টেকনোলজি ও ইন্টারনেটের প্রতি আসক্তিই চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের যুগে ডিজিটাল আসক্তি নামে পরিচিত। ডিজিটাল আসক্তির তিনটি ধরন রয়েছে— ফোন, ইন্টারনেট ও সোশ্যাল মিডিয়া। সব বয়সের মানুষের মধ্যে এ আসক্তি দেখা দিলেও শিশু-কিশোর শিক্ষার্থীদের মধ্যে তা বেশি। দেশের স্কুল শিক্ষার্থীদের মধ্যে গত এক বছরে বেড়েছে মোবাইল ও গেজেট আসক্তি। মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে কোভিড মহামারির পর থেকে উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে মাথা ব্যথা, হাত-পা ব্যথা, ঘুমের সমস্যা এবং দৃষ্টিশক্তির সমস্যা। শতকরা ৫২ ভাগ শিক্ষার্থীই মনে করে তারা মানসিকভাবে বিষণ্ন এবং তাদের মধ্যে মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাওয়া কিংবা অল্প সময়ে রেগে যাওয়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।
দেশের ২১টি জেলায় এক হাজার ৮০৩ জন ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পড়ুয়া বাংলা মাধ্যম, ইংরেজি মাধ্যম, মাদ্রাসা ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী শিক্ষার্থীদের নিয়ে পরিচালিত এক গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে। আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রকাশনা সংস্থা উইলি এর হেলথ সায়েন্স রিপোর্ট জার্নালে প্রকাশিত হয় এই গবেষণার ফলাফল। মঙ্গলবার (৫ অক্টোবর) এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেন, চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি বিশ্ববিদ্যালয়, ইউএসটিসি ও সাউদার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা এই গবেষণাকর্ম পরিচালনা করেন।
গবেষণায় মুখ্য তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগের শিক্ষক ড. এস এম মাহবুবুর রশিদ ও ইনস্টিটিউট অব স্ট্যাটিস্টিক্যাল রিসার্চের শিক্ষক নাসরিন লিপি, চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের ডায়বেটিস ও হরমোন রোগ বিভাগের প্রধান ডা. ফারহানা আকতার, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. অলক পাল এবং জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগের ড. আদনান মান্নান। সহযোগী গবেষক হিসেবে ছিলেন জান্নাতুল মাওয়া, এমা বনিক, ইয়াসমিন আকতার, আমিনা জাহান, নাভিদ মাহবুব, মফিজুর রহমান শাহেদ ও জোবায়ের ইবনে দ্বীন।
গবেষণা পরিচালনা সহায়তায় ছিল চিটাগং ইউনিভার্সিটি রিসার্চ অ্যান্ড হায়ার স্টাডিস সোসাইটি, দৃষ্টি চট্টগ্রাম এবং ডিজিজ বায়োলজি অ্যান্ড মলিকুলার এপিডেমিওলজি রিসার্চ গ্রুপ চট্টগ্রাম।
গবেষণার তথ্য বলছে, ৬৮ ভাগ শিক্ষার্থী দিনে ২-৪ ঘণ্টা মোবাইল ফোনে সময় কাটাচ্ছে। ৯ ভাগ শিক্ষার্থী কম্পিউটার স্ক্রিনে ও ৮ ভাগ ট্যাবে দিনের অধিকাংশ সময় ব্যয় করে।
গবেষণায় আরও দেখা যায়, ২০১৮-২০১৯ সালে যেখানে ছাত্র-ছাত্রীদের শারীরিক সমস্যাগুলোর মধ্যে ডায়রিয়া, চুলকানির সমস্যা, পেট ব্যথা, জ্বর ও সর্দি সবচেয়ে প্রকট ছিল, সেই জায়গায় গত দেড় বছরে ২০২০-২০২১ সালে মাথাব্যথা, দৃষ্টিশক্তির জটিলতা, ঘুমের সমস্যা, বিষণ্ণতা ও খিটখিটে মেজাজ এবং জ্বর সবচেয়ে বেশি পরিলক্ষিত হয়। এর পেছনে ঘরবন্দি হয়ে থাকা ও গেজেটের প্রতি অতিরিক্ত আসক্তির সম্পর্ক পেয়েছেন গবেষকরা।
গবেষকরা জানান, দেশের ৭০ ভাগ শিক্ষার্থীই শারীরিক কোনও কাজ বা খেলাধুলার অবকাশ পায়নি ২০২০ সালে এবং তাদের ৫০ ভাগ ঘরের বাইরে কোনও শারীরিক কর্মকাণ্ডের সুযোগ একেবারেই পায়নি। মাত্র ২৫ ভাগ শিক্ষার্থী গেজেট ব্যবহার করেছে নিয়মিত অনলাইন ক্লাসের জন্য এবং ৪০ ভাগ শিক্ষার্থী কার্টুন, নাটক ও চলচ্চিত্র দেখার কাজে, ২৭ ভাগ শিক্ষার্থী সমাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারের জন্য এবং ১৭ ভাগ গেম খেলার জন্য গেজেট ব্যবহার করেছে।
গবেষণার তথ্য বলছে, সবচেয়ে বেশি মোবাইল ফোন ও গেজেটের ব্যবহার দেখা গেছে ইংরেজি মাধ্যমের ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে এবং সবচেয়ে কম দেখা গেছে মাদ্রাসা ও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝে।
অন্যান্য উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের মতো বাংলাদেশেও ইন্টারনেট ও তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ছে। বর্তমানে দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৯ কোটি ৩৭ লাখ, যা মোট জনসংখ্যার ৬২ শতাংশ। করোনাকালে এ সংখ্যা আরও বেড়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের মতে, চার থেকে ১৭ বছর বয়সি অন্তত ৬০ লাখ শিশু-কিশোর বর্তমানে ‘এডিএইচডি’তে (অ্যাটেনশন ডেফিসিট হাইপার অ্যাক্টিভিটি ডিসঅর্ডার) আক্রান্ত। মাত্রাতিরিক্ত ইন্টারনেট ও মোবাইলের প্রতি আসক্তি এডিএইচডি নামক মানসিক রোগের সৃষ্টি করে। এ ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত ব্যক্তি নির্দিষ্ট কোনো কাজে পূর্ণ মনোযোগ দিতে পারে না।
গত দুই দশকে এ রোগে আক্রান্তের সংখ্যা দ্বিগুণ বেড়েছে এবং মোবাইল ডিভাইসে অতিরিক্ত আসক্তিকেই এর মূল কারণ হিসাবে চিহ্নিত করেছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। শিশুদের কল্পনা ও চিন্তাশক্তিও কমে যাচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
দেশের ৭০ ভাগ শিক্ষার্থীই শারীরিক কোনও কাজ বা খেলাধুলার অবকাশ পায়নি ২০২০ সালে এবং তাদের ৫০ ভাগ ঘরের বাইরে কোনও শারীরিক কর্মকাণ্ডের সুযোগ একেবারেই পায়নি।
সম্প্রতি আমেরিকার এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, কিশোরীদের ৯০ শতাংশেরও বেশি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে এবং ভিডিও গেম খেলে।
৫০ শতাংশ কিশোর স্বীকার করেছে, তারা তাদের স্মার্টফোনে আসক্তি বোধ করে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখে যাচ্ছে, অল্পবয়সি ছেলেমেয়েরা দিনে পাঁচ থেকে আট ঘণ্টা ডিজিটাল যন্ত্র নিয়ে মেতে থাকছে। বাইরে বেড়াতে যাওয়া, খেলাধুলা করা, মুখোমুখি বসে আড্ডা দেওয়া ইত্যাদি সব ধরনের ফেস-টু-ফেস ইন্টার-অ্যাকশনে আগ্রহ কমে যাচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডিজিটাল আসক্তিতে শিশু-কিশোর শিক্ষার্থীরা মানসিক ও শারীরিকভাবে চরম ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মানসিক স্বাস্থ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, তাদের মধ্যে বিষণ্নতা, খিটখিটে স্বভাব, উগ্রতা, হঠাৎ রেগে যাওয়া, অপরাধপ্রবণতা, উদ্বেগ, একাকী থাকতে ইচ্ছা করা, বুদ্ধির বন্ধত্ব, নিয়মিত স্কুলে যেতে ইচ্ছা না করা, ভালো কথার নেগেটিভ রিঅ্যাক্ট করা, স্মৃতিশক্তি হ্রাস, মানসিক উন্মাদনা ইত্যাদি নানাবিধ জটিলতা দেখা দেয়, এমনকি এক পর্যায়ে ইন্টারনেট ব্যবহার করতে না পেরে আত্মহত্যার মতো ঝুঁকিও নিয়ে থাকে।
ইতোমধ্যে বাংলাদেশে এমন অনেক দুর্ঘটনাও ঘটেছে। অনুরূপভাবে শারীরিক স্বাস্থ্য পর্যালোচনায়ও দেখা গেছে, তাদের মধ্যে নানা সমস্যা দেখা দেয়। যেমন, পিঠে ব্যথা, ঘাড় ব্যথা, দুর্বলতা, কার্পাল টানেল সিনড্রোম, মাথাব্যথা, অনিদ্রা, চোখের শুষ্কতা, অন্যান্য দৃষ্টি সমস্যা, অতিরিক্ত ওজন হ্রাস বা স্থূলত্বসহ বিভিন্ন ধরনের রোগ শরীরে দানা বাঁধতে থাকে।
তারা বলেন, এ মানসিক ও শারীরিক প্রভাবগুলোর পাশাপাশি ইন্টারনেট আসক্তিতে শিক্ষার্থীদের সামাজিক ক্ষতিও হয়ে থাকে। ছেলেমেয়েরা অসামাজিক হয়ে ওঠে, কারও সঙ্গে মিশতে চায় না, যোগাযোগ রাখতে চায় না, আত্মীয় বা বন্ধুদের সঙ্গেও ঠিকমতো কথা বলতে চায় না ইত্যাদি সমস্যা দেখা দেয়। মোটকথা, ডিজিটাল আসক্তি শিক্ষার্থীদের জীবনে মারাত্মক ক্ষতি সাধন করে থাকে। লেখাপড়া ঠিকমতো না করে অনেক ক্ষেত্রে বখাটে জীবনযাপন করে এবং পরিণত হয় কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যে। তখন সমাজে অনাচার, অত্যাচার, নিরাপত্তাহীনতার পরিবেশ তৈরি। ফলে পিতা-মাতার কাছে আদরের সন্তানেরা তখন বোঝা হয়ে দাঁড়ায়।
গবেষণা প্রসঙ্গে ড. মাহবুবুর রশিদ বলেন, ‘অতি অল্প বয়সে গেজেট নির্ভরশীলতা শিশুদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে। এসব সমস্যা যদি দীর্ঘ মেয়াদি হয়, তবে দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের একটি বড় অংশের জন্যই তা আশঙ্কার বিষয়।’
গবেষক দলের অন্যতম ড. অলোক পাল বলেন, ‘এই সমস্যাগুলো দির্ঘায়িত হচ্ছে কিনা তা খতিয়ে দেখতে হবে। শিশুদের গেজেট আসক্তি কমানোর জন্য পারিবারিকভাবে বিভিন্ন উদ্যোগের প্রয়োজন।’
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮২৯
আপনার মতামত জানানঃ