কিছু টিকা মানুষকে আজীবন সুরক্ষা দেয়। যেমন হামের এক টিকাই আজীবন হাম থেকে সুরক্ষিত রাখে মানুষকে। চিকেনপক্সের টিকা মানুষকে সুরক্ষিত রাখে ১০ থেকে ২০ বছর পর্যন্ত। কিন্তু কোভিডের বেলায় হচ্ছে উল্টো। টিকা নেওয়ার মাত্র ছয় মাস পরই বয়স্কদের বুস্টার ডোজ নেওয়ার জন্য তোড়জোড় শুরু করে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রসহ বেশ কিছু দেশ।
যেখানে অধিকাংশ টিকাই আজীবনের জন্য কার্যকর হয়ে থাকে, সেখানে করোনার টিকা কেন এত অল্প কিছুদিন স্থায়ী হয়?
বিশেষজ্ঞদের মতে, যেকোনো টিকার প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে প্রাকৃতিক সংক্রমণ থেকে সুরক্ষা প্রদান করা, গুরুতর অসুস্থতা বা মৃত্যুর ঝুঁকিকে বাতিল করা।
এ প্রসঙ্গে ইমোরি বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞানের অধ্যাপক রুস্তম এন্টিয়া বলেন, “টিকা নেওয়ার পর যদি কেউ ভাইরাসের সংস্পর্শে এসেও আক্রান্ত না হয়, তখন আপনি একে বলতে পারেন বেশ ভালো টিকা। সব টিকাই কিন্তু আদর্শ না।”
তিনি বলেন, প্রতিরক্ষার তিনটি স্তর। যার মধ্যে রয়েছে সংক্রমণের বিরুদ্ধে পূর্ণ সুরক্ষা; গুরুতর অসুস্থতা ও সংক্রমণের বিরুদ্ধে সুরক্ষা; অথবা শুধুমাত্র গুরুতর অসুস্থতার বিরুদ্ধে সুরক্ষা।
সুরক্ষা মাত্রা
টিকার কার্যকারিতা নির্ভর করে রোগ প্রতিরোধের মাত্রা, কত দ্রুত অ্যান্টিবডি ক্ষয় হয়, ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়ায় পরিবর্তন আনে কি না এবং সংক্রমণের অবস্থানের উপর।
অসুস্থতা থেকে রক্ষা করার জন্য যে পরিমাণ রোগ প্রতিরোধের মাত্রা প্রয়োজন, সেটাই হচ্ছে (টিকার) সুরক্ষার সীমা। প্রতিটি রোগের জন্য এই সীমা আলাদা। এবং এই সীমা নির্ধারণের প্রক্রিয়াও পরিবর্তনশীল।
ওরেগন হেলথ অ্যান্ড সায়েন্স ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক মার্ক স্লিফকা বলেন, “এই সুরক্ষার সীমা মূলত রক্তের প্রতি মিলিলিটারে অ্যান্টিবডি বা নিরপেক্ষ অ্যান্টিবডিদের মাত্রা।”
টি-কোষগুলোও সুরক্ষায় অবদান রাখে। কিন্তু অ্যান্টিবডি পরিমাপ করাটা সহজ। ১৯৪২ সালে টিটেনাসের জন্য সুরক্ষার সীমা প্রতি মিলিলিটারে ০.০১ আন্তর্জাতিক ইউনিট নির্ধারণ করা হয়েছিল। সে সময় প্রাণীদের উপর হওয়া ট্রায়ালকে পূর্ণাঙ্গতা দেওয়ার জন্য দুজন জার্মান গবেষক নিজেদেরকেই বেছে নিয়েছিলেন ট্রায়ালের বস্তু হিসেবে।
অধ্যাপক মার্ক স্লিফকা বলেন, “তাদের একজন নিজের উরুতে টিটেনাসের দুটি প্রাণঘাতী ডোজ নিয়ে বুঝার চেষ্টা করছিলেন টিকার কার্যকারিতা। তার সহ-লেখক নিয়েছিলেন তিন ডোজ। তাদের কেউই পরবর্তীতে অসুস্থ হননি। যার মানে, টিকা কাজ করছে।”
১৯৮৫ সালে একটি কলেজের ক্যাম্পাসে হামের ব্যাপক সংক্রমণ ঘটলে হামের টিকার জন্যও একটি সীমা নির্ধারণ করা হয়। গবেষকরা শিক্ষার্থীদের রক্তে অ্যান্টিবডির ঘনত্ব পরীক্ষা করে সিদ্ধান্ত নেয় প্রতি মিলিলিটারে ০.০২ আন্তর্জাতিক ইউনিট হামের সংক্রমণ সুরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় সীমা।
এই রোগগুলোর ক্ষেত্রে, টিকার সুরক্ষার মাত্রার সঙ্গে অ্যান্টিবডিগুলোর ক্ষয়ের হার মিলিয়ে টেকসই প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়ে থাকে। হামের অ্যান্টিবডি ধীরে ধীরে ক্ষয় হয়। আবার টিটেনাসের অ্যান্টিবডি বেশ দ্রুত ক্ষয় হয়। যে কারণে টিটেনাসের টিকা শরীরে প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি অ্যান্টিবডি উৎপাদন করে, যা ক্ষয় হয়ে যাওয়া অ্যান্টিবডির শূন্যতা পূরণ করতে সক্ষম হয়।
অধ্যাপক মার্ক স্লিফকা বলেন, “টিটেনাস, ডিপথেরিয়া, হাম এবং ভ্যাকসিনিয়ার ক্ষেত্রে আমরা ভাগ্যবান। আমরা সুরক্ষার থ্রেশোল্ড বা সীমা চিহ্নিত করতে পেরেছি। আপনি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অ্যান্টিবডি হ্রাস পাওয়ার হারটা মাপবেন, এবং যদি আপনি সুরক্ষার সীমা জানেন, তাহলে আপনি সুরক্ষার স্থায়িত্বও গণনা করতে পারেন। কোভিডের ক্ষেত্রে যে ব্যাপারটি এখনো জানি না আমরা।”
প্রতিলিপি
ঐতিহাসিকভাবে, সবচেয়ে কার্যকর টিকাগুলো বানানো হয়েছে ভাইরাসের প্রতিলিপি ব্যবহার করে, যার কারণেই মূলত আজীবনের জন্য রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অর্জিত হয়েছে। যেমন হাম এবং চিকেনপক্সের টিকাতে প্রতিলিপি ভাইরাস ব্যবহার করা হয়েছে।
প্রতিলিপিবিহীন এবং প্রোটিন ভিত্তিক টিকাগুলো (যেমন, টিটেনাসের টিকা) বেশি দিন স্থায়ী হয় না। কিন্তু প্রতিক্রিয়ার মাত্রা বাড়ায় এমন একটি এডজ্যুভেন্ট বা সহায়ক সংযোজনের মাধ্যমে তাদের কার্যকারিতা বাড়ানো যেতে পারে। টিটেনাস এবং হেপাটাইটিস এ’র টিকাতে সহায়ক ব্যবহার করা হয়।
জনসন অ্যান্ড জনসন এবং অ্যাস্ট্রাজেনেকার কোভিড টিকা নন-রেপ্লিকেটিং অ্যাডেনোভাইরাস ব্যবহার করে এবং এতে কোনো এডজ্যুভেন্ট বা সহায়ক থাকে না। ফাইজার এবং মডার্না হচ্ছে এম-আরএনএ টিকা, যাদের কার্যপ্রণালী একেবারে ভিন্ন। এদের মধ্যে ভাইরাসের কোনোরকম অস্তিত্বই থাকে না।
মিউটেশন
আবার শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা থেকে রক্ষা পেতে ভাইরাস এবং ব্যাকটেরিয়া নিজেরা পরিবর্তিত হয়, যা নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। এই প্রক্রিয়াকেই বলে মিউটেশন।
হাম, মাম্পস, রুবেলা এবং চিকেনপক্স খুব কমই পরিবর্তিত হয়। কিন্তু ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নালের দেওয়া তথ্য অনুসারে, ইতোমধ্যে কোভিডের অন্তত আটটি উল্লেখযোগ্য ভ্যারিয়েন্ট বা ধরন পাওয়া গেছে।
অধ্যাপক মার্ক স্লিফকা বলেন, “এটি টিকার কাজ আরও জটিল করে তোলে। সময়ের সাথে টিকার লক্ষ্য পরিবর্তিত হয়ে একাধিক লক্ষ্য গড়ে উঠে (বিভিন্ন ভ্যারিয়েন্টের জন্য)। ফ্লুও পরিবর্তিত হয়। কিন্তু এক্ষেত্রে আমরা ফ্লুয়ের নতুন ধরণের সঙ্গে সমন্বয় রেখে প্রতি বছর নতুন একটি ফ্লু ভ্যাকসিন তৈরি করি।”
ফ্লুয়ের টিকা আপনাকে কমপক্ষে ছয় মাসের জন্য সুরক্ষা প্রদান করতে পারে। এরকম পরিবর্তনকারী একটি ভাইরাস মোকাবেলায় কার্যকর টিকা তৈরির চিন্তাকে বাদ দিয়ে অনেকেই হার্ড-ইমিনিউনিটির মাধ্যমে কোভিড-১৯ কে পরাজিত করার স্বপ্ন দেখছিলেন।
কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতে, করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রে সেটা হওয়ার সম্ভাবনা কম। তারা বলেন, “শ্বাসযন্ত্রের বিভিন্ন ইনফেকশনের ক্ষেত্রে দীর্ঘস্থায়ী হার্ড ইমিউনিটি গড়ে তুলতে পারবে না টিকাগুলো। তাই করোনার ক্ষেত্রে একটি সীমিত সময়ের জন্য স্থায়ী হয় হার্ড ইমিউনিটি। ভাইরাস কত দ্রুত পরিবর্তিত হয় তার উপর নির্ভর করে এটি। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কত দ্রুত হ্রাস পায় তার উপরও নির্ভর করে হার্ড ইমিউনিটি।”
করোনাভাইরাস শ্বাসতন্ত্রের উপর এবং নীচ উভয় অংশের অঙ্গগুলোকেই সংক্রমিত করে। ড. স্লিফকা বলেন, “আমাদের ফুসফুস এবং শরীরে ভালো সঞ্চালন আছে, যেটা নাসারন্ধ্রের উপরিভাগে নেই। আমরা গুরুতর রোগ প্রতিরোধ করতে পারি কারণ শ্বাসতন্ত্রের নিচের অংশে অ্যান্টিবডি রয়েছে।”
এ কারণেই শ্বাসতন্ত্রের উপরের অংশে নিম্নস্তরের সংক্রমণের ঝুঁকি থেকেই যায় সবসময়। সামনে নিশ্চিতভাবেই কোভিডের বিভিন্ন ধরন মোকাবেলা করতে টিকাগুলোকে আপডেট করা হবে।
ইম্পেরিয়াল কলেজ লন্ডনের গবেষকদের মতে, পরবর্তী প্রজন্মের টিকাগুলো নাক এবং ফুসফুসের আর্দ্র পৃষ্ঠে অনাক্রম্যতা বাড়ানোর দিকেও মনোযোগ দিবে। এই মুহূর্তে নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না কিছুই। কিন্তু এই জটিল ভাইরাস থেকে মুক্তি পেতে সামনে যে আরও টিকার শট নিতে হবে আমাদের, সেই ইঙ্গিতটা পাওয়া যাচ্ছে।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৭০৯
আপনার মতামত জানানঃ