প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে অপরূপ সিলেট। এখানে আছে সবুজ পাহাড়ের গল্প, চা-বাগানের সারি সারি গাছ, স্বচ্ছ নীল প্রকৃতির ভূমি আর দেয়ালে পুরাকীর্তির ও সভ্যতার দীর্ঘ সব ইতিহাসের এক অফুরক্ত ভান্ডার। আধ্যাত্মিক রাজধানীর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কথা এলে উঠে আসে বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সবুজে ঘেরা অগনিত পাহাড়, টিলা। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, কালের বিবর্তন, কথিত নগরায়নের প্রয়োজন, প্রশাসনিক উদাসীনতা ও পাহাড় খেকোদের অশুভ পাঁয়তারায় শহর ও শহরতলীর পাহাড়গুলোতে এখন চলছে বৃক্ষ নিধনের মহোৎসব। তাই ধংস হয়ে যাচ্ছে পাহাড়ি অঞ্চল বলে খ্যাত নগরী সিলেটের পরিবেশ। শহরের প্রায় পাহাড়েই অবাধে বৃক্ষ নিধন ও পাহাড় কাটার প্রতিযোগিতায় নেমেছেন এলাকার প্রভাবশালী আর এক শ্রেণির অসৎ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
এক সময় সিলেট বৃক্ষের জঙ্গল হিসাবে পরিচিত ছিলো। টিলায় টিলায় সজ্জিত ছিল নগরী। সে টিলায় ছিল নানা গাছপালা আর লতাপাতার ঝোপ। এসব টিলা দেখে মনে হতো ‘সবুজের গালিচা’। কিন্তু কালের আবর্তনে এ জনপদে সে ঐতিহ্য আর নেই। বর্তমানে বৃক্ষ নিধনের পাশাপাশি চলছে পাহাড় নিধনের প্রতিযোগিতা। ফলে মানুষের কঠিন হাতের ছোঁয়ায় সেই সবুজের সমাহার আজ ধ্বংসের মুখে।
আগে নগরে ঠিক কতটি টিলা ছিল, এখন কতগুলো টিকে আছে, তার নির্দিষ্ট কোনো পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি। ১৯৫৬ সালে ভূমির মাঠ জরিপের তথ্য অনুযায়ী, টিলাশ্রেণির ভূমির হিসাবে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি জেলায় ১ হাজার ২৫টি টিলার সংখ্যা বের করেছে। এর মধ্যে নগরী ও উপকণ্ঠের এলাকা মিলিয়ে সিলেট সদর উপজেলায় টিলা রয়েছে ১৯৯টি।
সরেজমিনে দেখা যায়, গত ১০ বছরে সবচেয়ে বেশি টিলা নিশ্চিহ্ন হয়েছে বালুচর এলাকায়। সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও এমসি কলেজের পাশের এই এলাকা বালুচর একসময় টিলা ও বনভূমির মতো ছিল। ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী ওঁরাওদের হটিয়ে সেখানে আটটি আবাসিক এলাকা গড়ে উঠেছে। চন্দনটিলা নামের একটি ক্ষয়িষ্ণু টিলা রয়েছে সেখানে। বসবাস করছে মাত্র ৯টি ওঁরাও পরিবার। ওঁরাও পরিবারের একজন সদস্য সারথি ওঁরাও বলেন, ‘আমরা সংগ্রাম করে আছি বলে চন্দন টিলাটি আছে। আমরা না থাকলে সেটি গুঁড়িয়ে বাসাবাড়ি হবে।’
সিলেটের ভোলাগঞ্জ উপজেলায় সরকারি খাস খতিয়ানভুক্ত ১৩৭ দশমিক ৫০ একর জায়গায় শাহ আরেফিন টিলার অবস্থান। লালচে, বাদামি ও আঠালো মাটির এ টিলার নিচে রয়েছে বড় বড় পাথর খণ্ড। খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় ও আদালতের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও অবৈধভাবে পাথর উত্তোলনের ফলে অস্তিত্ব হারাতে বসেছে বিশাল এ টিলা। বর্তমানে টিলার বাইরের খোলসটাই কেবল রয়েছে, ভেতরে মাটি খুঁড়ে তৈরি করা হয়েছে বিশাল বিশাল গর্ত।
এক সময় সিলেট বৃক্ষের জঙ্গল হিসাবে পরিচিত ছিলো। টিলায় টিলায় সজ্জিত ছিল নগরী। সে টিলায় ছিল নানা গাছপালা আর লতাপাতার ঝোপ। এসব টিলা দেখে মনে হতো ‘সবুজের গালিচা’। কিন্তু কালের আবর্তনে এ জনপদে সে ঐতিহ্য আর নেই। বর্তমানে বৃক্ষ নিধনের পাশাপাশি চলছে পাহাড় নিধনের প্রতিযোগিতা। ফলে মানুষের কঠিন হাতের ছোঁয়ায় সেই সবুজের সমাহার আজ ধ্বংসের মুখে।
পরিবেশ অধিদপ্তর বলছে, গত দেড় দশকে সিলেটের ৬১টি টিলা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। জেলার ৪১২টি পাহাড়-টিলার মধ্যে এখন টিকে আছে সাড়ে তিনশ। তবে পরিবেশ বিষয়ক সংস্থাগুলো এই পরিসংখ্যান মানতে নারাজ। তারা বলছেন, গত দেড় দশকে শতাধিক টিলা সিলেট থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা), সিলেটের কর্মকর্তারা বলছেন, গত তিন দশকে সিলেট নগরীরই ৫০ ভাগ টিলা ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। নগরীর করের পাড়া, বালুচর, বাদামবাগিচা, বনকলাপাড়া, জালালাবাদ, শাহী ঈদগাহ, তারাপুর এলাকার টিলা সবচেয়ে বেশি কাটা হয়েছে বলে জানিয়েছেন বাপা, সিলেটের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল করিম কিম।
বর্ষা মৌসুমে টিলার মাটি নরম হয়ে পড়ায় এ সময় টিলা কাটার প্রবণতা বেড়ে যায়। কোথাও রাতের আঁধারে আবার কোথাও দিনের বেলায় প্রশাসনের সঙ্গে সমঝোতা করে চলছে টিলা কাটা। আবার কোথাও রয়েছে রাজনৈতিক ছত্রছায়া।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) একটি রিটের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১১ সালের নভেম্বরে সিলেটে সব ধরনের পাহাড়-টিলা কাটায় নিষেধাজ্ঞা জারি করেন উচ্চ আদালত। এছাড়া পরিবেশ আইনেও পাহাড়-টিলা কাটায় নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। যদিও আইন-আদালতের এসব বিধি-নিষেধের কোনো তোয়াক্কাই করছে না পাহাড়খেকোরা।
পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, সিলেট নগরী ও এর আশপাশসহ জেলার গোয়াইনঘাট, কোম্পানীগঞ্জ, ফেঞ্চুগঞ্জ, বিয়ানীবাজার, কানাইঘাট, গোলাপগঞ্জ ও জৈন্তাপুর উপজেলায় এখনো টিকে থাকা ৩৫১টি টিলার মধ্যে প্রায় অর্ধেকই রয়েছে ঝুঁকিতে। এসব টিলা কাটতে তৎপর রয়েছে একটি গোষ্ঠী।
এদিকে পরিবেশ অধিদপ্তর জানায়, পাহাড়-টিলা কাটার বিরুদ্ধে প্রতি মাসেই কিছু না কিছু অভিযান পরিচালনা করে জরিমানা আদায় করা হয়। অভিযানের পর কিছুদিন এই অপতত্পরতা বন্ধ থাকলেও পরে আবার যেই কে সেই। পাহাড় কর্তনকারীরা অত্যন্ত প্রভাবশালী। তারা কোন কিছুরই তোয়াক্কা করে না।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলেন, যে আবাসনের প্রয়োজনে টিলা সাবাড় হচ্ছে, সেই নিরাপদ আবাসভূমির জন্য টিলার সুরক্ষা দরকার। কেননা ভূমিকম্পপ্রবণ সিলেট নগরীর জন্য টিলা হচ্ছে প্রাকৃতিক ঢাল।
তারা বলেন, অভিলম্বে পাহাড় কাটা বন্ধের ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। সেই সঙ্গে অবাধে পাহাড় ও বন কাটা বন্ধ করে দেশীয় প্রজাতি ফল-মূলসহ নানা বনজ ও ঔষধি গাছ রোপণ করে এবং বনায়ন করে হারিয়ে যাওয়া জীববৈচিত্র্য ফিরিয়ে আনা সম্ভব বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪৫৯
আপনার মতামত জানানঃ