বাংলা সংস্কৃতির হারিয়ে যাওয়া অনেক উপকরণের কথা বলতে গেলে ঘাটু গানের কথা এসে পড়ে। কিন্তু তার ইতিহাসে ঐতিহ্যের উজ্জ্বল দিকটার তুলনায় যেন অন্ধকার দিকটাই বেশি। এই ইতিহাস মনে করিয়ে দেয় অসংখ্য কিশোরের উপর যৌন নির্যাতনের ছবি। তখনও চাইল্ড অ্যাবিউজ নিয়ে সচেতনতা গড়ে ওঠেনি পৃথিবীর কোথাও। তাই সেই নাবালক কিশোরদের কান্নার খবর যে কেউ রাখেনি, সেকথা বলাই বাহুল্য।
অনেক ইতিহাসবিদ মনে করেন ঘাটু গানের হাত ধরেই সমকামিতা প্রশস্ত জায়গা করে নেয় দুই বাংলার সংস্কৃতিতে। ওই সময়ে ঘাটুদের নিয়ে নানা ধরনের যৌন লালসা চরিতার্থ করতো এক ধরনের বিকারগ্রস্ত প্রভাবশালী মানুষ। এর ফলে ওই সময়ে সমকামিতার উত্থান ঘটে বলে মনে করেন অনেকেই; যা কখনও বাংলার ধর্মপ্রাণ মানুষ মেনে নিতে পারেনি বা প্রত্যাশা করেনি। ফলে ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে থাকে ঘাটু গানের সংস্কৃতি।
প্রাচীন ময়মনসিংহ গীতিকার সংগ্রাহক চন্দ্রা কুমার দে বলেন, ঘাটুদের কেনাবেচা ও দর্শকদের কাছে নোংরাভাবে প্রদর্শন করা নিয়ে সমাজে নানা সংঘাত দেখা দেয়। ঘাটুদের যৌন আকর্ষণীয় করে তুলে অপসংস্কৃতির দোরগোড়ায় পৌঁছাতে সহায়তা করে। এখানেও একটা বিতর্ক মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। কিশোরদের উপরে সেই সব পাশবিক নির্যাতনকে ছাপিয়ে সমাকিমতার প্রতি বাংলার মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি ও ধর্মীয় অবস্থানই মূলত বিলুপ্তি ঘটায় ঘাটু গানের। তবে যে কারণেই হোক, নিষ্ঠুরতার অবসান সবসময়ই স্বস্তির। স্বস্তির কথাটা জোর দিয়েই বলব, কারণ ওই সময় ঘাটুদের কেনাবেচার মাধ্যমে খানিকটা নতুন বোতলে পুরনো মদের মতো দাস প্রথারও প্রচলন ঘটিয়েছিল এই ঘাটু গান।
পশ্চিমবঙ্গের নদী অঞ্চল ও বাংলাদেশের হাওড়ের এক বিলুপ্তপ্রায় পল্লীসঙ্গীত হলো এই ঘাটু গান। নদীর ঘাটে নৌকা ভিড়িয়ে এই গান গাওয়া হতো বলে একে ঘাটু গান বলা হতো। প্রাচীনকালে নববর্ষ পালনে ঘাটু সংস্কৃতির যোগসূত্র ঘটে। ঘাটু গানের সাথে উপভোগ্য বিষয় ছিল এই গানের নাচ।
ঘাটু গানে নিম্নবিত্ত শ্রেণীর ১৪-১৫ বছর বয়সী কিশোরেরা মেয়েদের বেশে নাচ গান পরিবেশন করত। অল্প বয়সী নাবালক ছেলেকে মেয়ে রূপে সাজিয়ে নাচের কিছু সহজ মুদ্রা শিখিয়ে বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রের তালে তালে বাইজিদের অনুষ্ঠানের মতো করে ঘাটুর আসর জমানো হতো। বাংলার ঢোল, মন্দিরা, বাঁশি, বেহালা ও হারমোনিয়ামের ব্যবহার হতো ঘাটু গানে৷ বাড়ির মতো করে গোল প্যান্ডেল বানিয়ে তার ভেতরে শ্রোতারা উপভোগ করতেন এই গান। ঘুঙুর পায়ে বাইজি সেজে নাবালক ছেলেরা নাচার সময় কেউ কেউ তাদের দিকে টাকা-পয়সাও ছুঁড়ে দিতো।
ঘাটু গানের এক সময় গগনচুম্বী খ্যাতির পরও ক্রমশ হারিয়ে যায় ঘাটু গান। এর মূল কারণ হলো ঘাটুদের কেনাবেচা ও তাদের দর্শকদের সামনে নোংরা ভাবে প্রদর্শন করা; যা ধীরে ধীরে সংস্কৃতির অংশ হয়ে উঠেছিল এবং ঘাটুদের মনে ও শরীরে যার প্রভাব ছিল ভয়াবহ। এভাবেই ঘাটু গান অপসংস্কৃতির আখড়া হয়ে ওঠে।
ঘাটু গানের প্রচলন কবে, কখন শুরু হয়েছিল— তা সঠিক করে বলা মুশকিল। তবে মোটামুটি মনে করা হয় ষোড়শ শতকের প্রথম দিকে শ্রীহট্টের কাছে আজমিরিগঞ্জ এলাকার এক বৈষ্ণব আচার্য ও তার কম বয়সী শিষ্যদের রাধাভাবকে আশ্রয় করে ঘাটু গানের সূত্রপাত। আর তাই শেষ সময় পর্যন্ত ঘাটুদের নাচের সঙ্গে যে চটুল গান ব্যবহৃত হত, তার বিষয়বস্তুও হতো রাধা-কৃষ্ণের প্রেমলীলা, বিশেষ করে রাধাবিরহ।
আবার কারও কারও মতে বৃহত্তর সিলেটের আজমিরীগঞ্জের উদয় আচার্য ছিলেন ঘাটু গানের প্রবর্তক। তার মাধ্যমে ঘাটু গানের প্রবর্তন হয়। তখন ঘাটু গান গাওয়া হতো পূজা বা অর্চনার মতো একটি পবিত্র মাধ্যম হিসেবে। তার মৃত্যুর পর এই ঘাটু গানকে বাণিজ্যিক করে বেশ জনপ্রিয় করার চেষ্টা করা হয়।
প্রাচীন যুগে সামন্ত প্রভুরা অন্দরমহলে বাইজির নাচ-গানের আয়োজন করত। তাতে সাধারণ মানুষের প্রবেশাধিকার ছিল না। তখন কিছু মধ্যবিত্ত শৌখিন যুবকের প্রচেষ্টায় গড়ে উঠে ঘাটু গানের প্রচলন। ঘাটু গান মূলত ছেলেভিত্তিক গান, বারো থেকে পনেরো বছরের ছেলেদের ঘাটু বানানোর জন্য মেয়েলি চেহারার ছেলেকে ঘাগড়ি বা শাড়ি পড়িয়ে ম্যাচিং করা ব্লাউজ, কানে দুল, দু’হাতে রঙিন রুমাল বেঁধে মঞ্চে উঠানো হতো। ঘাটুর নাচে অঙ্গভঙ্গি ছিল দর্শক মনোরঞ্জনের প্রধান আকর্ষণ। সেই সঙ্গে একজন গানের সুন্দর কণ্ঠধারী লোক থাকত, যে ঘাটুকে পোষণ করত। ঘাটু গান সাধারণত রাধা কৃষ্ণের প্রেম নিয়ে রচিত হতো।
তবে ক্রমশ এই ধর্মীয়-দার্শনিক সীমারেখা অতিক্রম করে ঘাটু গান হয়ে ওঠে এক ধরনের যৌনলিপ্সার প্রতীক। আর সেই লিপ্সার শিকার ঘাটু কিশোরেরাই। তাদের লম্বা চুল রাখা এবং মহিলাদের মতো সাজপোশাক করা বাধ্যতামূলক ছিল। এমনকি মহিলাদের মতো চালচলনও অভ্যেস করতে হতো তাদের। আর এই নারীবেশী কিশোরদের মাঝখানে রেখে চটুল গানের তালে তালে রীতিমতো বাইজির মতো নাচতে হত। এতেই তৃপ্ত হত মানুষের আকাঙ্খা।
একটি ঘাটু দলে একজন মূল ঘাটু ছেলে ছাড়াও বেশ কয়েকজন সদস্য থাকত। তারা প্রত্যেকেই ছিল ঘাটু, অর্থাৎ তাদেরও মেয়ে সেজে থাকতে হত। আর থাকতেন একজন ‘সরকার’ বা ‘মরাদার’ (মহড়াদার>মরাদার)। এই সরকাররাই ঘাটুকে নাচে-গানে এবং তত্ত্বকথায় পারদর্শী করে তুলতেন।
এছাড়া আরও যারা থাকতেন তারা হলেন দোহার বা পাইলদার। এরা ছিলেন বাদ্যযন্ত্রশিল্পী, সময় সময় গানের দোহার ধরতেন। ঘাটুর সঙ্গে সমস্বরে উচ্চগ্রামে সুর তুলে তারা দর্শকের মন মাতিয়ে তুলতেন। তখন ঢোল, খোল, করতাল বাঁশির পাশাপাশি হারমোনিয়াম এবং দোতারাও ব্যবহার করা হতো।
একটি দলের একক অনুষ্ঠানের প্রচলন যেমন ছিল, তেমনই ছিল দুটি ঘাটু দলের প্রতিযোগিতার প্রচলনও। তখন একটি দল গানের কথায় অপর দলকে একটি প্রশ্ন করত, আর সেই দলকে উত্তর দিতে হত গানের মাধ্যমেই। খানিকটা কবিয়ালের মতো। তবে কবিয়ালের ক্ষেত্রে দার্শনিক উপসঙ্গ প্রধান হয়ে উঠলেও এখানে সেই অবকাশ ছিল না। এখানে চটুলতাই ছিল প্রধান। স্থানে স্থানে বিপক্ষ দলকে পরাজিত করতে অশ্লীল রসিকতার আশ্রয় নিত ঘাটুরাও। তবে তার থেকেও অন্ধকার ভবিষ্যত অপেক্ষা করে ছিল এই গানের ধারাটির জন্য। আর সেটা এলো সতেরো-আঠেরো শতক নাগাদ।
সতেরো-আঠেরো শতক নাগাদ এটা রূপ নেয় দাসপ্রথায়। ওই সময়ে ঘাটু ছেলেদের কিনে নেওয়ার প্রচলন শুরু হয়। যারা ছেলেদের কিনে নিতেন তাদের বলা হতো ‘সৌখিনদার’ বা ‘খলিফা’। এরা কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শিল্পের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন না। ঘাটু ছেলেদের তারা ব্যবহার করতেন উপপত্নীর মতো।
সমকামী বিত্তবান বিশেষ করে জোতদার প্রমুখদের এইসব কিশোরদের যৌনসঙ্গী হিসেবে পাবার বিষয়টি সামাজিকভাবে স্বীকৃতি পেয়ে যায়। হাওর অঞ্চলের জমিদার ও বিত্তবান সৌখিন মানুষরা বর্ষাকালে জলবন্দি সময়টায় কিছুদিনের জন্যে হলেও ঘাটুদের নিজের কাছে রাখবেন এই বিষয়টা স্বাভাবিকভাবে বিবেচিত হতে থাকে। এই সময়টায় তাদের নিয়মিত শয্যাসঙ্গী হতে হতো সেই সব অভিজাত মানুষদের। এক সময় এটাই প্রথা হয়ে দাঁড়ায়। তখন এই প্রথার বিপক্ষে সমাজ কোনো প্রশ্ন তোলেনি কিংবা তুলবার সাহস করেনি।
এমনকি অনেক লোককথায় এমনও জানা যায় যে সৌখিনদারদের স্ত্রীরা ঘাটুদের ঈর্ষা করতেন। তবে ঘাটুদের দিনের পর দিন এভাবে নির্যাতিত হওয়ার যন্ত্রণার খোঁজ কেউ রাখত না। ক্রমশ বিশ শতকে এসে যখন নাচগানের থেকে এই অশ্লীল যৌনাচারের দিকটাই প্রধান হয়ে ওঠে, তখন আর এই সংস্কৃতিকে টিকিয়ে রাখার কোনো জায়গা ছিল না। ‘ঘাটু’ শব্দটি ক্রমশ অপভাষায় পরিণত হয়। আর সেইসঙ্গে কিশোরদের নিরাপত্তার বিষয়টিও প্রকাশ্যে আসতে শুরু করে।
বৈষ্ণব সম্প্রদায়গুলির রাধাভাবের মধ্যে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের মুক্তির কথা লুকিয়ে ছিল বলে মনে করেন অনেকেই। অথচ সেই একই মূল থেকে জন্ম নিয়েছিল এমন একটি ঘৃণ্য প্রভাব। আমাদের সংস্কৃতিতে যেমন গর্ব করার মতো উপাদানেরও অভাব নেই, তেমনই ‘ঘাটু’ গান এক অন্ধকার ইতিহাসের কথাই মনে পড়ায়। যে ইতিহাসকে ফেলে আসতে পারা সত্যিই এক সামাজিক সাফল্য।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৭৪৪
আপনার মতামত জানানঃ