ডেভিড পার্কার রে। সাম্প্রতিক ইতিহাসে যতজন ব্যক্তি খুনী হিসেবে দোষী সাব্যস্ত হয়েছে, তাদের মধ্য ‘অফিসিয়ালি’ সবচেয়ে ভয়ংকর খুনী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে তাকে। যদিও তাকে কখনো খুনী হিসেবে প্রমাণ করা সম্ভব হয়নি। তার বিরুদ্ধে অপহরণ, ধর্ষণ এবং নারীদেরকে নির্যাতনের অভিযোগ ছিল। আমেরিকার নিউ মেক্সিকো’র একটি ছোট্ট শহরে সে এসব অপকর্ম করেছিল। শহরের নামটা বেশ অদ্ভুত; ট্রুথ অর কনন্সিকোয়েন্স। বাংলায় অনুবাদ করলে অনেকটা এরকম দাঁড়ায় : সত্য কিংবা ফলাফল।
ভিকটিমদের স্মৃতি মুছে দেওয়ার জন্য তাদেরকে ড্রাগ দিতো ডেভিড। নারীদেরকে নির্যাতন করার জন্য তার বাড়ির পেছনে বিশেষভাবে বানানো একটি চেম্বার ছিল। সেই চেম্বারকে সে দুটো নামে ডাকতো, ‘শয়তানের ডেরা’ কিংবা ‘দ্য টয় বক্স’। ডেভিড মানুষ হিসেবে অত্যন্ত নীচ প্রকৃতির হলেও বুদ্ধিমান ছিল। সে প্রায় ৬০ জন ভিকটিমের লাশ গায়েব করে দিয়েছিল, ফলে খুন করেও সে পার পেয়েছে। অবশ্য পর্যাপ্ত সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে তাকে কখনো খুনী হিসেবে দোষী সাব্যস্ত করা যায়নি। এসব অপকর্মে তার নিজের মেয়ে এবং প্রেমিকা সহায়তা করতো। বিভিন্ন অভিযোগের দায়ে আদালতের রায় অনুযায়ী ডেভিডের দীর্ঘদিন কারাভোগ করার কথা থাকলেও মাত্র ৮ মাস জেলে থাকার পর ২০০২ সালে সে হার্ট ফেইল করে মারা যায়।
ডেডিভ পার্কার প্রায় ৪০ বছর ধরে ভয়ঙ্কর সব অপকর্ম করে আসছিল। মূলত মারা যাওয়ার এক বছর আগে তার পতনের যাত্রা শুরু হয়। ১৯৯৯ সালের ২২ মার্চ তার এক সম্ভাব্য ভিকটিম পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়, যার নাম সিনথিয়া ভিজিল। মেয়েটি নগ্ন অবস্থায় নিউ মেক্সিকো’র এলিফ্যান্ট বিউট-এর রাস্তা দিয়ে চিৎকার করতে করতে বেরিয়ে এসেছিল। তার গলায় ছিল কুকুরের গলায় পরানো ধাতব ডগ কলার এবং ঝুলে থাকা চেইন। রীতিমতো কোকাচ্ছিল সে, টালমাটাল অবস্থা। ২১ বছর বয়সী সিনথিয়া দাবি করেছিল, তাকে ৩ দিন ধরে আটকে রেখে ভয়ংকরভাবে ধর্ষণ ও নির্যাতন করা হয়েছে। সে কিডন্যাপারের পরিচয়ও জানিয়েছিল, তার নাম ডেভিড পার্কার রে, বয়স ৫৯। ডেভিড চারবার বিয়ে করলেও কোনোটাই টেকেনি। এলিফ্যান্ট বিউট লেক স্টেট পার্ক-এর সীমান্তে থাকতো সে। একজন মেকানিক হিসেবে পার্ক কর্তৃপক্ষের অধীনে কাজ করতো।
অভিযোগ আমলে নিয়ে পুলিশ ডেভিডকে গ্রেফতার করে এবং তার বাড়িতে অনুসন্ধান চালায়। সেখানে পুলিশ এমন সব আলামত খুঁজে পায় যা সিনথিয়ার দাবির সাথে মেলে। অফিসাররা ডেভিডের বাড়ির পেছনে থাকা একটি সাদা ট্রেইলারে রীতিমতো টর্চার চেম্বার আবিষ্কার করে! তারা রুমটির মাঝে একটি গাইনোকলজিক্যাল চেয়ার দেখতে পায়। চেয়ারটির সাথে বিভিন্ন স্ট্র্যাপ, বন্ধনী সংযুক্ত ছিল। আশেপাশে ছিল বিভিন্ন রকমের টর্চার করার যন্ত্র এবং মোচড়ানো সেক্স টয়। মূলত এটাই হলো ডেভিড-এর সেই ‘দ্য টয় বক্স’ বা ‘শয়তানের ডেরা’।
বিকৃত যৌনতা নিয়ে সিনথিয়া ভিজিল যে বক্তব্য দিয়েছিল, সেটা নিয়ে সন্দেহ পোষণ করার কোনো অবকাশ রইলো না। “এই ট্রেইলারে ঢোকার পর তাকে যৌনদাসী করে রাখা হয়েছিল।” বলেছিলেন স্টেট পুলিশ হিসেবে কর্মরত নরম্যান রোডস। “আমার চোখে প্রথমেই যেটা পড়েছিল তা হলো একটা কালো চেয়ার- গাইনোকলজিক্যাল চেয়ার। সেটা দেখেই আমার কেমন যেন কষ্টদায়ক অনুভূতি হলো। দেয়াল জুড়ে ঝোলানো স্যাডিস্টিক ছবি, বিভিন্ন নির্যাতনের ছবি। আশেপাশে বিভিন্ন ধরনের বন্ধনী আর শেকল চোখে পড়লো। একটা দন্ড দেখলাম, তাতে ডেভিড পার্কার লিখে রেখেছে ‘গোড়ালি প্রসারক’! শুধু তা-ই নয়, বিভিন্ন ধরনের সেক্স টয় ইলেকট্রিক পাওয়ার ড্রিল মেশিনের সাথে সংযুক্ত করা ছিল। পেরেক লাগানো ছিল কৃত্রিম পুরুষাঙ্গের (ডিলডো) সাথে। মোটকথা, ট্রেইলারে থাকা প্রতিটি জিনিস সাক্ষী দিচ্ছিল, এখানে যন্ত্রণাদায়ক এবং ধ্বংসাত্মক কর্মকান্ড পরিচালনা করা হয়। নারীদেরকে ড্রাগ দিয়ে বেহুঁশ করতে পারলেই সে তাদেরকে যেভাবে খুশি ব্যবহার করতে পারতো। নারীরা ছিল তার যৌনদাসী।”
ক্যাপ্টেন রিচ নামের আরেকজন অফিসার বলেছিলেন, “রুমটায় থাকা বিভিন্ন ছোট ছোট গহনা ও অলংকার দেখে ধারণা করা যায়, সিনথিয়ার মতো অন্যান্য নারীদের সাথেও একইরকম নির্যাতন চালানো হয়েছিল। আরো ভিকটিম রয়েছে এ-ব্যাপারে আমরা প্রায় নিশ্চিত ছিলাম। একবার শয়তানের ডেরা’র হদিস পেতেই আমি বুঝতে পেরেছিলাম, আমরা একজন সিরিয়াল কিলারকে খুঁজে পেয়েছি।”
পুলিশ তল্লাশী চালিয়ে ট্রেইলার থেকে দুটো ফিক্সড ভিডিও ক্যামেরা এবং একটি ভিডিও টেপ খুঁজে পেয়েছিল। ভিডিও টেপটিতে দেখা যায়, ডেভিডের নির্যাতনের শিকার একজন মহিলা চেয়ারের সাথে বাঁধাবস্থায় রয়েছে। মহিলাকে দেখে মনে হচ্ছে, তাকে ড্রাগ দেওয়া হয়েছে কিংবা বেহুঁশ করা হয়েছে। মহিলার পায়ে থাকা অদ্ভুত দর্শন একটি ট্যাটু ছাড়া তাকে চিহ্নিত করার মতো উল্লেখযোগ্য আর কিছু দেখা যাচ্ছে না। পরবর্তীতে সেই ট্যাটু প্রেস ও টিভিতে প্রচারিত হলে একজন তরুণী সেটা নিজের বলে স্বীকার করেন। তার নাম কেলি ভ্যান ক্লিভ, বয়স ২৫ বছর, কলোরাডো’র বাসিন্দা। তিনি পেশায় একজন শিশু পরিচর্যাকারী এবং তিনি ডেভিডের ৩৪ বছর বয়সী মেয়ে গ্লেন্ডা জিন (জেসি)-এর বান্ধবীও বটে!
ডেভিডের অন্যান্য যৌনদাসীর মতো কেলিকেও ড্রাগ দিয়ে বেহুঁশ করে, টয় বক্সের ভেতরে শেকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছিল। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হলো, কেলি’র মস্তিষ্কে এ-সংক্রান্ত কোনো স্মৃতি ছিল না! তবে তিনি প্রায়ই দুঃস্বপ্ন দেখতেন। “আমি স্বপ্নে দেখতাম, আমাকে একটা টেবিলে শুইয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে, হাত দুটো বাঁধা, মুখে টেপ লাগিয়ে দেওয়া ইত্যাদি। কিন্তু পরে যখন এফবিআই আমাকে ফোন করলো, তখন বুঝতে পারলাম ওগুলো স্রেফ স্বপ্ন ছিল না।”
তবে পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদে কেলি তার কিছু স্মৃতি ফিরে পেয়েছিলেন। তাকে মূলত ড্রাগ দেওয়া হয়েছিল যেন নির্যাতনের কোনো স্মৃতি মনে রাখতে না পারেন। ড্রাগ হিসেবে সিডেটিভ ব্যবহার করায় অনেক নারী স্মৃতি হারিয়ে ফেলেছিলেন, তাই তারা অপরাধীর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ জানাতে পারেননি।
পরবর্তীতে আরেকটি টেপ পাওয়া গিয়েছিল, সেখানে দেখা যায় ডেভিড শান্ত কিন্তু নিষ্ঠুরভাবে তার শিকারদের উদ্দেশে বলছে, “তোদেরকে (যৌন নির্যাতন করার পদ্ধতি সম্পর্কে ব্যাখ্যা করে) বারবার করব। ফেনোবারবিটাল আর সোডিয়াম পেনটোথালের কড়া ডোজ দেব তোদের (যন্ত্রণার অনুভূতি অসাড় এবং স্মৃতিভ্রষ্ট করার জন্য)। এসব রোমাঞ্চকর ঘটনার কিছুই তোদের মনে থাকবে না।” ভিডিও টেপে তাকে আরো বলতে দেখা যায়, “তোদের গলা ফাঁক করে দিতে আমাকে দ্বিতীয়বার ভাবতে হবে না। তোরা আমার কাছে স্রেফ এক টুকরা মাংসের মতো।”
সেই টেপে দেখা যায়, ডেভিড দাবি করছে সে এপর্যন্ত ৩৭ জনেরও বেশি নারীকে অপহরণ করেছে। পুলিশের ধারণা, তাদের অনেকেই এরমধ্যে মারা গেছেন। পরবর্তীতে সেই এলাকায় এবং আশেপাশের প্রান্তরে বড় পরিসরে অনুসন্ধান চালানো হয়। তার মাঝে এলিফ্যান্ট বিউট লেকও ছিল। লেকের ৬০০ ফুট ভেতরে, স্টেট পার্কে ডেভিড তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে কাজ করতো এবং সেখানে তার একটি পালতোলা নৌকা ছিল। তবে অনেক খোঁজাখুঁজি করে কোনো লাশ পাওয়া যায়নি। তাই ডেভিডের বিরুদ্ধে খুনের মামলা করতে পারেননি রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবিরা।
“আমরা তাকে খুনের দায়ে সাজা দিতে না পারলেও সফলতার সাথে ধর্ষণ, নির্যাতন এবং অপহরণের দায়ে অভিযুক্ত করে সাজার মুখোমুখি করতে পেরেছি। খুনের দায়ে শাস্তির ব্যবস্থা না করতে পারায় অন্যান্য অভিযোগগুলো প্রমাণ করাটা আরো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল।” বলেছিলেন চিফ প্রসিকিউটর, ডেপুটি ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নি জিম ইওনজ।
অবশ্য ডেভিড রে-এর বিরুদ্ধে পরিচালিত মামলাটির ভিত্তি ছিল মূলত দুজন আপাত অনির্ভরযোগ্য সাক্ষীর ওপর বক্তব্য। অনির্ভরযোগ্য বলার কারণ সিনথিয়া ছিল একাধারে হিরোইন-আসক্ত ও যৌনকর্মী। অন্যদিকে কেলি দুঃসহ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে পার হওয়ার কারণে, তার স্মৃতিগুলো অক্ষত ছিল না, আংশিক স্মৃতিই ছিল তার সম্বল। ২০০০ সালের জুলাই মাসে চলা বিচার প্রক্রিয়ায়, বিচারক জানিয়েছিলেন ডেভিড-এর বিরুদ্ধে পেশ করা টেপ-রেকর্ডিং আদালতে গ্রহণযোগ্য নয়। মামলাটি অমীমাংসিতভাবে স্থগিত হয়ে যায় এবং সবার মনে হতে থাকে, ডেভিড রে-এর মতো একজন দানব হয়তো আইনের ফাঁক গলে ঠিকই বেরিয়ে আসবে।
নয় মাস পর মামলাটি পুনরায় চালু করা হলে অন্য একজন বিচারক জুরি বোর্ডকে ডেভিড-এর টেপ-রেকর্ডিং আমলে নেওয়ার ব্যাপারে অনুমোদন দিয়েছিলেন। কিন্তু তারপরেও আবার সবকিছু একে থামে কেলি’র দেওয়া বক্তব্য ও প্রমাণের কাছে। যদি তার জবানবন্দি জুরি বোর্ডে থাকা প্রত্যেক সদস্যের কাছে বিশ্বাসযোগ্য না মনে হয়, তাহলে ডেভিড খালাশ পেয়ে যাবে। এ-ব্যাপারে কেলি বলেছিলেন, “নিজেকে দুর্বল মনে হচ্ছে, ভয় লাগছে। সেই সাথে রাগও হচ্ছে এই ভেবে যে, লোকটা প্রথমবার আইনের ফাঁক গলে বেঁচে গিয়েছিল, এবারো কি সেভাবে বেঁচে যাবে?”
২০০৮ সালে, সাহসিকতার সাথে এক টিভি ডকুমেন্টারিতে আদালতের ঘটনাগুলোর ব্যাপারে মুখ খুলেছিলেন কেলি। সেখানে তিনি প্রথমবারের মতো নিজের অনুভূতির কথা জানিয়েছিলেন। “অচেনা, অপরিচিত লোকদের কাছে নিজের জীবনের যৌন-অভিজ্ঞতার বর্ণনা দেওয়াটা খুবই বিব্রতকর এবং কঠিন একটা ব্যাপার। আমার মনে হয়, আদালতে দ্বিতীয়বার ওগুলো বর্ণনা করা প্রথমবারের চেয়ে ঢের কঠিন ছিল। প্রথমবার আমি সেই মুহূর্তের মধ্য দিয়ে পার হয়েছিলাম, হাজার হাজার অচেনা লোকের সামনে নিজের দুঃসহ যৌন-অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করেছিলাম। সেই একই কাজ আমাকে দ্বিতীয়বারেও করতে হয়েছে! কারণ প্রথমবার যিনি বিচারক ছিলেন, তিনি আমার কথা বিশ্বাস করেননি। দ্বিতীয়বার যখন সব বলছিলাম, শেষের দিকে রীতিমতো ঘামছিলাম আমি। জুরি বোর্ডের সদস্যরা আমার বক্তব্য বিশ্বাস করবে কিনা, সেটা নিয়ে সন্দিহান ছিলাম। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে, এবার রায় আমার পক্ষে এসেছিল। আদালত তাকে ‘দোষী’ হিসেবে সাব্যস্ত করেছিলেন।”
প্রায় এক সপ্তাহ ব্যাপী ডেভির রে-এর বিরুদ্ধে আদালতে কার্যক্রম চলেছিল। সময়টা ২০০১ সালের ১৬ এপ্রিল, তখন ডেভিডকে প্রায় ৬০ জন নারীকে খুন করার অভিযোগে সন্দেহ করা হয়। কিন্তু তার বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে দায়েরকৃত বিভিন্ন অভিযোগের কোনোটিতেই তাকে খুনী হিসেবে প্রমাণ করা যায়নি। মূলত কেলি ভ্যানের দায়েরকৃত অভিযোগের ভিত্তিতেই ডেভিডের শাস্তি হয়েছিল। কেলি’র সাথে সংগঠিত অপরাধগুলোর সময়কাল ছিল : জুলাই ১৯৯৬। তবে ডেভিড পরবর্তীতে আরো দুটো মামলায় দোষী সাব্যস্ত হয়েছিল। তাদের মধ্যে একজন ছিলেন নিউ মেক্সিকো’র বাসিন্দা সিনথিয়া ভিজিল। তাকে অপহরণ এবং যৌন নির্যাতন করেছিল ডেভিড। আরেকজন ভিকটিমের নাম : অ্যাঞ্জি মন্টানো (মৃত)। তিনি ছিলেন নিউ মেক্সিকো’র ট্রুথ অর কনসিকোয়েন্স-এর বাসিন্দা। তার ওপর ডেভিড হামলা করেছিল।
তবে ডেভিডের উকিল চেষ্টা করেছিলেন যেন মামলাটি প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। তিনি বলেছিলেন, তার ক্লায়েন্টকে (ডেভিড) জেলে থাকাবস্থায় বিভিন্ন ধরনের ওষুধ সেবন করতে হয়েছে। সেসব ওষুধের পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়ার কারণে তার ক্লায়েন্ট এখন মামলা সংক্রান্ত কোনো সিদ্ধান্ত সজ্ঞানে নিতে সক্ষম নন। কিন্তু বিচারক সেই উকিলের আবেদন খারিজ করে বলেছিলেন, আত্মপক্ষ সমর্থন করার মতো সক্ষমতা ডেভিডের রয়েছে।
ডেভিডের উকিল লি ম্যাক মিলিয়ান দমবার পাত্র নন। তিনি আদালতে নতুন একটি আর্জি উপস্থাপন করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, তার ক্লায়েন্টকে “প্যারাফিলিয়া” (অস্বাভাবিক এবং বিকৃত যৌনাচার) রোগী হিসেবে দাবি করা হচ্ছে, যা ঠিক নয়। তার ক্লায়েন্টের এধরনের কোনো রোগ নেই। তিনি বলেন, ৬১ বছর বয়সী ডেভিড রে প্রায় ৫০ বছর ধরে এই রোগকে সফলতার সাথে দমন করে এসেছেন এবং কাস্টডিতে থাকাবস্থায় নিজের চরিত্র সংশোধন করার চেষ্টা করেছেন।
তবে সেক্সুয়াল স্যাডিজম বিশেষজ্ঞ এফবিআই-এর একজন এজেন্ট সাক্ষ্য দেন, ডেভিড রে প্যারাফিলিয়ায় আক্রান্ত। তিনি আরো জানান, ডেভিড ব্যক্তি হিসেবে সবচেয়ে বিপদজনক প্রকৃতির “ক্রিমিনাল সেক্সুয়াল স্যাডিস্ট”। এধরনের প্যারাফিলিয়ার কোনো থেরাপি আবিষ্কৃত হয়নি। কারাগারে বন্দী করা ছাড়া এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিকে থামানোর কোনো উপায় নেই।
ডেভিডের উকিলের আরো একটি আর্জি ব্যর্থ হয়েছিল। তার উকিল চেষ্টা করেছিলেন যেন ডেভিডের কারাভোগের সময়কালটা ১৭৩ বছর থেকে কমিয়ে ১০ বছরে নামিয়ে আনা যায়। তিনি বলেছিলেন, “১০ বছর কারাভোগ করা মৃত্যুদন্ডের মতোই”। অবশ্য পরবর্তীতে সেই উকিল স্বীকার করেছিলেন, তার এধরনের চেষ্টা ছিল “ডুবন্ত টাইটানিকের ডেকে থাকা চেয়ারগুলো পুনরায় সাজানোর মতো” একটি ব্যর্থ প্রয়াস মাত্র।
ডেভিডের ব্যাপারে রায় ঘোষণার আগে, নিউ মেক্সিকো’র অ্যাটর্নি জেনারেল প্যাট্রিসিয়া মাদ্রিদ আদালতের কাছে আর্জি জানান যেন অপরাধীকে সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়া হয়। তিনি বলেন, ডেভিড যেন কোনোভাবে মুক্তি না পায়। সে মুক্তি পেলে তা সমাজের জন্য অনেক বিপদজনক হয়ে দাঁড়াবে। তাকে মুক্তি দেওয়ার মতো ঝুঁকি সমাজ নিতে পারে না। তিনি আরো জানান, ডেভিড রে’র পরিকল্পনা ও ছবি আঁকা ম্যানুয়েল থেকে স্পষ্টভাবে বোঝা যায় যে, সুযোগ পেলে সে আবারো নারীদেরকে বন্দী করে নির্যাতন চালাবে। অতীতেও সে ভিকটিমদের ওপর অমানুষিক নির্যাতন করেছে এবং তাদেরকে মানুষ হিসেবে না ভেবে বরং “প্যাকেজ” হিসেবে গণ্য করেছে। ভিকটিমদের প্রতি “জানোয়ারের চেয়েও খারাপ” প্রকৃতির আচরণ করেছে ডেভিড।
চূড়ান্ত রায় ঘোষণার আগে ডেভির রে’র ভিকটিমদেরকে শেষবারের মতো তাদের বক্তব্য উপস্থাপন করার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। কোর্টরুমে সিনথিয়া’র হাত ধরে কান্না করছিলেন কেলি। তিনি বলেছিলেন, ডেভিডের যেন যাবতজ্জীবন কারাদন্ড হয়। আরো বলেছিলেন, ডেভিডের মতো অসুস্থ প্রকৃতির লোক যেন জেলখানায় কারো সাথে বন্ধুত্ব করতে না পারে, সে যেন কোনো বন্ধু খুঁজে না পায়। তিনি চান ডেভিড যেভাবে তার ভিকটিমদেরকে নিয়ন্ত্রণ করতো, তাদের সাথে যেধরনের আচরণ করতো, তার সাথেও যেন কারাগারে সেরকম আচরণ করা হয়।
অ্যাঞ্জি মনটানো’র মা লরেটা রোমারো বলেছিলেন, তার মৃত কন্যা ও তার দুই অল্প বয়সী ছেলেদের জন্য আদালতে উপস্থিত হয়েছেন তিনি। ডেভিড রে তাদের জীবন ধ্বংস করে দিয়েছিল। তার মেয়ের সম্মান বলতে কিছু বাকি ছিল না, হাসতে ভুলে গিয়েছিল, সবকিছু হারিয়ে ফেলেছিল; ডেভিড রে’র কারণে। তবে মিসেস রোমারো এটাও বলেছিলেন, ডেভিড রে’র প্রতি তার দুঃখবোধ কাজ করে এবং তিনি ডেভিডকে ক্ষমাও করে দিয়েছেন। তার ধারণা, তার কন্যা বেঁচে থাকলে সে-ও ডেভিডকে ক্ষমা করে দিতো। তবে আমি এসব কখনো ভুলে যেতে পারবো না।”
সিনথিয়া এবং তার নানী অবশ্য এতটা উদার ছিলেন না। সিনথিয়া বলেছিলেন, তিনি যে যন্ত্রণা ভোগ করেছেন, কোনো প্রথাগত শাস্তি সেটার সমতুল্য হবে না। চোখের জল ফেলে সিনথিয়া আরো বলেছিলেন, সেই ঘটনার পর থেকে তিনি অন্ধকারকে ভয় পেতে শুরু করেছেন, বাইরে একা যেতে আতংকবোধ করছেন এবং তার বারবার মনে হয় এই বুঝে কেউ এসে সাথে তুলে নিয়ে যাবে, রশি দিয়ে বেঁধে, শুইয়ে নির্যাতন করবে! তিনি আশা করেছিলেন, ডেভিড যেন বাকিটা জীবন জেলে যন্ত্রণা ভোগ করে, যেভাবে তিনি যন্ত্রণা ভোগ করেছিলেন। “শরীরের ভেতরে-বাইরে আমি জখম বয়ে বেড়াচ্ছি, যে জখম কখনো সারবে না।” আদালতে উপস্থিত ডেভিড রে’র দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন তিনি।
সিনথিয়া’র নানী বার্থা ভিজিল বলেছিলেন, তার নাতনী প্রতি রাতে দুঃস্বপ্ন দেখে। ডেভিড শুধু তার নাতনীর জীবন নয়, বরং তাদের পুরো পরিবারটাকে ধ্বংস করে দিয়েছে। ডেভিডকে “মানুষ নামের কলংক” নামে ডেকেছিলেন তিনি। তারপর জিজ্ঞেস করেছিলেন, সে সিনথিয়া’র সাথে যা যা করেছে সিনথিয়া যদি তার (ডেভিডের) মেয়ের সাথে একই আচরণ করতো, তাহলে তার কেমন লাগতো? সবশেষে তিনি আশা প্রকাশ করেছিলেন, ডেভিড যেন তার বাকি জীবনটা যন্ত্রণা ভোগ করে। বলেছিলেন, “শয়তান তোর জন্য একটা জায়গা বরাদ্দ করে রেখেছে। আশা করি, তুই নরকের আগুনে চিরকাল জ্বলতে থাকবি।”
সিনথিয়া ও কেলি আদালতে এসে নিজেদের দুঃসহ ঘটনাগুলো পুনরায় বলার সাহস করায় প্রসিকিউটর (বাদী পক্ষের আইনজীবি) জিম ইওনজ তাদের প্রশংসা করেছিলেন। তিনি বিচারককে সতর্ক করে বলেছিলেন, যদি ডেভিড রে কখনো ছাড়া পায়, সে বাড়িতে পৌঁছানোর আগেই আরেকটা অপকর্ম করে বসবে! “এই দানবকে কখনো রাস্তায় বের হওয়ার অনুমতি দেওয়া ঠিক হবে না। তার মুক্তি পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা থাকা যাবে না। ডেভিডকে বুঝতে হবে, বাকি জীবনটা তাকে কারাগারের একটা কামরায় বসে কাটাতে হবে। সেই কামরাই হবে তার একমাত্র আবাসস্থল। মৃত্যুর পর কফিনে করে সে জেলখানা থেকে বের হতে পারবে, তার আগে নয় ” পুরো আদালত তখন পিন-পতন নিরবতা বজায় রেখে কথাগুলো শুনছিল। অন্যদিকে ডেভিড পার্কার রে ছিল একদম নির্বিকার। তার ভিকটিমরা যখন কাঁদতে কাঁদতে নিজেদের বক্তব্য পেশ করছিল, ডেভিডকে তখনো নির্বিকার চিত্তে বসে থাকতে দেখা গেছে।
আদালতে উপস্থিত সাংবাদিক, দর্শনার্থীদের মাঝে ডেভিডের মেয়ে জেসিও ছিল। মেয়েকে অভিযোগ থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্য আবেদন করেছিল ডেভিড। জেসির বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, সে কেলিকে অপহরণ করার কাজে বাবাকে সহায়তা করেছে।
ডেভিড সহানুভূতি পাওয়ার জন্য বলেছিল, সে সবকিছু হারিয়েছে : নিজের বাড়ি, সম্পত্তি, স্বাস্থ্য; সব। কিন্তু আড়াই বছর কারাবাসকালীন সময়ে তার বোধোদয় হয়েছে। সে বাইবেল পাঠ করে ঈশ্বরের পথে চলতে শুরু করেছে। সে অতীতের জন্য অনুতপ্ত কিন্তু তার পক্ষে অতীত বদলে ফেলা সম্ভব নয়। তাই নিজের জীবনটাকে সে ঈশ্বরের হাতে সঁপে দিয়েছে।
আদালতের বিচারক সোয়েজি’র প্রতি অবজ্ঞা প্রকাশ করে ডেভিড অভিযোগ করেছিল, বিচারক পুরাতন আদালত থেকে নিজের বাসার কাছাকাছি আদালতে মামলা স্থানান্তর করেছেন। যা তার ভাল লাগেনি। অন্যদিকে ডেভিড প্রথম আদালতের বিচারক নিল মের্টজ-এর প্রশংসা করেছিল। বিচারক নিল মের্টজ স্থানীয় আদালত থেকে মামলা স্থানান্তর করেছিলেন এবং মামলাটি অমীমাংসিতভাবে স্থগিত হয়ে গিয়েছিল।
এখানে বলাই বাহুল্য, ডেভিডের এমন বক্তব্যে বিচারক সোয়েজি বিন্দু পরিমাণ বিচলিত হননি। কেলি ও সিনথিয়ার জবানবন্দি শোনার পর তিনি বলেছিলেন, ভিকটিম দুজন কতটা দুঃসহ যন্ত্রণা ভোগ করেছে, কতটা ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গিয়েছে সেটা তিনি কল্পনা করতে পারছেন। তিনি ইঙ্গিত দিয়েছিলেন ডেভিড রে’র এই কেসে অপরাধীকে পুনর্বাসিত করার ব্যাপারটা বিবেচনায় রাখা হবে না। রায়ের মূল লক্ষ্য হবে যেন অপরাধী ভবিষ্যতে কোনো অপরাধ করতে না পারে। অপরাধী যেন অপরাধ করতে ‘অক্ষম’ থাকে।
কেলি অপহরণ মামলায় ডেভিড পার্কারকে ৯ বছরের কারাদন্ড দেওয়া হয়, ৩ বছরের কারাদন্ড দেওয়া হয় অপহরণ করার চক্রান্ত করার জন্য। প্রতিবার যৌন নির্যাতনের বিপরীতে ১৮ বছর করে কারাদন্ড দেওয়া হয়, ডেভিড মোট ছয়বার যৌন নির্যাতন (ধর্ষণ) করেছিল। সাথে আরো ১৮ মাসের কারাদন্ড দেওয়া হয় অপরাধমূলক যৌন নির্যাতন করার জন্য।
সিনথিয়া ভিজিলের করা মামলায় ডেভিডকে ১৮ বছরের কারাদন্ড দেওয়া হয় অপহরণ করার জন্য। যৌন নির্যাতন (ধর্ষণ) করার জন্য ৯ বছরের কারাদন্ড এবং অপহরণের চক্রান্ত করার অভিযোগে আরো ৯ বছরের কারাদন্ড প্রদান করা হয়।
ডেভিড রে’র যাবতীয় পরিকল্পনা, প্রস্তুতি এবং ভয়ংকর স্বভাবের ব্যাপারগুলো সামনে আসায় তার অপরাধ প্রবণতার ব্যাপারে সন্দেহ প্রকাশ করার কোনো অবকাশ ছিল না। ডেভিড রে’র যত বছরের সাজা নির্ধারণ করা হয়েছিল, সম্মানিত বিচারক সেই সাজার মেয়াদকালের ওপরে আরো এক তৃতীয়াংশ করে যোগ করে মোট ২২৪ বছরের কারাদন্ডে দন্ডিত করেছিলেন। অবশ্য মামলা চলাকালীন সময়ে ডেভিড আড়াই বছর জেলে থাকার কারণে মূল সাজা থেকে সেই আড়াই বছর বিয়োগ করা হয়েছিল। এই মামলায় অভিযুক্ত অন্যান্য ব্যক্তিদের চেয়ে ডেভিড রে’র শাস্তিটা একটু ভিন্ন ছিল। এধরনের কেসে আর কাউকে দুই শ’ বছরেরও বেশি মেয়াদকালের কারাদন্ড দেওয়া হয়নি।
ডেভিড রে’র লিভ-ইন গার্লফ্রেন্ড সিনথিয়া হেনডি-কে ভিকটিমরা ‘মিসট্রেস’ নামে চিনতো। তিনটি অপহরণকর্মে নিজে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছিল সিনথিয়া। নিজের সাজার মেয়াদ কমাতে সে বয়ফ্রেন্ড ডেভিড রে’র বিরুদ্ধে সাক্ষী দিয়েছিল। ১৪টি অভিযোগের বিপরীতে ৩৭ বছরের সাজা হয়েছিল তার। তবে ডেভিডের বিপক্ষে সাক্ষী দিয়ে সহায়তা করায় সিনথিয়া’র ৫ বছরের সাজা মওকুফ করা হয়।
ডেনিস রয় ইয়ান্সি নামের এক যাযাবর আদালতে নিজেকে ডেভিড রে’র “শিষ্য” হিসেবে পরিচয় দিয়ে সাক্ষ্য প্রদান করেছিল। অপহরণ করে আনা এক তরুণীকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করার কথা স্বীকার করেছিল সে। তখন ডেভিড ছবি তুলছিল। তরুণীর নাম ছিল মেরি পার্কার, বয়স ২২ বছর। সেই নারীর লাশ কখনো পাওয়া যায়নি। সাক্ষ্য দেওয়ার বিনিময়ে আদালতে নিজের সাজা কমানোর আর্জি জানিয়েছিল ডেনিস রয়। আদালত সেটা আমলে নিয়ে তাকে ২০ বছরের কারাদন্ড দিয়েছিল।
অন্যদিকে ডেভিড রে’র মেয়ে জেসির বিপক্ষে তার বাবার সাথে অপহরণের কাজে সহায়তা করা এবং কেলি ভ্যানকে নির্যাতন করার অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার পরেও আদালত তাকে ৫ বছরের প্রবেশন পিরিয়ড দিয়ে জেল থেকে মুক্তি দিয়েছিল। তবে এই সুবিধা নেওয়ার জন্য তাকে প্রসিকিউটরের সাথে একটা চুক্তি করতে হয়েছিল। চুক্তিটা ছিল : জেসিকে জেল থেকে মুক্তি দেওয়া হবে যদি তার বাবাকে নিজের মামলার রায়ের ব্যাপারে আপিল করা থেকে বিরত থাকে।
অবশ্য এই চুক্তিটা বেশ আতঙ্ক সৃষ্টি করেছিল তখন। কারণ জেসি রে একজন প্রমাণিত অপরাধী। ১৫০ বছরের কারাদন্ড হয়েছিল তার। তবে সহানুভূতিশীল পর্যবেক্ষণকারীগণ জেসিকে মনস্টার বা দানব হিসেবে চিহ্নিত না করে বরং তার বাবার একজন ভিকটিম হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন।
ডেভিড গ্রেফতার হওয়ার পর মূলত জেসি’র ব্যাপারটা সামনে আসে। জানা যায়, ১৩ বছর আগে জেসি নিজেই তার বাবার কুকর্মের ব্যাপারে এফবিআইকে রিপোর্ট করেছিল। ডেভিড পার্কারের প্রসিকিউটর ডেপুটি ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নি জিম ইওনজ বলেছিলেন, “১৯৮৬ সালে জেসি রে তার বাবার অপকর্মের ব্যাপারে এফবিআই-এর কাছে রিপোর্ট করেছিলেন। তরুণী ও অল্প বয়সী মেয়েদেরকে যৌন নির্যাতন ও যৌন দাসী বানানোর অভিযোগ আনা হয়েছিল। ১৯৮৬ এবং ১৯৮৭ সাল জুড়ে এফবিআই তদন্তও করেছিল কিন্তু পর্যন্ত প্রমাণ এবং কোনো ভিকটিম না পাওয়ায় কেসটি ক্লোজ হয়ে যায়।”
২২৪ বছরের কারাদন্ড শুরু হওয়ার পর মাত্র ৮ মাসের মাথায় ডেভিড পার্কার মারা যায়। ২০০২ সালের ২৮ মে তারিখে মারা গিয়ে সাজা ভোগের হাত থেকে বেঁচে যায় মানুষরূপী দানবটি। ডেভিড সবমিলিয়ে মাত্র ৩ বছর কারাভোগ করেছিল।
ডেভিডের নির্ঝঞ্ঝাট মৃত্যুর কথা শুনে কেলি নিজের ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছিলেন, “সে না মরলেই বরং ভাল হতো। অন্যান্য মেয়েদের সাথে সে কী কী করেছিল, সেগুলোর ব্যাপারে আমাদেরকে তথ্য জানাতে পারতো। নিজেদের প্রশ্নের উত্তর জেনে স্বস্তি পেতো সেই মেয়েদের পরিবার-পরিজনেরা। আর সে বেঁচে থাকলে আমি তাকে জিজ্ঞেস করতাম, আমাকেই কেন তুলে নিয়েছিল? আমাকেই সে শিকার হিসেবে চিহ্নিত করেছিল কেন? আর করলোই যদি, তাহলে আমাকে মেরে ফেলল না কেন?… সে আমার সাথে যা করেছে…তার জন্য আমার জীবনটা শেষ হয়ে গেছে। এখন আমি আর কোথাও যাই না, কাউকে বিশ্বাস করতে পারি না। আমি আমার ‘পুরাতন আমি’কে মিস করি। আগে আমি অনেক চঞ্চল ছিলাম, পাগলামো করতাম, বন্য স্বভাবের ছিলাম, কোনো কিছুতেই ভয় পেতাম না। সেই পুরাতন আমিকে ফিরে পাওয়ার জন্য আমি যেকোনো কিছু করতে প্রস্তুত।”
আমেরিকার প্রথম সারির একজন ফরেনসিক সাইকিয়াট্রিস্ট ডক্টর মাইকেল স্টোন-এর গবেষণায় দেখা যায়, ডেভিড রে-কে সেখানে “দ্য ওয়ার্ল্ডস মোস্ট ইভল” খেতাব দেওয়া হয়েছে। ৪০ বছর ধরে অপরাধমূলক কর্মকান্ড করে এই কুখ্যাত খেতাব অর্জন করেছিল ডেভিড পার্কার। ডক্টর স্টোন তার কর্মজীবনের পুরোটা জুড়েই সিরিয়াল কিলারদের মনস্তত্ব নিয়ে গবেষণা করেছেন। মানুষের খারাপি বা ইভল পরিমাপ করার জন্য “স্কেল অব ইভল” নামের একটি পরিমাপক উদ্ভাবন করেছিলেন তিনি। আমেরিকা সহ বিভিন্ন দেশের আদালতে অপরাধীদেরকে শাস্তি দেওয়ার ক্ষেত্রে তার উদ্ভাবিত স্কেলের সাহায্য নেওয়া হতো।
ডক্টর স্টোন বলেছিলেন, “যারা তাদের ভিকটিমদেরকে নারকীয় যন্ত্রণা দেওয়ার মাধ্যমে একই সাথে শারীরিক এবং মানসিকভাবে দীর্ঘসময় ব্যাপী নির্যাতন চালায়, তারা এই স্কেলের একদম ওপরের দিকে স্থান পেয়ে থাকে। তাদের ভেতরে বিন্দু পরিমাণ অনুশোচনা কাজ করে না এবং তারা অপকর্মগুলো খুব আনন্দ নিয়ে করে। কিন্তু ডেভিড পার্কার হলো খারাপদের মাঝে সবচেয়ে খারাপ ব্যক্তি। খারাপি পরিমাপের স্কেলে আমি ১ থেকে ২২ পর্যন্ত সংখ্যায়িত করেছি, কিন্তু যদি ডেভিডকে সেই স্কেলে পরিমাপ করতে চাই তাহলে তার জন্য বিশেষভাবে ২৩তম স্থান তৈরি করতে হবে।
“ডেভিড একজন গেম ওয়ার্ডেন (যার কাজ কোনো নির্দিষ্ট এলাকায় অনুষ্ঠিত খেলা ও পশু শিকার প্রোগ্রামসমূহ তত্ত্বাবধান করা) ছিল। দেখে ভদ্রলোক বলে মনে হতো। বিয়েও করেছিল কয়েকবার, একটা মেয়ে ছিল কিন্তু সেই মেয়েকেও নিজের অপকর্মের সঙ্গী বানিয়েছিল সে। বলা যায় সে দুইধরনের জীবন-যাপন করতো। একটা ছিল সমাজের সামনে গেম ওয়ার্ডেন রূপে, আরেকটা ছিল তার বাড়ির পেছনে থাকা ট্রেইলারে। যে ট্রেইলারকে সে বিভিন্ন ধরনের পুলি, দড়ি এবং যন্ত্রপাতির সমন্বয়ে একটা টর্চার চেম্বারে রূপান্তরিত করেছিল।
“তার ভিকটিমদের অধিকাংশই ছিল যৌনকর্মী, বিভিন্ন মদের বার থেকে ভাড়া করে তাদেরকে নিজের ডেরায় নিয়ে আসতো ডেভিড। তাদের ওপর ড্রাগ প্রয়োগ করতো এবং হাত-পা বেঁধে ফেলতো। অসহায় হয়ে পড়তো ভিকটিমরা। তারপর র্যাকের ওপর তুলে, তাদের পা ফাঁক করে, পেরেক গাঁথা ডিলডো (কৃত্রিম পুরুষাঙ্গ) তাদের যৌনাঙ্গের ভেতরে ঢুকিয়ে দিতো। তবে নারকীয় নির্যাতন পর্ব শুরু করার আগে ১৫ পৃষ্ঠা দীর্ঘ নিজস্ব একটা “ম্যানিফেস্টো” (ঘোষণাপত্র) শোনাতো সে। তার সেই ম্যানিফেস্টো মূলত টেপে রেকর্ড করা ছিল। নির্যাতন শুরু করার আগে, সেই টেপ চালু করে ভিকটিমদেরকে শুনিয়ে দিতো তাদের সাথে সামনে কী কী করা হবে। তারা যতই কষ্ট পাক, তাতে তার কিছুই যায় আসে না। এরপর শুরু হতো নির্যাতন পর্ব। সেই নির্যাতনের ব্যপ্তি যে কতদিন পর্যন্ত ছিল, তা আমাদের জানা নেই। কয়েক দিন হতে পারে, কয়েক সপ্তাহও হতে পারে।
“আমার মতে, ডেভিড পার্কার অত্যন্ত জঘন্য পর্যায়ের একজন অপরাধী। স্কেল অব ইভল-এ আমি শুধুমাত্র ডেভিডের জন্যই বাড়তি একটি ক্যাটাগরি তৈরি করেছি। যদি কোনোদিন তাকে এক্সিকিউশন চেম্বার তথা মৃত্যুদন্ড দেওয়ার চেম্বারে আনা হয়, আমি খুশি মনে তার মৃত্যুদন্ড কার্যকর করার জন্য বাটন চেপে দেব।”
অনুবাদ : সাঈম শামস্
তথ্যসূত্র : FBI, Serial Killers: The World’s Most Evil, Criminalminds, allthatsinteresting
আপনার মতামত জানানঃ