জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মের্কেল ক্ষমতার দৃশ্যপট থেকে বিদায় নিচ্ছেন। তার উত্তরসূরি হিসেবে তারই পছন্দনীয় নতুন নেতা জার্মানির হাল ধরবেন। বিশ্বরাজনীতিতে এবং নারী নেত্রী হিসেবে অনন্যসাধারণ অবদান রেখেছেন তিনি।
অ্যাঞ্জেলা মের্কেল জার্মানির একালের সবচেয়ে বলিষ্ঠ চ্যান্সেলর। যার আরেক নাম ‘ইউরোপের ক্রাইসিস ম্যানেজার’। শুধু ইউরোপ নয়, আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্য ছাড়িয়ে এশিয়াতেও তার সমান প্রভাব। বিশ্ব রাজনীতিবিদদের মধ্যে একটা প্রবাদ ছিল— ‘কখনো খাটো করে দেখো না মের্কেলকে’।
একসময় অ্যাঞ্জেলা মের্কেল নাম দেয়া হয়েছিল ইউরোপের রানি। কিন্তু জার্মানির এই ক্ষমতাধর চ্যান্সেলর আগামী ২৬শে সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠেয় নির্বাচনের পরই বিদায় নিচ্ছেন।
অনেক আগেই তিনি জানিয়ে দিয়েছেন যে তিনি আর চ্যান্সেলর পদের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন না। তবে তার এই বিদায় কি রানির মত বিদায়ই হবে? অনেকেই এখন আর অতটা নিশ্চিত নন।
এটা সত্য যে অ্যাঞ্জেলা মের্কেল হচ্ছেন ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের বর্তমান নেতাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে নেতৃত্বের পদে আছেন। তিনি প্রায় ১০০টি ইইউ শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিয়েছেন। মাঝে মাঝে তাকে বলা হতো— অ্যাঞ্জেলা মের্কেলই সম্মেলন কক্ষের একমাত্র বয়স্ক ব্যক্তি।
ইইউকে বহু সংকট পার হতে সহায়তা করেছেন তিনি। অভিবাসন সংকট, ইউরো সংকট, কোভিড-১৯, এমনকি কিছুটা ব্রেক্সিটের ক্ষেত্রেও। কিন্তু অ্যাঞ্জেলা মের্কেলের রাজনৈতিক জীবন আসলে দু’ভাগে বিভক্ত। ইউরোপের নেতা হিসেবে যেমন, তেমনি জার্মানির নেতা হিসেবেও তার উত্তরাধিকার আসলে ভালো-মন্দ মিলিয়ে।
জার্মানিতে অ্যাঞ্জেলা মের্কেলের সমালোচনা হয় এই জন্যে যে, গত ১৬ বছরের শাসনকালে তিনি ছিলেন একজন ‘ক্রাইসিস ম্যানেজার’— সংকট সামাল দেবার জন্য তিনি অপেক্ষা করতে করতে একেবারে শেষ মুহূর্তে গিয়ে সিদ্ধান্ত নিতেন। বলা হয়, তিনি একজন বাস্তববাদী, কিন্তু দ্রষ্টা নন।
এই সমালোচকরা বলেন, ইউরোপের নেত্রী হিসেবেও তিনি এই একইভাবে কাজ করেছেন। বলা যায়, অ্যাঞ্জেলা মের্কেল যা করেছেন তার অভিঘাত তিনি রাজনীতি ছেড়ে দেবার পরও বহুদিন অনুভূত হবে।
করোনাকালের আগে, করোনাকালে বিশ্ব রাজনীতিতে অ্যাঞ্জেলা মের্কেল অন্যতম আলোচিত নাম। ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটিক ইউনিয়নের চেয়ারপারসন তিনি। ২০০৫ সাল থেকে জার্মানির চ্যান্সেলর। ব্যক্তিজীবনে নিঃসন্তান। কিন্তু কাজ করেছেন পুরো দুনিয়ার শিশুদের জন্য, বিখ্যাত সাময়িকী ‘ফোর্বস’-এর তালিকায় অ্যাঞ্জেলা মের্কেল বরাবরই সবচেয়ে ক্ষমতাধর নারীদের শীর্ষেই থাকেন।
জার্মানির অর্থনীতি আর রাজনীতিকে সাহসের সঙ্গেই নেতৃত্ব দিচ্ছেন। ইউরোপীয় ইউনিয়নকে সক্রিয় এবং কার্যকর রাখতে অ্যাঞ্জেলা মের্কেল চমৎকার ভূমিকা রেখেছেন। ‘ফোর্বস’ বেশ কয়েকবার মার্কেলকে সময়ের সবচেয়ে ক্ষমতাধর নারী নির্বাচিত করেছে। অ্যাঞ্জেলা মের্কেল রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতায় আসেন ২০০৫ সালে। এরপর ২০০৬ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত ‘ফোর্বস’-এর তালিকায় চারবার শীর্ষে উঠে আসেন।
নিজের দায়িত্ব পালনকালে পাঁচ ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীকে দেখেছেন মের্কেল। দেখেছেন চার ফরাসি প্রেসিডেন্ট, সাত ইতালিয়ান প্রধানমন্ত্রীকে। বাইডেন চতুর্থ মার্কিন প্রেসিডেন্ট, যার মার্কেলের সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা হবে। এ সময় জাপানেও পালাবদল হয়েছে আট প্রধানমন্ত্রীর। বিশ্বের অনেক নেতা এসেছেন আবার চলেও গেছেন। কিন্তু জার্মানির মের্কেল ছিলেন। জার্মানির ক্ষমতাসীন দল ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটিক ইউনিয়নের (সিডিইউ) নতুন চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন আরমিন লাশেট (৫৯)। চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মার্কেল অনুসারী হিসেবে পরিচিত এই নেতা বর্তমানে দেশটির সবচেয়ে জনবহুল রাজ্য নর্থ রাইন ওয়েস্টফালিয়ার মুখ্যমন্ত্রী। এলাকাটি বিদেশি-অধ্যুষিত।
![](https://statewatch.net/wp-content/uploads/2021/09/২-5-300x169.jpg)
কমিউনিস্ট পূর্ব জার্মানিতে বার্লিনের উপকণ্ঠে এক গ্রাম এলাকায় বড় হয়েছেন অ্যাঞ্জেলা মের্কেল। এরপর বার্লিন প্রাচীর যখন ভেঙে ফেলা হয়, তখন পূর্ব জার্মানিতে প্রথম গণতান্ত্রিক নির্বাচনের পর তিনি পূর্ব জার্মান সরকারের মুখপাত্র হিসেবে কাজ নেন।
১৯৯০ সালে জার্মানির একত্রীকরণের দুই মাস পর তিনি মধ্য দক্ষিণপন্থী ক্রিশিয়ান ডেমোক্র্যাট পার্টিতে (সিডিইউ) যোগ দেন। পরের বছর চ্যান্সেলর হেলমুট কোলের সরকারে তিনি মহিলা ও তরুণবিষয়ক মন্ত্রীর দায়িত্ব নেন।
মি. কোল অবৈধ অর্থ লেনদেনের এক কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়লে মিসেস মের্কেল ১৯৯৯ সালে তার পদত্যাগ দাবি করেন। ২০০০ সালে সিপিইউ দলের নেতা নির্বাচিত হন। ২০০৫ সালে তিনি জার্মানির প্রথম নারী চ্যান্সেলর হন।
তার রাজনৈতিক জীবনের গোড়ায় তাকে দেখা হতো অনাকর্ষণীয় প্রাদেশিক সাদামাটা একজন নেতা হিসেবে। কিন্তু প্রথম থেকেই সেই ভাবমূর্তি তিনি ঝেরে ফেলতে উদ্যোগী হন তার পোশাক-আশাক ও চেহারার পরিবর্তন ঘটিয়ে। তিনি চুলের স্টাইল বদলান এবং উজ্জ্বল রঙের পোশাক পরতে শুরু করেন।
তিনি ১৯৯৮ সালে ইয়োকিম সয়ারকে বিয়ে করেন। তার প্রথম সরকার তিনি গঠন করেন মধ্যবামপন্থী সোস্যাল ডেমোক্র্যাটদের সাথে মহাজোট করে। এরপর ২০০৯ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত তিনি ব্যবসাবান্ধব ফ্রি ডেমোক্র্যাট দলের সাথে জোট সরকার গঠন করেন।
ইউরোপ যখন অর্থনৈতিক সঙ্কটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তখন তিনি ব্যয় সঙ্কোচের প্রতীক হয়ে ওঠেন। দক্ষিণ ইউরোপের উপর্যুপরি ঋণসমস্যার মোকাবেলায় তিনি ব্যাপক বাজেট হ্রাস এবং কড়া নজরদারির সুপারিশ করেন।
অনেকে রাজনীতিবিদই যেন তার মধ্যে ব্রিটেনের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচারের ছায়া দেখতে পান। কিন্তু ২০০৫ সালে প্রথম মেয়াদে নির্বাচনের পর থেকেই যে অবিশ্বাস্য দ্রুততায় মের্কেল বিশ্বের ক্ষমতাধর নেতাদের মাঝে জায়গা করে নিয়েছেন, তাতে অনেকের ধারণা থ্যাচারকেও ছাড়িয়ে যাবেন মের্কেল।
তবে ইউরোপজুড়ে শরণার্থী সংকটে বিশ্ব দেখেছে এক মমতাময়ী মের্কেলকে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন বেশিরভাগ দেশ যেখানে শরণার্থী নিতে অনাগ্রহী, সেখানে নিজে শুধু শরণার্থীদের জায়গা দিয়েই সীমাবদ্ধ থাকেননি, বিশ্বব্যাপী শরণার্থী সমস্যার মুখপাত্র হয়ে উঠেছেন মের্কেল।
তার এই মমতাময়ী আচরণের কারণে জার্মানিতে তাকে অনেকেই ডাকে ‘Mutti’ বা ‘মমতাময়ী মা’ নামে। তবে রাজনীতিতে আর কূটনীতির ময়দানে তার অসামান্য দক্ষতা তাকে নিয়ে গেছে বিশ্বের সবচেয়ে দক্ষ রাষ্ট্রনেতাদের কাতারে।
![](https://statewatch.net/wp-content/uploads/2021/09/৩-5-300x169.jpg)
ইউরোপীয় ইউনিয়ন জার্মানির শক্ত অবস্থান প্রতিষ্ঠা থেকে শুরু করে ফ্রান্স, রাশিয়ার সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক সুসংহত করেছেন এই নেত্রী। ইউরোপজুড়ে প্রবল অর্থনৈতিক মন্দা আর এর ফলে তৈরী হওয়া ক্রমবর্ধমান বেকারত্বের কালো থাবা জার্মানের নাগরিকদের উপর পড়তেই দেননি মের্কেল। বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাবান নারীদের তালিকার প্রথম স্থানটি তার দখলে টানা ছয় বছর ধরে। বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর এই নারী শুধু নারীদের মধ্যেই নয়, ফোর্বসের হিসাবানুযায়ী বিশ্বের সব ক্ষমতাধর নেতাদের মধ্যেও আছেন তিন নম্বর অবস্থানে। ২০১৫ সালে তিনি জায়গা করে নিয়েছেন টাইম ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদে।
জার্মানির প্রভাবশালী দৈনিক বিল্ড সেদিন বড় করে তার ছবি ছাপিয়ে শিরোনাম দেয়, মিস জার্মানি। কিন্তু ঘটেছে তার উল্টো। এই দীর্ঘ সময় বিশ্বের অনেক নেতা এসেছেন আবার চলেও গেছেন। কিন্তু মের্কেল ছিলেন। কেউ তাকে নড়াতে পারেনি। তিনি তখনই যাচ্ছেন, যখন তিনি যেতে চেয়েছেন।
![](https://statewatch.net/wp-content/uploads/2021/09/৪-6-300x169.jpg)
![](https://statewatch.net/wp-content/uploads/2021/09/৫-5-300x169.jpg)
![](https://statewatch.net/wp-content/uploads/2021/09/৬-5-300x169.jpg)
![](https://statewatch.net/wp-content/uploads/2021/09/৭-5-300x153.jpg)
![](https://statewatch.net/wp-content/uploads/2021/09/৮-5-300x169.jpg)
![](https://statewatch.net/wp-content/uploads/2021/09/৯-5-300x169.jpg)
![](https://statewatch.net/wp-content/uploads/2021/09/১০-5-300x169.jpg)
![](https://statewatch.net/wp-content/uploads/2021/09/১১-5-300x199.jpg)
![](https://statewatch.net/wp-content/uploads/2021/09/১২-3-300x169.jpg)
![](https://statewatch.net/wp-content/uploads/2021/09/১৩-3-300x169.jpg)
![](https://statewatch.net/wp-content/uploads/2021/09/১৪-2-300x169.jpg)
![](https://statewatch.net/wp-content/uploads/2021/09/১৫-2-300x169.jpg)
ছবি: গেটি ইমেজ ও এএফপি।
সৌজন্যে-বিবিসি
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭১৭
আপনার মতামত জানানঃ