জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে প্রভাব পড়ছে পরিবেশগত ব্যবস্থাপনার ওপর। পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ঋতুবৈচিত্র্য ও বৃষ্টিপাতের ধরন বদলে যাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে বিভিন্ন রোগের সম্পর্ক আছে এবং একই রোগ ভিন্ন ধরন ও লক্ষণ নিয়ে দৃশ্যমান হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশে সংক্রামক রোগের বিস্তার ঘটছে। যা মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলছে বলে জানিয়েছে বিশ্বব্যাংক।
এ বছরের ডেঙ্গুর ব্যাপকতা ভাবিয়ে তুলেছে সংশ্লিষ্টদের। বিভিন্ন গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্য এবং বিশেষজ্ঞদের মতে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিশেষ করে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় দেশগুলোতে এডিসবাহিত এ রোগে আক্রান্ত রোগী ও মৃত্যুর হার প্রতি বছরই বাড়ছে। বাংলাদেশ ডেঙ্গু ভাইরাসের ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর অন্যতম। ২০১৭ সালে বাংলাদেশে বহু মানুষ চিকুনগুনিয়া ভাইরাসে আক্রান্ত হয়। চিকুনগুনিয়ার পর ২০১৯ এ ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ে। এডিস মশা চিকুনগুনিয়া ও ডেঙ্গুর ভাইরাস বিস্তারের একমাত্র মাধ্যম। এ ছাড়া জিকা ভাইরাস বিস্তারের ক্ষেত্রেও দায়ী এই মশা। আর জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশে বেড়েছে এডিস মশাবাহিত এসব রোগের প্রকোপ। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বাড়ছে।
বিশ্ব ব্যাংকের এক গবেষণায় জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবসংক্রান্ত এসব তথ্য উঠে এসেছে। আজ বৃহস্পতিবার সকালে আয়োজিত এক ওয়েবিনারে এ গবেষণার ফল তুলে ধরা হয়।
বিশ্ব ব্যাংক বলছে, ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় প্রচুর বৃষ্টি হয়েছিল। ৪৫ বছরে এমন বৃষ্টি আর হয়নি। পরবর্তী মাসগুলোতেও অনেক বেশি বৃষ্টি ছিল। যার কারণে মশার উপদ্রব বেড়েছিল। তখন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে অনেক মানুষ মারা যায়।
ডেঙ্গু জ্বর একটি ভাইরাসজনিত রোগ, যা এডিস ইজিপ্টি মশার কামড়ের মাধ্যমে ছড়ায়। শরীরে তীব্র ব্যথা সৃষ্টির কারণে এর ডাকনাম ‘ব্রেকবোন ফিভার’।
২০১৯ সালে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা আগের সব বছরের রেকর্ড ছাড়িয়ে যায়। গণমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে প্রায় ৩০০ জনের মৃত্যু হয়। তবে সরকারি হিসাবে মৃতের সংখ্যা ১৭৯। ডেঙ্গুতে ১৮ বছরের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে এবার।
প্রতিবেদনে বিশ্বব্যাংক জানায়, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে শ্বাস-প্রশ্বাস, পানি ও মশাবাহিত রোগ বৃদ্ধির পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার মধ্যে একটি যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া গেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের পূর্বাভাসের সঙ্গে শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। শিশু, প্রবীণের পাশাপাশি ঢাকা ও চট্টগ্রামের মতো বড় শহরে বসবাসকারীরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন।
বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ ও ভুটানের কান্ট্রি ডিরেক্টর মার্সি টেম্বন বলেন, বাংলাদেশ সবচেয়ে দুর্বল দেশের মধ্যে থাকা সত্ত্বেও উল্লেখযোগ্যভাবে জলবায়ু পরিবর্তন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেছে। দেশটি প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিরুদ্ধে একটি স্থায়িত্ব তৈরি করেছে এবং কৃষি উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির জন্য সহায়ক বলে বিবেচিত হচ্ছে।
তিনি বলেন, শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের একটি সুস্পষ্ট প্রভাব উঠে এসেছে এ প্রতিবেদনে। এ জন্য বাংলাদেশের শক্তিশালী স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নিশ্চিত করা জরুরি। যা উদীয়মান জলবায়ু সংবেদনশীল রোগের প্রাদুর্ভাব মোকাবিলায় সহায়তা করতে পারে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ১৯৭৬ সাল থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে গণ তাপমাত্রা বেড়েছে শূন্য দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর এই কারণেই ধীরে ধীরে লোপ পাচ্ছে ঋতুভেদে আবহাওয়ার বৈচিত্র্য। তাই যখন শীত থাকার কথা তখন তাপমাত্রা তুলনামূলক বেশি থাকছে। আবার আগের তুলনায় এখন গ্রীষ্মকালের সময় বাড়ছে। তাতে বাড়ছে গরমও। এমনিভাবে দীর্ঘ হচ্ছে বর্ষাকাল। তাতে রোগ-বালাই বেশি হচ্ছে। আর এইসবই জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে হচ্ছে।
গত ৪৪ বছর ধরে বাংলাদেশের তাপমাত্রা ০.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেয়েছে। দিন দিন গরম বাড়ছে। ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশে তাপমাত্রা ১.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে যাওয়ার পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে প্রতিবেদনে।
বিশ্বব্যাংক জানায়, গত ৪৪ বছর ধরে বাংলাদেশের তাপমাত্রা ০.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেয়েছে। দিন দিন গরম বাড়ছে। ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশে তাপমাত্রা ১.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে যাওয়ার পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে প্রতিবেদনে।
প্রতিবেদনে জানানো হয়, বর্ষার তুলনায় শুষ্ক মৌসুমে সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় ২০ শতাংশ কম। তাপমাত্রা এবং আর্দ্রতা বৃদ্ধির সঙ্গে শ্বাসকষ্টজনিত অসুস্থতা বৃদ্ধি পেয়েছে। তাপমাত্রা ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধির জন্য মানুষ ৫.৭ শতাংশ শ্বাসকষ্টজনিত রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। আর্দ্রতা ১ শতাংশ বৃদ্ধির জন্য শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণ ধরা পড়ার সম্ভাবনা ১.৫ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। আবহাওয়ার ধরন মানসিক স্বাস্থ্যের ওপরও প্রভাব ফেলে। শীতকালে বেশি মানুষ বিষণ্নতায় ভোগে। তাপমাত্রা এবং আর্দ্রতার সঙ্গে উদ্বেগজনিত রোগের মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে। বিষণ্নতায় পুরুষের তুলনায় নারীরা বেশি ঝুঁকিতে রয়েছেন।
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনের সিনিয়র অপারেশন অফিসার এবং সহ-লেখক ইফফাত মাহমুদ বলেন, শক্তিশালী তথ্য সংগ্রহ নিশ্চিত করার মাধ্যমে বাংলাদেশ জলবায়ু সংবেদনশীল রোগের বিবর্তনকে আরও ভালোভাবে ট্র্যাক করতে পারে। বিশেষ করে স্থানীয় পর্যায়ে সঠিক আবহাওয়ার তথ্য লিপিবদ্ধ করে এবং এটিকে স্বাস্থ্যের তথ্যের সঙ্গে যুক্ত করে সম্ভাব্য রোগের প্রাদুর্ভাবের পূর্বাভাস দেওয়া জরুরি। তাহলে জলবায়ুভিত্তিক ডেঙ্গুর প্রাথমিক সতর্কীকরণ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিশেষ করে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় দেশগুলোতে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা ও মৃত্যুহার বেড়েই চলেছে। বিশ্বে জলবায়ুগত দুর্যোগের শিকার হয়ে লাখ লাখ মানুষ খোলা আকাশের নিচে বাস করতে বাধ্য হচ্ছে। ফলে কোনো না কোনোভাবে বিভিন্ন রোগের বিস্তারে জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব ভূমিকা রাখছে। নিম্নমানের বসবাস, সেবা ও ঘনবসতিপূর্ণ নগর এলাকায় মশা মানুষের খুব কাছে চলে আসছে বলে মনে হয়! শুধু মশা নয়, জলবায়ু পরিবর্তনে তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে অন্যান্য কীটপতঙ্গ প্রজননের উর্বর ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে।
তারা বলেন, ডেঙ্গু মশার ভাইরাস প্রতিরোধে শুধু বর্ষা মৌসুম বা মশার উৎপাত হলে নয়, অন্তত আগামী কয়েক বছর মাসব্যাপী ডেঙ্গু মশার বংশবিস্তার প্রতিরোধে ধারাবাহিক অভিযান সক্রিয় রাখতে হবে। পরিবেশগত ব্যবস্থাপনা, ওষুধ ছিটানো ও নাগরিক সম্পৃক্ততা নিশ্চিত করার মাধ্যমে ডেঙ্গুর ভয়াবহতা রোধ করা যাবে বলে মনে করেন তারা।
আরও বলেন, পরিবেশগত ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে প্রয়োজন পরিকল্পিত নগরায়ণ, নগরের জলাধার রক্ষা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, জলাবদ্ধতা রোধ, প্রকৃতি রক্ষা, দূষণ রোধ প্রভৃতি বিষয়গুলোর দিকে নজর রাখা। আর ওষুধ ছিটানো বিষয়টা কর্তৃপক্ষের কাজ এবং এ ব্যাপারে পরিস্থিতি ও ভাইরাসের ধরন অনুযায়ী সব সময় সতর্ক থাকতে হবে। সর্বোপরি নাগরিক দায়বদ্ধতা, অর্থাৎ সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে আইন তৈরি করে হলেও সেটা করতে হবে, যেমন— বাসাবাড়ির চারপাশ পরিষ্কার রাখা, কোথাও যেন বেশিদিন পানি জমে না থাকে প্রভৃতি। দরকার হলে ডেঙ্গু নির্মূলে গণসচেতনতা ও সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে দেশব্যাপী সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রায় সাড়ে তিন কোটিরও বেশি শিক্ষার্থীর সরাসরি সম্পৃক্ততার বিষয়টি ভাবতে হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬০৮
আপনার মতামত জানানঃ