মাত্র দুই মাস আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন শিক্ষকের বিরুদ্ধে গবেষণায় চৌর্যবৃত্তির অভিযোগ ওঠে। এতে ওই তিন শিক্ষকের পদাবনতির শাস্তি হয়। এবার শোনা গেল পাবনা প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষকের বিরুদ্ধে গবেষণায় চৌর্যবৃত্তির অভিযোগ উঠেছে। এতে দুই শিক্ষকের বিরুদ্ধে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে কর্তৃপক্ষ।
অভিযুক্ত শিক্ষকরা হলেন- সমাজকর্ম বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আওয়াল কবির জয় এবং অর্থনীতি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ইয়াহিয়া বেপারি।
যে বই থেকে গবেষণার লেখা চুরি করার অভিযোগ উঠেছে, সেটির সম্পাদকরা সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) এবং পাবিপ্রবি কর্তৃপক্ষের কাছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ করেছেন।
‘এঙ্গেজিং ইন এডুকেশনাল রিসার্চ: রিভিজিটিং পলিসি অ্যান্ড প্র্যাকটিস ইন বাংলাদেশ’ নামের ওই বইটি ২০১৮ সালে প্রকাশিত হয়। স্প্রিংগার প্রকাশিত বইটির সম্পাদক চার বাংলাদেশি শিক্ষক। সম্পাদকদের অভিযোগ, অভিযুক্তরা বইটির একটি অধ্যায়ের প্রায় পুরোটাই চুরি করেছেন।
অভিযুক্ত শিক্ষকদের গবেষণা প্রবন্ধের শিরোনাম ছিল ‘ইভলভিং রিয়েলিটিস অ্যান্ড চেঞ্জিং পার্সপেক্টিভস: অ্যা স্টাডি অব এডুকেশন সিস্টেম ইন বাংলাদেশ’। গত ২৮ মার্চ এটি সায়েন্স পাবলিশিং গ্রুপের কাছে জমা দেওয়া হয়। ১২ এপ্রিল প্রবন্ধটি গৃহীত হওয়ার পর ২৩ এপ্রিল সেটি প্রকাশিত হয়। তবে, চৌর্যবৃত্তির অভিযোগ ওঠায় প্রকাশনা সংস্থা গবেষণাটি তাদের ওয়েবসাইট থেকে সরিয়ে নিয়েছে।
দুটি লেখা পরীক্ষা করে প্রমাণিত হয়েছে যে, কবির ও ইয়াহিয়ার প্রবন্ধের সারাংশ থেকে শুরু করে উপসংহার, এমনকি তথ্যসূত্র পর্যন্ত ওই বইটি থেকে চুরি করা হয়েছে। কিছু সমার্থক শব্দ ব্যবহার করে পরিবর্তন এনে অস্ট্রেলিয়ার মোনাশ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাকিব চৌধুরী ও মাহবুব সরকারের মূল লেখাটিই তারা তুলে দিয়েছেন।
গত ১০ মে মোনাশ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাকিব পাবিপ্রবির উপাচার্য অধ্যাপক ড. এম রোস্তম আলীর কাছে এ বিষয়ে ইমেইল করেন।
ইমেইলে বলা হয়, ‘সম্প্রতি একটি এডুকেশনাল জার্নালে প্রকাশিত এক প্রবন্ধে আমরা গুরুতর ধরনের চৌর্যবৃত্তি দেখতে পেয়েছি। এই প্রকাশনার বিষয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছি আমরা। কারণ, আমাদের বিশ্বাস, এটি খুবই স্থূলভাবে আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তি লঙ্ঘন করেছে। ওই প্রবন্ধে আমাদের প্রকাশিত লেখা “এডুকেশন ইন বাংলাদেশ: চ্যালেঞ্জিং কনটেক্সটস অ্যান্ড এমার্জিং রিয়েলিটিস” থেকে প্রায় সবকিছুই নকল করা হয়েছে।’
ইমেইল পাওয়ার পর উপাচার্য লেখকদের ইউজিসিতে অভিযোগ করার পরামর্শ দেন।
রাকিব পরে আরেকটি ইমেইলের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে দুই শিক্ষকের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করেন।
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে ইয়াহিয়া বলেন, প্রবন্ধে তার নাম থাকার বিষয়টি তিনি জানতেন না।
তিনি বলেন, ‘আমার সম্মতি ছাড়াই এটি আপলোড করা হয়েছে। বিষয়টি নজরে আসার পর আমি প্রকাশককে সাইট থেকে লেখাটি সরিয়ে নিতে বলি।’
কবির বলেন, ‘আমরা প্রবন্ধটি নিয়ে কাজ করছিলাম। এটি প্রকাশিত হওয়ার কথা ছিল না। প্রবন্ধটি মুছে দেওয়া হয়েছে এবং আমরা আর এর ক্রেডিট দাবি করছি না। এটি নিয়ে আরও কাজ করে তারপর প্রকাশ করব।’
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র থেকে জানা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের একটি এডুকেশন জার্নালে প্রকাশিত এই দুই শিক্ষকের গবেষণা আর্টিকেলে চৌর্যবৃত্তির অভিযোগ করেছেন অস্ট্রেলিয়ার মোনাশ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্যাকাল্টি অব এডুকেশনের অধ্যাপক ড. রকিব চৌধুরী এবং অধ্যাপক ড. মাহবুব সরকার।
এরপর পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ শাহাদাত হোসেনকে আহ্বায়ক করে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন- চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত ও পরিবেশ রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ হেলাল উদ্দীন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি) ইনস্টিটিউট অব ইনফরমেন টেকনোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. এম শামীম কায়সার।
বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ দফতরের উপরিচালক মো. ফারুক হোসেন চৌধুরী বলেন, ‘অস্ট্রেলিয়ার মোনাশ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্যাকাল্টি অব এডুকেশনের অধ্যাপক ড. রকিব চৌধুরী এবং অধ্যাপক ড. মাহবুব সরকার ওই দুই শিক্ষকের বিরুদ্ধে মেধাস্বত্ব চুরির অভিযোগ করেছেন। এরপর অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলের বৈঠকে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটিকে পরবর্তী ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য বলা হয়েছে।’
পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. রোস্তম আলী গণমাধ্যমকে বলেন, একজনের গবেষণামূলক লেখা কপি করে আরেকজনের গবেষক হওয়ার স্বপ্ন দেখা বা নিজের নামে চালিয়ে দেওয়া চরম অন্যায়। মেধা চুরির অপরাধে দুই শিক্ষকের বিরুদ্ধে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত কমিটির রিপোর্টে দোষী সাব্যস্ত হলে আইন অনুসারে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। গবেষণা চুরির অপরাধে তাদের যে শাস্তি পাওয়া দরকার সেটাই পাবে।
এদিকে গবেষণায় চৌর্যবৃত্তি ধরতে অ্যান্টি প্ল্যাজিয়ারিজম সফটওয়্যার কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি)।গবেষণায় চৌর্যবৃত্তি ঠেকাতে এই সফটওয়্যার কেনা হচ্ছে। সফটওয়্যারটির নাম ‘টার্নইটইন’।
রোববার ভাচুর্য়ালি অনুষ্ঠিত প্ল্যাজিয়ারিজম চেকার ওয়েব সার্ভিস ক্রয় সংক্রান্ত কমিটির সভায় এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।এ ছাড়া সভায় বিশ্ববিদ্যালয় নির্বাচন, ব্যবহারবিধি এবং ব্যয় নির্ধারণে পৃথক কমিটি গঠন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
ইউজিসির সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, এই সফটওয়্যারের অথেনটিকেট অংশ গবেষক এবং শিক্ষকদের গবেষণায় চৌর্যবৃত্তি এবং ফিডব্যাক স্টুডিও দিয়ে শিক্ষার্থীদের থিসিস চৌর্যবৃত্তি বিষয়টি শনাক্ত করা যাবে।
ইউজিসি সদস্য প্রফেসর ড. আবু তাহের গণমাধ্যমকে বলেন, প্রাথমিকভাবে দেশের ৩০টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য এই সফটওয়্যারের সেবা সরবরাহ করা হবে। পর্যায়ক্রমে সব বিশ্ববিদ্যালয়ে এই সফটওয়্যারের ব্যবহার নিশ্চিত করা হবে।
ইউজিসি সদস্য প্রফেসর সাজ্জাদ হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণায় চৌর্যবৃত্তির ঘটনা দিন দিন বেড়েই চলেছে।নীতিমালা না থাকায় এই চৌর্যবৃত্তি শনাক্ত করা যাচ্ছে না।
তিনি বলেন, একটি নীতিমালা থাকা প্রয়োজন।টার্নইটইন সফটওয়্যার ব্যবহারের জন্য দ্রুত একটি নীতিমালা প্রণয়ন করা হবে।তাহলে গবেষণায় চৌর্যবৃত্তি শনাক্ত করতে সহজ হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭০৭
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ