দূষিত, বিষাক্ত ও বিপজ্জনক বাতাসে শ্বাস নিচ্ছেন ঢাকার মানুষ। ঝুঁকিপূর্ণ বাতাসের তালিকার বিশ্ব র্যাঙ্কিংয়ে ২০১৮ সাল থেকেই শীর্ষস্থান ধরে রেখেছে বাংলাদেশ ও রাজধানী ঢাকা।
গত কয়েক বছরে সবচেয়ে দূষিত বাতাসের শহরের তালিকায় প্রথম বা দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা ঢাকা অনেকটা ঘুরে দাঁড়ায় চলতি বছরে। এ বছরের জুলাইয়ে নির্মল বায়ুর শহরে নাম লিখিয়েছিল রাজধানী শহর ঢাকা। ওই মাসে ঢাকায় বায়ুর মানের সূচক ৫০ এর নিচে নামে; বেশিরভাগ সময়ে যা ২০০ এর বেশি থাকে।
করোনার প্রভাবে সারা দেশে সরকার ঘোষিত বিধিনিষেধ থাকায় নির্মল বায়ু পাওয়া সম্ভব হয়েছিল সে সময়। কিন্তু কয়েক মাস যেতে না যেতেই আবার পুরোনো ধারায় ফিরতে শুরু করেছে ঢাকার বায়ুর মান। এগিয়ে যাচ্ছে দূষিত বায়ুর শহরের তালিকার উপরের দিকে। গত কয়েক দিনের পর্যবেক্ষণে এমনটাই দেখা গেছে।
জুলাই মাসে ঢাকা দূষিত নগরীর তালিকায় ২৩তম স্থানে ছিল, বর্তমানে উঠে এসেছে অষ্টম স্থানে। ১৪ অক্টোবর এই চিত্র দেখা গেছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বিশ্বের বায়ুর মান যাচাই বিষয়ক প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ‘আইকিউএয়ার’-এ। অর্থাৎ এ দিনের হিসাব অনুযায়ী, ঢাকার চেয়ে বেশি দূষিত বাতাস রয়েছে বিশ্বের মাত্র সাতটি শহরে।
আইকিউএয়ারের তথ্য অনুযায়ী, অক্টোবর মাসের ৫ তারিখ থেকে ১৪ তারিখ এই ১০ দিনে ঢাকা শহরে গড়ে বায়ুর মানমাত্রা ছিল ১৬২.৮ মাইক্রো গ্রাম; যা মানমাত্রার নির্দেশনা মতে ‘অস্বাস্থ্যকর’ বলে গণ্য করা হয়।
বিশেষজ্ঞদের তথ্য অনুযায়ী, বায়ুর মান সূচকে শূন্য থেকে ৫০ মাইক্রোগ্রাম পর্যন্ত ‘ভালো’। ৫১ থেকে ১০০ হলো ‘পরিমিত’, ১০১ থেকে ১৫০ ‘সংবেদনশীল গোষ্ঠীর জন্য অস্বাস্থ্যকর’, ১৫১ থেকে ২০০ ‘অস্বাস্থ্যকর’, ২০০ থেকে ৩০০ ‘খুবই অস্বাস্থ্যকর’ এবং ৩০১ মাইক্রোগ্রাম ছাড়িয়ে গেলে সেটা ‘বিপজ্জনক’ বলে গণ্য করা হয়।
বায়ুদূষণ বাড়ার জন্য যে কারণগুলোকে বিশেষজ্ঞরা চিহ্নিত করছেন তার মধ্যে রয়েছে— প্রাকৃতিক কিছু বিষয় (আবহাওয়া ও জলবায়ু), নগর পরিকল্পনার ঘাটতি, আইনের দুর্বলতা বা সীমাবদ্ধতা, আইন প্রয়োগে সীমাবদ্ধতা, ভৌগোলিক কারণ এবং জনসংখ্যার ঘনত্ব। আর বায়ুদূষণের উৎস হিসেবে তারা চিহ্নিত করছেন— সমন্বয়হীন রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি, রাস্তায় চলাচলরত গাড়ির কালো ধোঁয়া, ব্ল্যাক কার্বন, কার্বন মনোক্সাইড, ইটের ভাটা ও শিল্প কারখানা, উন্মুক্তভাবে আবর্জনা পোড়ানো, বস্তি এলাকায় বর্জ্য পোড়ানো এবং আন্তঃদেশীয় বায়ুদূষণ।
এ দফায় ঢাকার বায়ুর মান কমার বিষয়ে জানতে চাইলে বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার অনলাইনভিত্তিক এক সংবাদমাধ্যমকে বলেন, সাধারণত কিছু ইভেন্টের আগে বায়ুদূষণ বেড়ে যায়। যেমন ঈদ-পূজা। এছাড়া অন্যান্য উৎসবের সময় মানুষের চলাচল বেড়ে যায়। আর বর্তমানে খুব গরম পড়েছে। প্রচণ্ড রোদের কারণে সবকিছু শুকিয়ে গেছে। যার ফলে বাতাসে ধুলোবালি বেশি উড়ছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলেছে। যার ফলে মানুষের চলাচল বেড়েছে। অন্যদিকে ঢাকামুখী মানুষের যে চাপ আগে ছিল, সেটা আবারও ফিরে এসেছে। এজন্য বায়ুর মান খারাপ হতে পারে।
তিনি আরও বলেন, বর্তমানে কনস্ট্রাকশনের কাজ পুরোদমে চলছে। বর্ষাকালে যে কাজগুলো মোটামুটি বন্ধ থাকে, তার সবই এখন শুরু হয়েছে। এখান থেকে ধূলো বাতাসে ওড়ে। এছাড়া অক্টোবর থেকে ইট উৎপাদন শুরু হয়। সেখানে প্রচুর ধোঁয়া তৈরি হয়। এটিও বায়ূদূষণের অন্যতম কারণ।
আইকিউএয়ারের তথ্য অনুযায়ী, অক্টোবর মাসের ৫ তারিখ থেকে ১৪ তারিখ এই ১০ দিনে ঢাকা শহরে গড়ে বায়ুর মানমাত্রা ছিল ১৬২.৮ মাইক্রো গ্রাম; যা মানমাত্রার নির্দেশনা মতে ‘অস্বাস্থ্যকর’ বলে গণ্য করা হয়।
এর আগে সুইজারল্যান্ডভিত্তিক বায়ুর মান পরিমাপকারী সংস্থা আইকিউএয়ারের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বায়ুদূষণের দিক থেকে গত তিন বছরের মতো এবারও বিশ্বের শীর্ষস্থান ধরে রেখেছে বাংলাদেশ। রাজধানী ঢাকাও বিশ্বের দূষিত বায়ুর শহরগুলোর মধ্যে বরাবরের মতোই দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে।
আইকিউএয়ার জানিয়েছে, গত বছর সামগ্রিক বায়ু মান বিবেচনায় বাংলাদেশের বায়ুতে প্রাণঘাতী পার্টিকুলেট ম্যাটার বা পিএম-২.৫ এর উপস্থিতি প্রতি ঘনমিটারে ছিল ৭৭ দশমিক ১ শতাংশ; যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বেঁধে দেওয়া সীমার চেয়ে সাতগুন বেশি।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা সংস্থা হেলথ ইফেক্টস ইনস্টিটিউটের তথ্যমতে, দেশে বায়ুদূষণের কারণে প্রতি বছর প্রাণ হারাচ্ছে ১ লাখ ২২ হাজার ৪০০ মানুষ। অন্যদিকে বিশ্বব্যাংকের ২০১৮ সালের তথ্য অনুযায়ী, দেশে বায়ুদূষণজনিত বার্ষিক মৃতের গড় সংখ্যা ৪৬ হাজার। অন্যদিকে জাতিসংঘ শিশু তহবিলের (ইউনিসেফ) তথ্য বলছে, বিশ্বে ৩০ কোটি শিশু দূষিত বায়ু পরিবেষ্টিত এলাকায় বাস করে। এর মধ্যে ২২ কোটিই দক্ষিণ এশিয়ার বাসিন্দা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নগরবাসীর কাছে যানজটের পাশাপাশি আরেক যন্ত্রণার নাম বায়ুদূষণ। মাত্রাতিরিক্ত দূষণের কবলে নগরজীবন বিভীষিকাময় হয়ে উঠেছে। বাড়িয়ে তুলছে স্বাস্থ্যঝুঁকি। সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে শিশু, বৃদ্ধ ও শ্বাসতন্ত্রের রোগীরা।
প্রতিনিয়ত বায়ুদূষণে ফুসফুসের অক্সিজেন গ্রহণক্ষমতা কমে শ্বাসকষ্ট ক্রমাগত বাড়ে বলে জানান সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেন, প্রথমে শ্বাসনালি ও চোখে সমস্যা তৈরি করে। ফলে অ্যাজমা ও নিউমোনিয়ার রোগীর সংখ্যা বেড়ে চলেছে বলে উল্লেখ করেন। এছাড়া দীর্ঘমেয়াদে এ দূষিত বায়ু গ্রহণ ব্রঙ্কাইটিস থেকে ফুসফুস ক্যান্সারের কারণ হতে পারে বলে উল্লেখ করেন। এদিকে বায়ুদূষণের কারণে ক্রনিক অবস্ট্রাক্টিভ পালমোনারি ডিজিজ (সিওপিডি) বেশি দেখা দেয় বলে জানান বিশেষজ্ঞরা।
দূষণের মাত্রা দিন দিন বেড়ে চললেও কর্তৃপক্ষ কার্যত কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না এমন অভিযোগ রয়েছে পরিবেশবিদদের। ঢাকার উন্নয়ন প্রকল্পকে ঘিরে সকাল-বিকাল পানি ছিটানো হলেও আশানুরূপ ফল দৃশ্যমান নয়। এ অবস্থায় সিটি করপোরেশনের পানি ছিটানোর কাজে সার্বক্ষণিক তদারক এবং বাতাসের মান স্বাভাবিক ও জীবনযাত্রায় স্বস্তি ফেরাতে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার কথা বলছেন সংশ্লিষ্টরা। দূষণের মাত্রা যেভাবে বেড়েছে তা নিয়ন্ত্রণ করতে হলে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে গাড়ির কালো ধোঁয়া কমানো ও অপরিকল্পিত নির্মাণকাজের লাগাম টেনে ধরা প্রয়োজন বলে মনে করেন অনেকে।
সংশ্লিষ্টরা বলেন, পরিবেশ রক্ষা করতে হলে মোটাদাগে যানবাহন, নির্মাণ শিল্প ও কল-কারাখানার দূষণ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এর মধ্যে বায়ুদূষণকে প্রাধান্য দিয়ে কাজ করতে হবে। সামগ্রিকভাবে সারা দেশকে দূষণের জন্য বিবেচনা করা হলেও রাজধানীর দূষণ এ সূচককে বাড়িয়ে দিচ্ছে বলে মনে করেন তারা। বর্তমান সময়ে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের দূষণকে নিয়ন্ত্রিত পর্যায়ে রাখার পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার আলোকে ঢাকাসহ সারা দেশের বায়ুমান নিয়ন্ত্রণ করার পরামর্শ দেন তারা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ছয় ধরনের পদার্থ এবং গ্যাসের কারণে ঢাকায় দূষণের মাত্রা সম্প্রতি অনেক বেড়ে গেছে। এরমধ্যে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ধূলিকণা অর্থাৎ পিএম ২ দশমিক ৫-এর কারণেই ঢাকায় দূষণ অতিমাত্রায় বেড়ে গেলেই পরিস্থিতি নাজুক হয়ে উঠছে। ঢাকার বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে গর্ভবতীদের বিরাট স্বাস্থ্য ঝুকির মধ্যে থাকতে হয়। অতিমাত্রায় বায়ুদূষণের কারণে অনেকক্ষেত্রে বিকলাঙ্গ শিশুর জন্ম হয়।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২০৪৫
আপনার মতামত জানানঃ