কেবল ২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্রে খুন হয়েছেন ২১ হাজার ৫০০ জন, ২০১৯ সালের তুলনায় যা প্রায় ৩০ শতাংশ বেশি। শুধু খুন নয়, যুক্তরাষ্ট্রে অস্ত্র বিক্রির সংখ্যাও আগের চেয়ে বেড়েছে। আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে খুনের সংখ্যা বেড়েছে বলে জানিয়েছে মার্কিন তদন্ত সংস্থা এফবিআই।
এফবিআইয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়, ৭৭ শতাংশ মানুষ খুন হয়েছেন বন্দুকের গুলিতে, ২০১৯ সালে যা ৭৪ শতাংশ ছিল। সহিংস অপরাধের সংখ্যা ২০১৯ সালের চেয়ে ৫ দশমিক ৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
এফবিআইয়ের ‘ইউনিফর্ম ক্রাইম রিপোর্ট’ নামের ওই প্রতিবেদনে দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণাংশে অপরাধের প্রবণতা আগের চেয়ে বেড়েছে। অস্ত্র বিক্রির হার সবচেয়ে বেশি টেক্সাসে।
বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, করোনাকালে মানুষের মধ্যে হতাশা বেড়েছে। সে কারণেই অস্ত্র বিক্রির হার একদিকে যেমন বেড়েছে, তেমন বেড়েছে সহিংসতার হারও। কিন্তু কীভাবে এই প্রবণতাকে বদলানো সম্ভব, তা নিয়ে কোনো স্পষ্ট অভিমতে পৌঁছাতে পারেননি বিশেষজ্ঞরা।
ভোটপ্রচারের সময় মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছিলেন, অস্ত্র বিক্রি নিয়ে তার প্রশাসন কড়া পদক্ষেপ নেবে। ক্ষমতায় আসার পর এখনো সে বিষয়ে বাইডেন প্রশাসন তেমন কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। এফবিআইয়ের প্রতিবেদন সরকারকে ব্যবস্থা নিতে বাধ্য করে কি না, সেটাই এখন দেখার।
প্রতিবেদনে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রে ২০২০ সালে ১২ লাখ ৭৭ হাজার ৬৯৬টি সহিংস অপরাধের ঘটনা ঘটেছে। তবে বছরটিতে ডাকাতি (৯ দশমিক ৩ শতাংশ) ও ধর্ষণের (১২ শতাংশ) ঘটনা কমেছে।
ইউএসএ টুডের খবরে বলা হয়, করোনা ভাইরাস যখন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন অংশে প্রাণহানী ঘটাচ্ছিল, ঠিক তখনই দেশজুড়ে ঘটছিল নানা সহিংস ঘটনা।
যুক্তরাষ্ট্রের নর্থইস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক জেমস অ্যালান ফক্স মনে করেন, গত বছরটির ঘটনাপ্রবাহ সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিস্তার করবে না।
তিনি বলেন, ‘গত বছরটি নানা কারণেই আলাদা।’ ফক্স বলেন, ‘মহামারির কারণে লোকজন নির্ধারিত কাজকর্মে যেতে পারেনি; শিশুরা যায়নি স্কুলে এবং প্রাপ্ত বয়স্করা তাদের কাজে।’ তিনি বলেন, ‘রাজনীতি, করোনা মোকাবেলা ও সামাজিক ন্যায়বিচারের আন্দোলনে বিভাজিত ছিল পুরো দেশ।’
অধ্যাপক জেমস অ্যালান ফক্স বলেন, এ পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রে বন্দুকের বিক্রি বেড়ে গিয়েছিল। তিনি বলেন, ‘ক্রোধের উত্তাপে সেই বন্দুকগুলোই ব্যবহার করা হয়েছে।’
প্রতিবেদন প্রকাশের সময় অবশ্য এফবিআই আরও একটি বিষয় জানিয়েছে। গত কয়েক বছরের তুলনায় ২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্রে খুনের সংখ্যা বাড়লেও তা ১৯৮০-৯০ সালের খুনের সংখ্যার চেয়ে অনেক কম। ১৯৯১ সালে এক বছরে রেকর্ড ২৫ হাজার জন নিহত হন।
২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্রে খুন হয়েছেন ২১ হাজার ৫০০ জন, ২০১৯ সালের তুলনায় যা প্রায় ৩০ শতাংশ বেশি। শুধু খুন নয়, যুক্তরাষ্ট্রে অস্ত্র বিক্রির সংখ্যাও আগের চেয়ে বেড়েছে।
কিন্তু কেন হয় এমন হত্যাকাণ্ড? বিবিসি সেই কারণ অনুসন্ধানে জানা গেছে, উন্নত প্রযুক্তির দ্রুতগতির অস্ত্রগুলোই এর জন্য দায়ী। এছাড়া দেশটির সহজ অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ আইনও এজন্য দায়ী।
হারভার্ড স্কুল অব পাবলিক হেল্থের কর্মকর্তা উন্নত প্রযুক্তির দ্রুতগতির অস্ত্রগুলোকে এর জন্য দায়ী করেছেন। তার মতে, এতে কম সময়ে বেশিগুলি করা যাচ্ছে। এক অস্ত্রেই অনেক মানুষ মারা যাচ্ছে।
১৯৯৪ সালে সেমি অটোমেটিক, উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন অস্ত্রগুলোর ওপর মার্কিন সরকার নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছিল। কিন্তু ২০০৪ সালে তা তুলে নেওয়া হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ আইন তুলে নেওয়ায় বন্দুক হামলার নতুন যুগ শুরু হয়। এসব অস্ত্রের মাধ্যমে দ্রুত গতিতে এবং বেশি সময় ধরে অনেক মানুষকে মারতে পারছে দুষ্কৃতিকারীরা। এসব হামলার কোনোটা আবার এশীয়-আমেরিকানদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষের কারণে ঘটেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
আক্রমণকারীরা মানুষের ভিড় আছে এমন জায়গাগুলো বেছে নিচ্ছে। এমন ভিড় যেখানে কোথাও নির্দিষ্ট লক্ষ্য তাক করতে হয় না। এমনটাই বলছেন ইউনিভার্সিটি অব সেন্ট্রাল ফ্লোরিডার জে করজিন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বন্দুক হামলার উদ্দেশ্য খুঁজে বের করা কঠিন এবং কঠোর নীতি প্রণয়ন করাও কঠিন। কিন্তু বন্দুক হামলার সুযোগ বন্ধ করা তেমন কঠিন নয়। শ্বেতাঙ্গদের শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার সারা দুনিয়াতেই আছে এবং আছে তাদের সহিংস ইচ্ছার বাহার। কিন্তু একজন সহিংস মানুষের হাতে রান্না করার ছুরি বা বেসবল খেলার ব্যাট হাতে যতটা না ভয়ংকর তারচেয়ে অনেক বেশি ভয়ংকর স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র হাতে। কারণ চোখের পলকেই সে ১০০ রাউন্ড গুলি ছুঁড়তে সক্ষম। আর এ পদ্ধতিটি সন্দেহাতীতভাবে লোভনীয়।
তারা বলেন, কথা খুব স্পষ্ট যে, স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের মালিকানা নিয়ে ক্রাইস্টচার্চ হামলার পর নিউজিল্যান্ড যে ধরণের নীতি গ্রহণ করেছে, একই রকম নীতি গ্রহণ করলে যুক্তরাষ্ট্রে বন্দুক হামলার ঘটনা কমতে পারে। কিন্তু এভাবে সব বন্দুক হামলায় মৃত্যু রোধ করা সম্ভব হবে না। যেমন সম্ভব হবে না সংবিধান সংশোধন করার মাধ্যমেও। যুক্তরাষ্ট্রের বন্দুক হামলার সমস্যা, ব্রাজিলের বন উজাড় হওয়া বা চীনের বায়ু দূষণের মতোই ভয়াবহ। মানবসৃষ্ট পরিবেশ বিপর্যয় বন্ধ করা কঠিন এবং রাতারাতি পরিবর্তন সম্ভবও নয়। তবে তাই বলে সাহসী মানুষের অভিযাত্রা থেমে থাকবে কেন?
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩৪৮
আপনার মতামত জানানঃ