কপি, কাট, আর পেস্ট একজনেরটা থেকে করলে সেটা চুরি আর কয়েক জনেরটা মিলিয়ে করলে সেটা গবেষণা। চুরি এখানে শিল্প। আর শিল্পী এখানে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা। এক্ষেত্রে তারা অনেকটাই যেন অপ্রতিরোধ্য। এর ধারাবাহিকতায় সাম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক ও বিভাগীয় প্রধান ড. আবুল মনসুর আহাম্মদ তার একটি গবেষণা নিবন্ধে অন্যের লেখা চুরি করেছেন বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে।
সূত্র মতে, ২০১৩ সালে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক আবুল মনসুর আহাম্মদ সহযোগী অধ্যাপক থেকে অধ্যাপক পদে পদায়নের জন্য তার নিজের ১০টি গবেষণামূলক লেখা জমা দেন। এগুলোর একটিতে অনেকাংশ হুবহু তুলে দেয়া হয়েছে একটি জাতীয় দৈনিকে প্রচারিত আরেকজন শিক্ষকের লেখা থেকে।
আবুল মনসুরের লেখা নিবন্ধের শিরোনাম ‘Copyright protection in Bangladesh: A study of Intellectual and Copyright Legislation’। এটি ২০০৯ সালে ডিসেম্বরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সোশ্যাল সায়েন্স রিভিউ-এর ভলিউম ২৬-এ প্রকাশিত হয়।
এই লেখাটির অনেকাংশ আবুল মনসুর অন্যের লেখা থেকে নিলেও তথ্যসূত্র সঠিকভাবে ব্যবহার করেননি। যেভাবে ব্যবহার করেছেন, তাতে এটি তার নিজের লেখা বলে মনে হয়েছে। এভাবে রেফারেন্স দেয়া কোনোভাবেই গবেষণাকাজের অংশ হতে পারে না বলে মনে করেন শিক্ষাবিদরা।
সূত্র মতে, দ্য ডেইলি স্টার পত্রিকায় দুই কিস্তিতে প্রকাশিত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের তখনকার শিক্ষক মোহাম্মদ মনিরুল আজমের মূল লেখাটি থেকে অনুচ্ছেদের পর অনুচ্ছেদ তুলে দিয়েছেন আবুল মনসুর। মনিরুল আজমের লেখাটির শিরোনাম ‘Copyright Law in Bangladesh’। লেখাটি ২০০৬ সালের ২১ জানুয়ারি ও ৪ ফেব্রুয়ারি দুই কিস্তিতে প্রকাশিত হয়।
সোশ্যাল সায়েন্স রিভিউতে আবুল মনসুরের নিবন্ধটি যখন ছাপা হয়, তখন গবেষণা লেখায় মৌলিকত্ব যাচাইয়ের ভালো পদ্ধতি ছিল না। এখন রিভিউয়ার ছাড়াও বিভিন্ন সফটওয়্যারের মাধ্যমে লেখার মৌলিকত্ব যাচাই করা হয়ে থাকে। এ রকম একটি বহুল ব্যবহৃত সফটওয়্যার হলো টার্ন-ইট-ইন।
সূত্র মতে, লেখাটিতে ৬৩ ভাগ চৌর্যবৃত্তির ফলাফল প্রদর্শিত হচ্ছে। এ ছাড়া নিবন্ধের বাকি ৩৭ ভাগ বিভিন্ন উৎস থেকে নিয়ে সামান্য পরিবর্তন করা হয়েছে। ৯ পৃষ্ঠার নিবন্ধের পাঁচ পৃষ্ঠাই অন্যের লেখা থেকে হুবহু নেয়া হয়েছে।
আবুল মনসুর আহাম্মদের নিবন্ধের ভূমিকা অংশটি মনিরুল ইসলামের লেখা থেকে হুবহু (লাইন বাই লাইন) তুলে দেয়া। শুধু ওই ভূমিকার শেষ বাক্যে তিনি মনিরুল আজমের নাম উল্লেখ করেছেন। নিবন্ধের দ্বিতীয় পরিচ্ছদও হুবহু নেয়া হয়েছে মনিরুল আজমের লেখা থেকে, যার কোনো তথ্যসূত্র দেয়া নেই।
ওই নিবন্ধের ‘বিশ্লেষণ, তথ্য ও আলোচনা’ থেকে শুরু করে ‘প্রশাসনিক প্রতিকার’ উপশিরোনামের অনুচ্ছেদ পর্যন্ত প্রায় তিন পৃষ্ঠার লেখার বেশির ভাগ অংশও হুবহু তুলে দেয়া হয়েছে মনিরুল আজমের অনলাইন লেখা থেকে, যার কোনো রেফারেন্স নেই।
মনসুরের প্রবন্ধের উপসংহারের পুরোটাই নেয়া হয়েছে মোহাম্মদ মনিরুল আজমের অনলাইন লেখা থেকে, যার কোনো তথ্যসূত্র দেয়া নেই। এ ছাড়া তার নিবন্ধের বিস্তারিত সাহিত্যিক পর্যালোচনার একটি সম্পূর্ণ পরিচ্ছদ নেয়া হয়েছে ২০০৬ সালে The Journal of Electronic Publishing (Volume 9 Issue 1, Winter 2006)-এ প্রকাশিত ড্যানিয়েল এম ডাউনস (Daniel M. Downes)-এর New Media Economy: Intellectual Property and Cultural Insurrection শীর্ষক প্রবন্ধ থেকে, যার কোনো রেফারেন্স প্রবন্ধে দেয়া নেই।
এর আগে চলতি বছরের জুন মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও সংগীতশিল্পী মহসিনা আক্তার খানমের (লীনা তাপসী খান) একটি গ্রন্থে চৌর্যবৃত্তি করা হয়েছে বলে অভিযোগ ওঠে। অভিযোগকারী হলেন সংগীতশিল্পী ও জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমির (নায়েম) সাবেক মহাপরিচালক ইফফাত আরা নার্গিস।
ওই সময় সংবাদ সম্মেলনে ইফফাত আরা নার্গিস বলেন, লীনা তাপসী খানের পিএইচডি অভিসন্দর্ভের ওপর ভিত্তি করে রচিত ‘নজরুল-সঙ্গীতে রাগের ব্যবহার’ গ্রন্থে ৮০ পৃষ্ঠার স্বরলিপি স্ক্যান করে ঢোকানো হয়েছে মূল পাঠ হিসেবে, যা অনৈতিক। এই ৮০ পৃষ্ঠার স্বরলিপির স্থান হতে পারত গ্রন্থের পরিশিষ্টে৷ মূল পাঠে এই স্বরলিপি কোনোভাবেই স্থান পাওয়ার কথা নয়। এটিও একধরনের চৌর্যবৃত্তি। দেখা যাচ্ছে যে ২৭৭ পৃষ্ঠার বইয়ের মধ্যে ৮০ পৃষ্ঠার স্বরলিপিসহ ১৬৯ পৃষ্ঠা লীনা তাপসী খানের রচনা নয়। এগুলো অন্যের গ্রন্থ থেকে হুবহু গৃহীত, লেখকের নয়। বাকি ১০১ পৃষ্ঠা লীনা তাপসী খানের লেখা বলে দাবি করা হয়েছে। এর মধ্যে ইদ্রিস আলীর গ্রন্থ থেকেও নেওয়া হয়েছে। যথাযথ অনুসন্ধান হলে প্রমাণিত হতে পারে যে ওই পৃষ্ঠাগুলোতে ব্যবহৃত তথ্যও লেখকের নয়।
এর আগে ২০২০ সালের শুরুতে ৯৮ শতাংশ হুবহু নকল পিএইচডি গবেষণা অভিসন্দর্ভের (থিসিস) মাধ্যমে ‘ডক্টরেট’ ডিগ্রি নেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ওষুধপ্রযুক্তি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আবুল কালাম লুৎফুল কবীর। এই গবেষণার সহতত্ত্বাবধায়ক অভিযোগ করেন, একাধিকবার অনুরোধ করলেও লুৎফুল কবীর তাকে থিসিসের কোনো কপি দেননি।
আবুল কালাম লুৎফুল কবীর সে সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টরের দায়িত্বে আছেন। ২০১৪ সালের দিকে ‘টিউবারকিউলোসিস অ্যান্ড এইচআইভি কো-রিলেশন অ্যান্ড কো-ইনফেকশন ইন বাংলাদেশ: অ্যান এক্সপ্লোরেশন অব দেয়ার ইমপ্যাক্টস অন পাবলিক হেলথ’ শীর্ষক ওই নিবন্ধের কাজ শুরু করেন আবুল কালাম লুৎফুল কবীর। তার এই গবেষণার তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন ওষুধপ্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক আবু সারা শামসুর রউফ আর সহতত্ত্বাবধায়ক ছিলেন বিভাগের জ্যেষ্ঠ শিক্ষক অধ্যাপক আ ব ম ফারুক।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, কাজ শুরু করার এক থেকে দেড় বছরের মাথায় ২০১৫ সালে অভিসন্দর্ভের কাজ শেষ করে ফেলেন লুৎফুল কবীর। একটি পিএইচডি অভিসন্দর্ভের কাজ শেষ করার জন্য সাধারণত তিন থেকে সাড়ে তিন বছর লাগে। কিন্তু দ্রুত কাজ শেষ করে প্রথমে সহতত্ত্বাবধায়কের স্বাক্ষর ছাড়াই ডিগ্রির জন্য অভিসন্দর্ভটি জমা দেন লুৎফুল কবীর। সহতত্ত্বাবধায়কের স্বাক্ষর না থাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার ভবন থেকে তা ফিরিয়ে দেওয়া হয়। পরে লুৎফুল কবীর গবেষণার সহতত্ত্বাবধায়ক অধ্যাপক ফারুককে ‘অনেক অনুনয়-বিনয়’ করে তাঁর কাছ থেকে স্বাক্ষর নিয়ে এলে ২০১৫ সালেই বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাউন্সিল ও সিন্ডিকেটে তা অনুমোদিত হয়।
গবেষণায় ৯৮ শতাংশ হুবহু নকলের বিষয়টি নজরে আসার পর ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে একজন গবেষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামানের কাছে বিষয়টি নিয়ে লিখিত অভিযোগ করেন। এ ছাড়া লুৎফুল কবীরের অভিসন্দর্ভে নিজের একটি গবেষণা থেকে চৌর্যবৃত্তির অভিযোগ ও তার বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামানকে একটি চিঠি দেন সুইডেনের গোথেনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জোনাস নিলসন।
২০১৭ সালে ইউনিভার্সিটি অব শিকাগো প্রেস থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে চিঠি পাঠানো হয়। চিঠিতে লেখাচুরির অভিযোগ আনা হয় ঢাবির গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সামিয়া রহমান এবং ক্রিমিনোলজি বা অপরাধবিজ্ঞান বিভাগ এর অধ্যাপক সৈয়দ মাহফুজুল হক মারজানের বিরুদ্ধে।
চিঠিতে বলা হয়, এই দুইজন শিক্ষক ফ্রান্স দার্শনিক মাইকেল ফৌকাল্টের একটি লেখা কোনো ধরনের অনুমতি না নিয়ে চুরি করেন। ওই দার্শনিকের মূল লেখার শিরোনাম ছিল ‘দ্য সাবজেক্ট অ্যান্ড পাওয়ার’ যা ইউনিভার্সিটি অব শিকাগোর একটি জার্নালে প্রকাশিত হয়েছিল।
এসডব্লিউ/এসএস/১৩০২
আপনার মতামত জানানঃ