ভারতের কর্নাটকের কপ্পাল জেলার মিয়াপুর গ্রামের এক দলিত (তথাকথিত নিচু জাত) পরিবারকে ২৫ হাজার রুপি জরিমানা করা হয়েছে। তাদের দুই বছরের শিশু একটি মন্দিরে প্রবেশ করায় এই শাস্তি দেয়া হয়েছে। গতকাল বুধবার (২২ সেপ্টেম্বর) ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ইন্ডিয়া টুডে এ খবর প্রকাশ করেছে।
খবরে বলা হয়, ঘটনাটি ঘটেছে ৪ সেপ্টেম্বর। ওই দিন ছিল শিশুটির জন্মদিন। এই উপলক্ষে মা-বাবা শিশুটিকে নিয়ে মন্দিরে প্রার্থনা করতে যায়। বাবা মা প্রার্থনায় থাকার সময় ছেলেটি মন্দিরে প্রবেশ করে। মন্দিরের পুজারি ও স্থানীয়রা এতে আপত্তি তুলে এবং ১১ সেপ্টেম্বর এই জরিমানা ধার্য করা হয় মন্দিরের শুদ্ধিকরণ কাজের জন্য।
শিশুটির বাবা চন্দ্রু বলেন, ‘সেদিন ছিল আমার ছেলের জন্মদিন। আমরা আজানিয়া মন্দিরে প্রার্থনা করতে চেয়েছিলাম। বৃষ্টি শুরু হলে ছেলেটি মন্দিরে প্রবেশ করে। এর বাইরে কিছু ঘটেনি।’
স্থানীয় সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, মিয়াপুরার আজানিয়া মন্দিরের মতো এলাকার অনেক মন্দিরেই দলিতদের প্রবেশের অনুমতি নেই।
জরিমানার কথা ছড়িয়ে পড়লে স্থানীয় চান্নাদাসার সম্প্রদায়ের সদস্যরা প্রতিবাদ করেন এবং পুলিশের দ্বারস্থ হন। এই সম্প্রদায়েরই সদস্য চন্দ্রু। তবে গ্রামে বিশৃঙ্খলার আশায় চন্দ্রু ও তার পরিবার থানায় কোনও লিখিত অভিযোগ দায়ের করতে স্বীকৃতি জানাননি।
খবরে আরও বলা হয়, গ্রামের উচ্চ বর্ণের মানুষেরা শুদ্ধিকরণের জন্য দলিত পরিবারের কাছ থেকে অর্থ চাইলেও জেলা প্রশাসনের হস্তক্ষেপে বিষয়টির সমাধান হয়।
জানা যায়, মোট ৩৬ হাজার টাকা দাবি করা হয়েছে যার মধ্যে ১১ হাজার টাকা খরচ করা হবে মন্দির সাফ করার জন্য। বাকি ২৫ হাজার নগদ টাকা যাবে উঁচু জাতের সমাজের মাথাদের কাছে। এটি কোনও মধ্যযুগীয় ঘটনার কাহিনী নয়। একবিংশ শতকের ভারতেই ঘটেছে এই ঘটনা।
এর আগে ভারতের প্রেসিডেন্ট রাম নাথ কোভিন্দ ও তার স্ত্রী সভিতা কোভিন্দ মূলত দলিত সম্প্রদায়ের মানুষ বলে তাদের মন্দিরে প্রবেশ করতে দেয়া হয়নি। ভারতে দলিত সম্প্রদায় সামাজিক ও ধর্মীয় অনেক ক্ষেত্রেই বৈষম্যের শিকার হয়। কিন্তু খোদ দেশের প্রেসিডেন্টকেও এই ধরণের বৈষম্যের শিকার হতে হবে, তা বোধ হয় কেউ ভাবেনি।
টাইমস অব ইন্ডিয়ার খবরে বলা হয়, উড়িষ্যার একটি মন্দিরে প্রেসিডেন্ট ও তার স্ত্রীকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি, কারণ তারা দলিত। ২০১৭ সালের ১৮ই মার্চ উড়িষ্যার জগন্নাথ মন্দিরে প্রেসিডেন্ট ও তার স্ত্রির সঙ্গে দুর্ব্যবহার করা হয়। এই ঘটনার তিন মাস পর পুরি জেলা প্রশাসন তদন্ত শুরু করে।
খবরে বলা হয়, মন্দিরের পূজা মন্ডবে যাওয়ার পথে প্রেসিডেন্ট ও তার স্ত্রীর প্রবেশপথ রোধ করেন কিছু পুরোহিত। ওই পুরোহিতের দল এমনকি ফার্স্টলেডিকে ধাক্কাও মারে। এই পুরোহিতদের আচরণের প্রতিবাদ জানিয়ে স্থানীয় জেলা কালেক্টর অরভিন্দ আগরওয়ালের কাছে কড়া চিঠি পাঠায় রাষ্ট্রপতি ভবন। এরপর এ নিয়ে বৈঠকে বসে মন্দির কমিটি।
নিউজ ১৮ চ্যানেলের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক নিবন্ধে বলা হয়েছে, শুধু কোভিন্দ নন, এর আগেও ভারতের বেশ কিছু মন্দিরে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। ইন্দিরা গান্ধী, সোনিয়া গান্ধী এমনকি মহাত্মা গান্ধীকেও অনেক মন্দিরে ঢুকতে না দেওয়ার ঘটনা উল্লেখ করা হয় ওই নিবন্ধে।
প্রসঙ্গত, সনাতন ধর্মাবলম্বীদের চারটি বর্ণের বাইরের মানুষদেরকে দলিত বলা হয়ে থাকে। এই দলিতরা দীর্ঘদিন ধরে সামাজিকভাবে নিগৃহীত। অনেক উচ্চ বর্ণের হিন্দু এমনকি তাদেরকে ‘অস্পৃষ্য’ বিবেচনা করেন।
প্রসঙ্গত, ভারতজুড়ে অনগ্রসর জাতি ও সংখ্যালঘুদের উপর বাড়ছে অত্যাচার ও উৎপীড়নের ঘটনা। কোনো বিরোধী দল বা এনজিও নয়, এই দাবি স্বয়ং ভারতের মানব সম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রণালয়ের। এনএইচআরসি প্রকাশিত সরকারি রিপোর্ট বলছে, ভারতে দলিত-অনগ্রসর ও সংখ্যালঘু জাতির ওপর অত্যাচারের ঘটনা আগের থেকে অনেক বেড়ে গেছে। জাতি বিদ্বেষমূলক অপরাধের ক্রমবর্ধমান সংখ্যা উদ্বেগের। সরকারি রিপোর্টে এমন তথ্য সামনে আসায় কেন্দ্র সরকারের কপালে পড়েছে চিন্তার ভাঁজ।
সংশ্লিষ্টদের মতে, মানবাধিকারের প্রশ্নে রাষ্ট্র ক্ষমতার সঙ্গে মানুষের যেন সাপে-নেউলে সম্পর্ক৷ যুগ যুগ ধরে বৈষম্য আর বঞ্চনার শিকার হয়েছে ভারতের পিছিয়ে পড়া আদিবাসী গোষ্ঠী, গরিব কৃষক এবং সমাজ ব্যবস্থার এক্কেবারে নীচু স্তরে বসবাস দলিতদের৷ ব্রাহ্মণ আর দলিতের মধ্যে মানসিকতার ফারাক না থাকলেও, সমাজে দলিতরা যেন পণ্য ছাড়া আর কিছুই নয়! আর তাই, সুযোগ পেলে উঁচু জাতের হিন্দুরা এখনও দলিতদের ওপর অত্যাচার চালায়৷ তাদের হত্যা করে, ধর্ষণ করে অথবা লুট করে নেয় সমস্ত সম্পত্তি৷
এসডব্লিউ/এমএন/ডব্লিউজেএ/১৮২০
আপনার মতামত জানানঃ