়ে। ওই দিনটি আন্তর্জাতিক স্তরে অহিংসা দিবস হিসাবেও পালিত হয়ে আসছে ২০০৭ সাল থেকে। এই আবহে রুবি পার্কের ওই পূজা ঘিরে বিতর্ক ওঠে চরমে। এ নিয়ে থানাপুলিশও হয়েছে ইতিমধ্যেই।
বিতর্কের মুখে পড়ে ওই পূজার উদ্যোক্তা চন্দ্রচূড় আনন্দবাজারকে বলেন, ‘‘গান্ধীর মূর্তির সঙ্গে অসুরের মিল আছে। তবে গান্ধীকে অসুর দেখানো হয়নি। মিলটা নিতান্তই কাকতালীয়।’’
তার ব্যাখ্যা, ‘‘আবার এটাও অস্বীকার করছি না, মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীকে জাতির জনক বা জাতির পিতা হিসাবে আমি বা আমরা মানি না। আমরা নেতাজীকে শ্রদ্ধা করি। আমি গত কাল চ্যালেঞ্জও করেছি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে। তিনি গান্ধীর অনুপ্রেরণায় আট বছর চালিয়েছেন বলে দাবি করেছেন। এটা অবিশ্বাস্য।’’
নিজের মতের স্বপক্ষে চন্দ্রচূড়ের দাবি, ‘‘গান্ধীর নাম জড়িয়েছে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের পরিচয় পুলিশের সামনে এনে দেওয়া, কংগ্রেস থেকে নেতাজীকে বিতাড়িত করার ক্ষেত্রে। ভগৎ সিংহের ফাঁসির ক্ষেত্রেও গান্ধীর অত্যন্ত ন্যক্কারজনক ভূমিকা রয়েছে। তিনি জাতির জনক কেন হতে যাবেন? যে দেশের ৩০-৪০ হাজার বছরের ঐতিহ্য। যে মাটিতে রামকৃষ্ণ, রামচন্দ্র, কৃষ্ণ, চৈতন্যদেব জন্মগ্রহণ করেছেন তার জনক গান্ধী কেন? এটা আমরা স্পষ্ট ভাবে, দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছি। কোনও এক জন টাকমাথা লোক, চোখে চশমা থাকলেই তিনি গান্ধী হয়ে গেলেন? তাকে নিয়ে এত বিতর্ক?”
“অথচ ৯৯.৯৯ শতাংশ মানুষ বলেছেন আপনারা খুব ভাল কাজ করেছন। আমরা নেতাজি-প্রেমী। আমরা গান্ধীকে ঘৃণা করি। এটা দুর্ভাগ্যজনক যে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। আমি এ সবে ভয় পাই না। আমরা মূর্তি বদল করিনি। পুলিশ এসে কুমোর এনে ওই মূর্তিতে গোঁফ লাগিয়েছে। আমাদের অনিচ্ছাসত্ত্বেও এই পরিবর্তন করা হয়েছে।’’
যে মাটিতে রামকৃষ্ণ, রামচন্দ্র, কৃষ্ণ, চৈতন্যদেব জন্মগ্রহণ করেছেন তার জনক গান্ধী কেন? এটা আমরা স্পষ্ট ভাবে, দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছি। কোনও এক জন টাকমাথা লোক, চোখে চশমা থাকলেই তিনি গান্ধী হয়ে গেলেন? তাকে নিয়ে এত বিতর্ক?
তবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নেই এর প্রতিবাদ। ফলে কলকাতার এবারের দুর্গাপূজা পরিণত হয়েছে রাজনৈতিক পরিসর। যা দেশটির কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
এই ঘটনা কলকাতায় আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। সময়মতো বাধা না দেওয়ার জন্য তৃণমূল কংগ্রেসের সাবেক এমপি, কবি ও সংগীতশিল্পী কবীর সুমন ঘটনার প্রতিবাদ করেছেন।
তিনি লিখেছেন, ‘চলতি দুর্গাপূজায় কারা যেন রাস্তা দিয়ে দল বেঁধে যেতে যেতে “জয় শ্রীরাম” স্লোগান দিয়েছে চিৎকার করে। পুলিশ কি তা শুনবেন না বলেই ঠিক করেছেন, যেহেতু “সব আরএসএস খারাপ নয়”?’ বস্তুত কবীর সুমন এখানে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেই আক্রমণ করেছেন। মমতা কিছুদিন আগে বলেছিলেন হিন্দু জাতীয়তাবাদী সংগঠন ‘আরএসএস খারাপ নয়।’ সুমন আরও বলেছেন, ‘মহাত্মা গান্ধীকে অসুর সাজানোর ব্যাপারটি জেনে পার্লএসবাকের একটি উক্তি মনে পড়ল: হে ভারত, গান্ধীর যোগ্য হয়ে ওঠার সাহস অর্জন করো।’
প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী বলেছেন, স্বাধীনতার সময়ে গান্ধীজী বেলেঘাটায় অনশন করেছিলেন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা থামানোর জন্য। সেই গান্ধীকে কলকাতার বুকে অপমান করা হলো? কোন বার্তা দেওয়া হচ্ছে হিন্দু মহাসভার পক্ষ থেকে?
এদিকে সিপিআইএমের (কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া মার্ক্সিস্ট) পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, হাওড়ার চ্যাটার্জিহাটে একটি দলীয় বুক স্টল ভেঙে দেওয়া হয়েছে। পূজা উপলক্ষে দেওয়া ওই অস্থায়ী বামপন্থী বই বিক্রির দোকানটিতে একটি পোস্টারে লেখা ছিল, ‘আমরা বই বিক্রি করি, চাকরি বিক্রি করি না’। দক্ষিণ কলকাতার রাসবিহারী অঞ্চলেও একই ঘটনা ঘটেছে বলে সিপিআইএম দলের তরফে জানানো হয়েছে।
অন্যদিকে উত্তর কলকাতার লেবুতলা পার্কের বড় একটি পূজার আলোকসজ্জা পুলিশ বন্ধ করে দিয়েছে অত্যধিক ভিড় হওয়ার কারণে। পূজাটি প্রধান উদ্যোক্তা বিজেপির এক মিউনিসিপাল কাউন্সিলর সজল ঘোষ। তিনি অভিযোগ করেছেন, তৃণমূল কংগ্রেস দুর্গাপূজা নিয়ে রাজনীতি করছে এবং পুলিশ ভিড় সামলাতে না পেরে তার পূজার আলোকসজ্জা বন্ধ করে দিয়েছে। তৃণমূল কংগ্রেস এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
তবে এর পাশাপাশি আরও বেশ কিছু পূজা নিয়ে বিতর্ক হয়েছে। অধিকাংশ বড় পূজাই এখন কোনো না কোনো নামকরা তৃণমূল নেতার পূজা বলে স্বীকৃত। এই বিষয় নিয়েও কয়েক বছর ধরেই প্রশ্ন তুলছেন সাধারণ মানুষ। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেও দেখা যাচ্ছে শয়ে শয়ে পূজার উদ্বোধন করতে। এভাবে পূজার রাজনীতিকীকরণ করা উচিত কি না, প্রশ্ন উঠছে, তা নিয়েও।
খোদ মুখ্যমন্ত্রী যদি পূজার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়েন তাহলে পূজার অবশ্যই রাজনীতিকীকরণ ঘটে এবং গান্ধীকেও তার জেরে অসুর হতে হয়, বক্তব্য পূজা দেখতে বেরোনো সাধারণ মানুষেরই।
সব বড় পূজাই যদি কোনো না কোনো রাজনৈতিক নেতার হয়, সব দলই নির্দিষ্ট পূজাকে তাদের পূজা হিসেবে চিহ্নিত করবেন এবং করছেনও। ফলে ভবিষ্যতে দলমত নির্বিশেষে নির্দিষ্ট পূজাতে যোগ দেওয়া যাবে কি না, তা নিয়েও বিতর্ক হচ্ছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫০৩
আপনার মতামত জানানঃ