বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি, জলবায়ু পরিবর্তন, চোরা শিকার, আবাসস্থল ধ্বংসসহ নানা কারণে শৌর্য-বীর্যের প্রতীক বাঘের অস্তিত্ব বিশ্বজুড়েই হুমকির মুখে রয়েছে। এর মধ্যে সুন্দরবনসহ ভারতের আরও কিছু অংশে পাওয়া যাওয়া রাজকীয় বাঘদের অবস্থা সবচেয়ে করুণ। চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসে ভারতে মারা গেছে অন্তত ৯৯টি বাঘ। বছর শেষে এই সংখ্যা আরও বাড়তে পারে, এমনকি তা কয়েক বছরের রেকর্ডকে ছাড়িয়েও যেতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে দেশটির জাতীয় বাঘ সংরক্ষণ কর্তৃপক্ষ (এনটিসিএ)।
এনটিসিএর তথ্যের বরাত দিয়ে করা এক প্রতিবেদনে শুক্রবার টাইমস অব ইন্ডিয়া জানিয়েছে, চলতি বছর ১ জানুয়ারি থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ভারতের মধ্যপ্রদেশে মারা গেছে সবচেয়ে বেশি বাঘ, ৩২টি। এ ছাড়া এই সময়সীমায় মহারাষ্ট্রে মারা গেছে ২০টি বাঘ এবং কর্নাটকে মারা গেছে ১৫টি বাঘ। অন্য মৃত বাঘগুলো সুন্দরবনের ভারতীয় অংশ ও দেশটির অন্যান্য প্রদেশের সংরক্ষিত বনাঞ্চলের।
২০১৮ সালের বাঘশুমারি অনুযায়ী ভারতে মোট বাঘের সংখ্যা ২ হাজার ৯৬৭। তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি বাঘ রয়েছে মধ্যপ্রদেশে, ৫২৬টি। রাজ্যের যে সংরক্ষিত বনাঞ্চলগুলোতে বাঘ রয়েছে সেগুলো হলো কানহা, বান্ধবগড়, পেঞ্চ, সাতপুরা এবং পান্না।
এনটিসিএর কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, চোরা শিকার, দুর্ঘটনা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগে মৃত্যু হয়েছে এই বাঘগুলোর। পাশাপাশি, বছর শেষে এই সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলেও শঙ্কা জানিয়েছেন তারা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বন্যপ্রাণী সংরক্ষণবিদ টাইমস অব ইন্ডিয়াকে জানিয়েছেন, ভারতে সামনের দিনগুলোতে বাঘ সংরক্ষণ ও এই প্রাণীগুলোকে টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে।
তিনি বলেন, ‘সাম্প্রতিক দু-তিন বছরে ভারতে বাঘের জন্মহার কিছুটা বেড়েছে— এটি সত্য, কিন্তু একই সঙ্গে ভারতে প্রতিদিন বনাঞ্চল কমে আসছে— সেটিও সত্য। বনাঞ্চল হ্রাসের এই হার যদি অব্যাহত থাকে, সেক্ষেত্রে অদূর ভবিষ্যতে খাদ্য ও আবাস সংকটের মুখে পড়বে ভারতের বাঘ।’
‘ফলে বাধ্য হয়ে তারা লোকালয়ে আসা শুরু করবে এবং মানুষের সঙ্গে বাঘের সংঘাত আরও তীব্র হয়ে উঠবে।’
ভারতে এক বছরের সময়সীমায় সবচেয়ে বেশি বাঘের মৃত্যু রেকর্ড করা হয়েছিল ২০১৬ সালে। ওই বছর দেশটিতে মারা গিয়েছিল ১২১টি বাঘ। গত বছর ভারতে মৃত্যু হয়েছে ১০৬টি বাঘের।
সর্বশেষ ২০১৯ সালে ভারতের দিল্লিতে অনুষ্ঠিত বাঘসমৃদ্ধ ১৩টি দেশের সম্মেলন উপলক্ষে প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেশের বাঘ সুরক্ষা কার্যক্রমের অগ্রগতির তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, বিশ্বে ৩ হাজার ৮৯০টি বাঘ রয়েছে। এর মধ্যে ভারত বাঘের সংখ্যা দেড় হাজার থেকে বাড়িয়ে ২ হাজার ২২৬টি করেছে। নেপাল ১০০টি থেকে বাড়িয়ে ১৯৮টি, ভুটান ৫০টি থেকে ১০৩টি করেছে। থাইল্যান্ড বাঘের সংখ্যা ৯০টি থেকে ১৮৯টি করেছে। আর চীনে বাঘের সংখ্যা সাতটি, লাওসে দুটি, ভিয়েতনামে পাঁচটিতে নেমে এসেছে। আর কম্বোডিয়া ও মিয়ানমারে বাঘ বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
বাংলাদেশে ২০০৪ সালের পায়ের ছাপ গুনে করা জরিপে ৪৪০টি বাঘ থাকার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু ২০১৫ সালে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো ক্যামেরা ফাঁদের মাধ্যমে করা জরিপে বাঘের সংখ্যা বেরিয়ে আসে ১০৬টি। এরপর ২০১৮ সালে বাংলাদেশ আরেকটি শুমারি করে জানায়, বাঘের সংখ্যা ১১৪টি। ২০২১ সালে বাংলাদেশের আরেকটি জরিপ করার কথা থাকলেও তা এ বছর না–ও হতে পারে।
সংশ্নিষ্ট বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, সুন্দরবনের পার্শ্ববর্তী এলাকায় গড়ে তোলা শতাধিক ভারী শিল্প প্রতিষ্ঠান, ফুড সাইলো এবং বনের মধ্য দিয়ে চলাচল করা জাহাজের দূষণ বাঘের ক্ষতি করছে। গাছ কাটা, খাদ্য সংকট, বিষ দিয়ে মাছ ধরা ও অপরিকল্পিত পর্যটনে বিরূপ প্রভাব পড়ছে বাঘের ওপর। এ ছাড়া লোকালয়ে চলে আসায় পিটিয়ে হত্যার পাশাপাশি রয়েছে পাচারের উদ্দেশ্যে বাঘ শিকার।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, সংকট সমাধানে এখনই বাঘ শিকার রোধ করতে হবে। এছাড়া জলবায়ু পরিবর্তন এবং সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি রোধেও কাজ করতে হবে। সুন্দরবনের মতো এ রকম জায়গা বিশ্বের আর কোথাও নেই। তাই বাঘকে বাঁচাতে হলে সুন্দরবনের ইকোসিস্টেম সংরক্ষণ করতে হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫১২
আপনার মতামত জানানঃ