ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পর ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় মানবিক পরিস্থিতি এখন ভয়াবহ। সংঘাতে পর মানুষের জীবন আরও বিপর্যস্ত হয়ে উঠেছে। পানি, বিদ্যুৎ, খাদ্য ও চিকিৎসাসহ নানা সমস্যায় মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে গাজাবাসী। জাতিসংঘের ত্রাণ পৌঁছাতে শুরু করলেও, সেখানেও বাধা দিচ্ছে ইসরায়েল।
অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় এক রকম বন্দি জীবনযাপন করছেন নিরীহ ফিলিস্তিনিরা। দীর্ঘ এক যুগেরও বেশি সময় যাবত উপত্যকাটিকে অবরুদ্ধ করে রেখেছে দখলদার রাষ্ট্র ইসরায়েল। সেখানকার বাসিন্দাদের এখনো নেই অনেক মৌলিক অধিকার। এর মধ্যেই উঠে এসেছে চাঞ্চল্যকর নতুন তথ্য। আর তা হচ্ছে— অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকার ৯৭ শতাংশ পানিই দূষিত, যা পুরোপুরি পানের অযোগ্য। মূলত দখলদার ইসরায়েলের বাধার কারণে পরিষ্কার পানি পানের সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে গাজা উপত্যকার অধিবাসীরা।
এর ফলে ধীরে ধীরে বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছেন উপত্যকাটির নারী-শিশুসহ ২০ লাখ মানুষ। মঙ্গলবার (১২ অক্টোবর) প্রতিবেদন প্রকাশের মাধ্যমে তথ্যটি জানিয়েছে কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরা।
গাজার অধিকাংশ মানুষকে বেসরকারি কোম্পানিগুলো থেকে পানি কিনে খেতে হয়। বিদ্যুৎ সংকটের ফলে পৌরসভার পানির লাইনে প্রায়ই পানি থাকে না। মাঝে মধ্যে পানি পাওয়া গলেও তা পান করার উপযোগী থাকে না।
গাজা উপত্যকার পানি অনেক বেশি দূষিত যা জনস্বাস্থ্যের ওপর মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে, বিশেষ করে শিশুদের ওপর। তারা বিভিন্ন পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। ইসরায়েলের অবরোধ, মানবিক সহায়তা কমিয়ে দেওয়া এবং ক্রমাগত বিমান হামলার কারণে গত কয়েক বছরে পানির এই সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে।
গেল সোমবার অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের ৪৮তম অধিবেশনে গ্লোবাল ইনস্টিটিউট ফর ওয়াটার, এনভাইরনমেন্ট অ্যান্ড হেলথ এবং ইউরো-মেডিটেরিনিয়ান হিউম্যান রাইটস মনিটর বিবৃতি পাঠিয়েছে। সেখানে তারা জানায়, ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকার পানি পান করার অযোগ্য এবং যা ধীরে ধীরে গাজার মানুষকে বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত করছে।
যৌথ বিবৃতিতে সংস্থা দুটি জানিয়েছে, গাজা ভূখণ্ডে দীর্ঘদিন যাবত ইসরায়েলি অবরোধ জারি থাকায় উপত্যকাটির পানি ব্যবস্থাপনার মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে। ফলে ভূখণ্ডটির ৯৭ শতাংশ পানিই এখন দূষিত পানিতে পরিণত হয়েছে।
বিবৃতিতে আরও দাবি করা হয়, এই পানি পান করতে এবং শিশু ও প্রিয়জনদেরকে ধীরে ধীরে বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হওয়া প্রত্যক্ষ করতে কার্যত বাধ্য হচ্ছেন গাজার নিরীহ ফিলিস্তিনিরা। এছাড়া মানবাধিকার সংগঠনগুলোও বছরের পর বছর গাজার খাবার পানীয় পরিস্থিতির অবনতির বিষয়ে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে আসছে।
আল-জাজিরা জানিয়েছে, লোডশেডিংয়ের কারণে দীর্ঘ সময় ধরে গাজা পৌর কর্তৃপক্ষের কলগুলো দিনের লম্বা সময় ধরে অকার্যকরই থাকে। আবার এসব কল থেকে পানি আসলেও তা এতোটাই লবণাক্ত থাকে যে, সেই পানি কার্যত কেউই পান করতে পারছেন না। আর তাই গাজার বহু বাসিন্দা বেসরকারি সরবরাহকারীদের কাছ থেকে বেশি দামে পানি ক্রয় করতে বাধ্য হচ্ছেন।
বিশ্লেষকদের মতে, গাজার প্রচণ্ড দূষিত এই পানি উপত্যকাটির বাসিন্দাদের স্বাস্থ্যের ওপরও মারাত্মকভাবে বিরূপ প্রভাব ফেলছে। বিশেষ করে ফিলিস্তিনি শিশুরা গুরুতর পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছেন।
গাজার আল-শাতি শরণার্থী শিবিরের বাসিন্দা ৩৬ বছর বয়সী ফিলিস্তিনি নারী ফালিসতিন আবদেলকারিম আল-জাজিরাকে জানান, এলাকার পানি পুরোপুরি পানের অযোগ্য। পানির স্বাদে মনে হয় এটি সমুদ্র থেকে আনা হয়েছে। আমরা এই পানি পান করা, রান্না করা এমনকি গোসলের কাজেও ব্যবহার করতে পারি না।
গাজা উপত্যকার পানি অনেক বেশি দূষিত যা জনস্বাস্থ্যের ওপর মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে, বিশেষ করে শিশুদের ওপর। তারা বিভিন্ন পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। ইসরায়েলের অবরোধ, মানবিক সহায়তা কমিয়ে দেওয়া এবং ক্রমাগত বিমান হামলার কারণে গত কয়েক বছরে পানির এই সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে।
পাঁচ সন্তানের জননী এই নারী দাবি করেছেন, শরণার্থী শিবিরে আমাদের জীবন খুবই দুর্দশাপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাধ্য হয়ে আমাদেরকে বিক্রেতাদের কাছ থেকে পানি কিনে ব্যবহার করতে হয়।
গাজার উত্তরাঞ্চলীয় আল-শেখ রেদওয়ান এলাকার বাসিন্দা মোহাম্মদ সালিম আল-জাজিরার প্রতিবেদকের কাছে বলেছেন, আমি আমার বাড়ির আঙিনায় বাগান তৈরি করতে কয়েকবার চেষ্টা করেছি। কিন্তু পানি খুব বেশি দূষিত হওয়ার কারণে আমি বার বার তাতে ব্যর্থ হয়েছি।
তিনি আরও বলেন, পানিতে লবণ ও ক্লোরাইডের পরিমাণ এতটাই বেশি যে আমার সব গাছই শুকিয়ে মরে গেছে।
গাজায় বসবাস করে প্রায় ২০ লাখ মানুষ। এই এলাকা দৈর্ঘ্যে ৪১ কিলোমিটার আর প্রস্থে ১০ কিলোমিটার। এর চারপাশ ঘিরে আছে ভূমধ্যসাগর, ইসরায়েল আর মিসর।
অবরুদ্ধ গাজায় টানা ১১ দিন ইসরায়েল এবং ফিলিস্তিনের ইসলামী প্রতিরোধ আন্দোলন হামাসের মধ্যে তীব্র লড়াই চলার পর আনুষ্ঠানিক যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করা হয়। গত বেশ কয়েক বছরের মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক এই লড়াইয়ের তীব্রতার কারণে জাতিসংঘ ‘পুরো মাত্রার যুদ্ধ বাধার’ আশঙ্কা প্রকাশ করেছিল।
শুরুতে গাজা ছিল মিসর অধিকৃত। ১৯৬৭ সালের মধ্যপ্রাচ্য যুদ্ধের সময় ইসরায়েল গাজার দখল নেয়। পরে ২০০৫ সালে ইসরায়েল সেখান থেকে তাদের সৈন্য এবং প্রায় ৭ হাজার বসতি স্থাপনকারীকে সরিয়ে নেয়।
গাজা এখন নিয়ন্ত্রণ করছে হামাস। ২০০৭ সালে তৎকালীন ক্ষমতাসীন ফিলিস্তিনি প্রশাসনের ভেতর চরম মতভেদের পর হামাস গাজার নিয়ন্ত্রণ হাতে নেয়।
এরপর থেকে ইসরায়েল এবং মিসর গাজার ভেতর থেকে মালামাল এবং মানুষের চলাচলের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। তাদের দাবি, জঙ্গীদের বিরুদ্ধে নিরাপত্তা ব্যবস্থা হিসাবে এই বিধিনিষেধ জারি করা হয়েছে।
হামাস এবং ইসরায়েলের মধ্যে একটা স্বল্পস্থায়ী লড়াই হয়েছিল ২০১৪ সালে। আর চলতি বছর মে মাসে দুই পক্ষের মধ্যে সহিংস লড়াই তীব্র মাত্রা নিয়েছে।
অধিকৃত পূর্ব জেরুসালেমে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনিদের মধ্যে কয়েক সপ্তাহ ধরে উত্তেজনা বাড়ার পটভূমিতে গাজায় সর্বসাম্প্রতিক ১১দিনের রক্তক্ষয়ী এই লড়াই শুরু হয়। এর জেরে সংঘর্ষ হয়েছে শহরে মুসলিম ও ইহুদিদের পবিত্র স্থানে।
হামাস ইসরায়েলকে সেখান থেকে সরে যাবার হুঁশিয়ারি দেবার পর ১০ মে ইসরায়েলকে লক্ষ্য করে রকেট নিক্ষেপ শুরু করলে ইসরায়েল পাল্টা বিমান হামলা চালায়। দুই পক্ষের লড়াই এতটাই তীব্র হয়ে ওঠে যে, দ্রুত সহিংসতার মাত্রা ২০১৪ সালে ইসরায়েল ও গাজার লড়াইকে ছাপিয়ে যায়। এমনিতেই গাজার বাসিন্দারা নানা ধরনের সমস্যায় রয়েছে তার মধ্যে দু’পক্ষের এই সংঘাতে সাধারণ মানুষের জীবন আরও বিপর্যস্ত হয়ে উঠেছে।
গাজার বেশিরভাগ মানুষ পানি সঙ্কটে দিন কাটাচ্ছে। কলের পানি লবণাক্ত এবং দূষিত হওয়ায় তা পানের উপযোগী নয়। গাজার বাসিন্দাদের একটা বড় অংশের বাসায় পাইপ লাইনে পানির সংযোগ থাকলেও জাতিসংঘের ওচা বলছে, পরিবারগুলো পানি পায় অনিয়মিতভাবে। ২০১৭ সালে পরিবারগুলো কলের পানি পেত প্রতি চারদিন অন্তর মাত্র ৬ থেকে ৮ ঘন্টার জন্য। এর কারণ ছিল পানি পাম্প করার জন্য বিদ্যুতের অভাব।
সর্বসাম্প্রতিক এই লড়াইয়ের ফলে এই সমস্যা আরও সঙ্গিন হয়েছে। পানির সরবরাহ আরও কমে গেছে বিদ্যুতের অভাবে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, তারা মাথা পিছু প্রতিদিন ১শ লিটার পানির নূন্যতম একটা বরাদ্দ বেঁধে দিয়েছিল। এই বরাদ্দ ছিল খাওয়া, রান্না ও গোসল করার প্রয়োজন মেটানোর জন্য নূন্যতম বরাদ্দ। গাজায় পানি ব্যবহারের প্রয়োজনীয় গড় পরিমাণ মাথা পিছু প্রায় ৮৮ লিটার।
সেখানে পয়ঃনিষ্কাশনও আরেকটা বড় সমস্যা। ৭৮ শতাংশ বাসাবাড়ি পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার সাথে যুক্ত থাকলেও বর্তমান ব্যবস্থা তা সামাল দিতে অক্ষম। ওচা বলছে, প্রতিদিন ১০ কোটি লিটার অপরিশোধিত অথবা আংশিক পরিশোধিত বর্জ্য ভূমধ্যসাগরে গিয়ে পড়ছে। সমস্যা মোকাবেলার জন্য চলতি বছরের গোড়ার দিকে নতুন একটি বর্জ্য পরিশোধন প্লান্ট বসানো হয়েছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭২৬
আপনার মতামত জানানঃ