সন্ত্রাস, দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহারসহ বিভিন্ন নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িয়ে আছে হাজী সেলিমের নাম। অন্যায় অনিয়মের পথ ধরেই তার উত্থান বলেও অভিযোগ রয়েছে। সম্প্রতি ছেলে ইরফান সেলিমের ঘটনা দিয়ে আলোচনায় এলে তার বিরুদ্ধে সক্রিয় হয় প্রশাসন। দখল ও দুর্নীতির নানা অভিযোগ তদন্তে নামে বিভিন্ন সংস্থা। ইতোমধ্যে বেশ কিছু অভিযান চালিয়ে হাজী সেলিমের দখল থেকে বেশকিছু সরকারি জমি উদ্ধার করা হয়েছে। কিন্তু হাজী সেলিমের বিরুদ্ধে এমন অভিযানের মধ্যেই দলে পদোন্নতি ঘটিয়ে তাকে পুরস্কৃত করল আওয়ামী লীগ।
জানা গেছে, আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে ১৯ নভেম্বর ২০২০ বৃহস্পতিবার বিকেলে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের পূর্ণাঙ্গ এই কমিটি অনুমোদন দেন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। এই কমিটিতে হাজী সেলিমকে রাখা হয়েছে দলের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য পদে। হাজী সেলিম আওয়ামী লীগের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের বিগত কমিটিতে সদস্য ছিলেন। তার আগে অবিভক্ত ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের কমিটিতে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ছিলেন তিনি। পদায়নের পরিক্রমা বলে, দুর্নীতিবিরোধী অভিযান চলমান সত্ত্বেও এবারই তাকে সবচেয়ে বড় পদ দিয়ে সম্মানীত করা হয়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, দুর্নীতিবিরোধী চলমান অভিযানের মধ্যে হাজী সেলিমের এই পদোন্নতি একটি রাজনৈতিক বার্তা। এই বার্তার মাধ্যমে বলা হয়েছে যে, হাজী সেলিমের ওপর ক্ষমতাসীন দলের আশীর্বাদ এখনও বহাল আছে। যারা হাজী সেলিমের দুর্নীতি নিয়ে বেশি সক্রিয়, প্রশাসনের সেইসব উৎসাহী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে এটা একটা সাবধান বাণীর মতো। পদোন্নতি দেয়ার মাধ্যমে দলটি পরিস্কার বার্তা দিয়েছে যে, তারা হাজী সেলিমের পাশে আছে। এটা দলের শীর্ষ নেতৃত্ব ঘোষিত দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স কর্মসূচীর অনুকূল নয়। বরং এর ফলে বিশেষ অভিযান তো বটেই, এমনকি দুর্নীতিবিরোধী সাধারণ আইনি প্রক্রিয়াও বাধাগ্রস্ত হওয়ার শঙ্কা বিরাজমান।
পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, সাধারণত অপরাধী কেউ ধরা পড়লে দলগুলো তাকে বহিস্কার করে এবং বলে দল তার দায়িত্ব নেবে না। কিন্তু হাজী সেলিমের বিরুদ্ধে দুর্নীতির পাহাড়সম অভিযোগ রয়েছে, র্যাব তার বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করছে, তাকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, এরকম পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগ তার পদোন্নতি দিয়েছে। এখন অবশ্যই আওয়ামী লীগকে হাজী সেলিমের অপরাধের দায়িত্ব নিতে হবে। দল হিসেবে তারা হাজী সেলিমের অপরাধের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা তো নেয়ইনি, উল্টো তাকে পুরস্কৃত করার মাধ্যমে দখল-দুর্নীতিকে উৎসাহিত করেছে। দলটির নেতাকর্মীরা এই পদক্ষেপ থেকে এমন বার্তাই পাবে।
সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে আওয়ামী লীগে হাজী সেলিমের পদোন্নতি নিয়ে চলছে ব্যাপক শোরগোল। হাসান রুহানী ফেসবুকে লিখেছেন, ‘এটা প্রমাণ হলো যে, দেশটা মগের মুল্লুকে পরিণত হয়েছে। জোর যার মুল্লুক তার।’ সাহানা ইয়াসমিন লিখেছেন, ‘আওয়ামী লীগ জানিয়ে দিল, হাজী সেলিম অবশ্যই আইনের ঊর্ধ্বে।’ গোলাম কিবরিয়া লিখেছেন, ‘ইহাকেই বলে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স।’ শরাফত আলী লিখেছেন, ‘আওয়ামী লীগ এখন সর্বেসর্বা, তারাই সর্প হইয়া দংশন করে, তারাই আবার ওঝা হইয়া ঝাড়ে!’
[soliloquy id=”2145″]
সম্প্রতি হাজী সেলিমের ছেলে ইরফান সেলিমের সহযোগীরা রাস্তায় নৌবাহিনীর একজন কর্মকর্তাকে মারধর করার পর ব্যাপক আলোচনা হয়। ২৫ অক্টোবর রাতের ওই ঘটনার পর দিন পুরান ঢাকার সোয়ারিঘাটে হাজী সেলিমের বাসায় অভিযান চালিয়ে মদ্যপান ও অবৈধভাবে ওয়াকিটকি রাখায় তার ছেলে ইরফান সেলিমকে দেড় বছরের কারাদণ্ড দেয় র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। এ সময় পুরান ঢাকার প্রভাবশালী ব্যবসায়ী-রাজনীতিক হাজী সেলিমের দেখা না মিললেও সপ্তাহখানেক পর পুরান ঢাকার নাজিম উদ্দিন রোডে কেন্দ্রীয় কারাগারে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর উপস্থিতিতে জেলহত্যা দিবসের অনুষ্ঠানে দেখা যায় তাকে। তখনই বোঝা গিয়েছিল যে, দলের হাইকমাণ্ড তার ওপর অসন্তুষ্ট নয়।
মূলত নব্বইয়ের দশকের শুরুতে রাজনীতিতে সক্রিয় হন হাজী মোহাম্মদ সেলিম। বিএনপি নেতা মীর শওকত আলী ও নাসির উদ্দিন আহমেদ পিন্টুর হাত ধরেই তার উত্থান। ১৯৯৪ সালে তিনি ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের ৬৫ ও ৬৬ নম্বর ওয়ার্ডে গরুর গাড়ি মার্কা নিয়ে কমিশনার নির্বাচিত হন। পরবর্তী সময়ে একটি ওয়ার্ড ছেড়ে দিলে তার স্ত্রী গুলশান আরা সেলিম ঢাকা সিটি কর্পোরেশনে সরাসরি ভোটে সর্বপ্রথম মহিলা কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। ১৯৯৬ সালে তৎকালীন অবিভক্ত ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের ওয়ার্ড কমিশনার হাজী সেলিম জাতীয় নির্বাচনে সংসদ সদস্য পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু নিজ দল বিএনপি তাকে মনোনয়ন না দেয়ায়, দল ছেড়ে যোগ দেন আওয়ামী লীগে।
ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী অনেকেই অভিযোগ করেন যে, হাজী সেলিম শুধু দুর্নীতিগ্রস্তই নন, তার কোনো রাজনৈতিক আদর্শও নেই। দলের সিদ্ধান্ত পক্ষে না গেলেই করেছেন বিদ্রোহ। সন্ত্রাস, দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহারসহ বিভিন্ন নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িয়ে আছে তার নাম। আর সে কারণে তিনি সব সময় বেছে নিয়েছেন ক্ষমতার রাজনীতি। থাকতে চেয়েছেন ক্ষমতায়। এ কাজে যখন-যেভাবে প্রয়োজন, রাজনীতি ও দলকে শুধু হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারই করেছেন। ফলে আওয়ামী লীগের পক্ষে হাজী সেলিমকে ছুড়ে ফেলে দেয়া খুব একটা কঠিন ছিল না। কিন্তু আওয়ামী লীগ দেখিয়ে দিল যে, তারা হাজী সেলিমের ওপর আস্থাশীল।
মিই/আরা/২০২০
আপনার মতামত জানানঃ