তালিবানের নিশ্চয়তা সত্ত্বেও আফগানিস্তানের অনেক সাংবাদিক শঙ্কামুক্ত হতে পারছেন না। প্রতিদিন যে হাজার হাজার মানুষ দেশটি ত্যাগ করার চেষ্টা করছেন, তাদের মধ্যে সাংবাদিকেরাও রয়েছেন। অনেকেই বলছেন, তাদের জীবন এখন হুমকিতে। এর আগে তালিবান বাহিনীর শাসনের সময় দেশটিতে সংবাদমাধ্যমের মুখ বন্ধই ছিল বলা চলে। এরপর মার্কিন অভিযানে তালিবানের পতন হওয়ার পর গণমাধ্যম খাতে অগ্রগতি শুরু হয়। এখন আবার ফিরে এসেছে তালিবান শাসন। তাই ভীতিমুক্ত হতে পারছেন না দেশটির সাংবাদিকেরা।
আফগানিস্তানে সাংবাদিকতা যে ক্রমশ কঠিন হয়ে উঠেছে, এ বার সেই আশঙ্কা প্রকাশ করলেন ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব জার্নালিস্টসও (আইএফজে)। সাংবাদিকদের এই আন্তর্জাতিক সংগঠনের সেক্রেটারি জেনারেলের আশঙ্কা, পরিস্থিতি যে দিকে এগোচ্ছে, অদূর ভবিষ্যতে হয়তো আফগানিস্তানে সাংবাদিকতার কোনও অস্তিত্ব থাকবে না। খবর আনন্দবাজার
কয়েক দিন আগেই দেখা গিয়েছে, নারী ও শিশুদের অধিকারের দাবিতে পথে নামায় এতিলাত-এ-রোজ় সংবাদমাধ্যমের দুই সাংবাদিককে বিক্ষোভস্থল থেকেই আটক করে তাদের উপরে নৃশংস অত্যাচার চালায় তালিবান। প্রতিবাদের ছবি তোলায় আটক করা হয়েছিল টোলো নিউজ়ের এক চিত্রসাংবাদিককেও। আইএফজে-র সেক্রেটারি জেনারেল অ্যান্টনি বেলেঙ্গারের বক্তব্য, বর্তমানে সবকিছুর উপরেই নিয়ন্ত্রণ কায়েম করতে মরিয়া তালিবান। এর থেকে বাদ পড়েনি আফগানিস্তানে কর্মরত বিদেশি সাংবাদিকরাও।
অ্যান্টনি জানিয়েছেন, এ ধরনের পরিস্থিতিতে যেমনটা ঘটে, সেই ভাবেই বিদেশি সাংবাদিকদের অন্য রাষ্ট্রের গুপ্তচর বলে মনে করছে তালিবান। তাই স্বাধীনভাবে কাজের সুযোগ তো দূরের কথা ক্রমেই সংবাদমাধ্যমের উপরে তালিবানের নিয়ন্ত্রণ আরও বাড়তে থাকবে। এই পেশায় আর কোনও নারীকে দেখতে পাওয়া যাবে না বলেও আশঙ্কা অ্যান্টনির। বর্তমানে আফগানিস্তানে রয়েছেন ১৩০০ সাংবাদিক। যার মধ্যে মহিলাদের সংখ্যা ২২০।
১৯৯৬ সাল থেকে ২০০১ পর্যন্ত তালিবান শাসনে গণমাধ্যম বলতে কিছু ছিল না। বাহিনীটি টেলিভিশন, চলচ্চিত্র এবং অন্যান্য বিনোদনের মাধ্যমকে ইসলামি মতাদর্শের বিরোধী বলে গণ্য করত। এমনকি সে সময় কিছু কিছু বৈদ্যুতিক পণ্যও অনৈসলামিক হিসেবে অবৈধ ঘোষণা করা হয়।
কেউ টেলিভিশন দেখলে তাকে শাস্তি দেওয়া হতো এবং টিভিটি ভেঙে গুঁড়ো করে দেওয়া হতো। ভিডিও প্লেয়ারের মালিককে গণপিটুনি দেওয়া হতো।
ক্যাসেট ধ্বংস করে এর ফিতা কাবুলের কিছু কিছু এলাকার গাছে ঝুলতে দেখা গেছে। তখন শুধু একটিই রেডিও স্টেশন ছিল। নাম ভয়েস অব শরিয়া। এটি শুধু প্রপাগান্ডা ও ইসলামিক অনুষ্ঠান প্রচার করত।
২০০১ সালে মার্কিন নেতৃত্বাধীন বাহিনীর হাতে তালিবান উৎখাত হলে দেশটির গণমাধ্যম খাতে ব্যাপক অগ্রগতি ঘটে। সে সময় অনেক টেলিভিশন চ্যানেল ও রেডিও নেটওয়ার্ক আসে। শুধু যে সংবাদের চ্যানেল তা নয়, চলচ্চিত্র, নাটক, প্রতিভা খোঁজে বের করার অনুষ্ঠান ও মিউজিক ভিডিও তৈরি হয় প্রচুর।
এ ধরনের পরিস্থিতিতে যেমনটা ঘটে, সেই ভাবেই বিদেশি সাংবাদিকদের অন্য রাষ্ট্রের গুপ্তচর বলে মনে করছে তালিবান। তাই স্বাধীনভাবে কাজের সুযোগ তো দূরের কথা ক্রমেই সংবাদমাধ্যমের উপরে তালিবানের নিয়ন্ত্রণ আরও বাড়তে থাকবে। এই পেশায় আর কোনও নারীকে দেখতে পাওয়া যাবে না বলেও আশঙ্কা।
ন্যাশনাল প্রেস ফেডারেশনের কথা উল্লেখ করে গত মাসে রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস (আরএসএফ) জানায়, আফগানিস্তানে এখন ৫০টি বেশি টেলিভিশন চ্যানেল, ১৬৫টি রেডিও স্টেশন ও কয়েক ডজন প্রকাশনা সংস্থা রয়েছে। এ ছাড়া সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, বিশেষ করে স্মার্টফোনের মাধ্যমে ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার ব্যাপকভাবে বেড়েছে।
আর সবচেয়ে বড় বিষয় ছিল গণমাধ্যমে মেয়েদের কাজ করার সুযোগ দান। যেখানে তালিবানের শাসনকালে নারীদের পরিবারের বাইরে, শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে যাওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না, সেখানে তালিবান পরবর্তী সময়ে শত শত নারী সাংবাদিকতা, প্রডিউসার, আয়োজক ও পারফর্মার হিসেবে পর্দার সামনে ও পেছনে কাজ করে গেছেন। এমনকি ডজন ডজন সাংবাদিক বিদেশি গণমাধ্যমের প্রতিনিধি হিসেবেও কাজ করেন।
তালিবানের আশ্বাস পাওয়া সত্বেও এখনো ভীতি কাটছে না আফগানিস্তানের সাংবাদিকদের। দেশটিতে গণমাধ্যম খাতে বেশ অগ্রগতি হলেও বিশ্বে সাংবাদিকদের জন্য সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে আফগানিস্তান একটি। সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা ও সাংবাদিকের অধিকার নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক সংগঠন কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টের তথ্যমতে, ২০০১ সাল থেকে এ পর্যন্ত আফগানিস্তানে কমপক্ষে ৫৩ জন সাংবাদিক হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। বিগত বছরগুলোতে গণমাধ্যমকর্মীরা ছিলেন এই তালিবান বাহিনীর টার্গেট; যা ছিল স্বাধীন গণমাধ্যমের সূচকে আফগানিস্তানের নিচের দিকে থাকার বড় কারণ।
এদিকে তালিবান গত ১৫ আগস্ট কাবুল দখলের পর এক মাসেরও কম সময়ে আফগানিস্তানের ২০টি প্রদেশে ১৫৩টি গণমাধ্যম বন্ধ হয়েছে। মুক্ত গণমাধ্যম নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলোর বরাত দিয়ে আফগান সংবাদমাধ্যম টলোনিউজের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বন্ধ হয়ে যাওয়া গণমাধ্যমের মধ্যে আছে রেডিও, প্রিন্ট ও টিভি চ্যানেল। এগুলো বন্ধ হওয়ার মূল কারণ হিসেবে অর্থনৈতিক সমস্যা ও নিষেধাজ্ঞার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
মুক্ত গণমাধ্যম নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলোর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেছেন, যদি মিডিয়ার আর্থিক সংকটের সমাধান না হয় এবং তাদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা তুলে না নেওয়া হয় তবে দেশে আরও বেশ কয়েকটি গণমাধ্যম বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে।
আফগানিস্তান ফেডারেশন অব জার্নালিস্টস’র ডেপুটি হেড হুজাতউল্লাহ মুজাদাদি বলেন, ‘যদি মিডিয়া নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলো গণমাধ্যমের দিকে মনোযোগ না দেয়, তাহলে শিগগিরই দেশের বাকি মিডিয়াগুলো বন্ধ হয়ে যাবে।’
বন্ধ হওয়া মিডিয়া প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা নিশ্চিত করেছেন, অর্থনৈতিক সমস্যা ও বিধিনিষেধের কারণে তারা আর কাজ করতে পারছেন না।
পাক্তিকা প্রদেশের মিলমা রেডিও সম্প্রতি বন্ধ হয়ে গেছে। ২০১১ সালে প্রতিষ্ঠিত রেডিওটিতে রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও ক্রীড়া সংবাদ প্রচার করা হতো। রেডিওটির প্রধান সম্পাদক ইয়াকুব খান মঞ্জুর বলেন, ‘অনুপযোগী কাজের পরিবেশ ও অর্থনৈতিক সমস্যার কারণে আমাদের কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছি।’
তার মতে, ১৩টি প্রদেশে মিলমা রেডিওর ৩৫ জন কর্মী ছিলেন। তারা এখন সবাই বেকার।
মিলমা’র সাবেক প্রতিবেদক জামালউদ্দিন এলহাম বলেছেন, ‘দুর্ভাগ্যবশত, অর্থনৈতিক সমস্যার কারণে আমাদের রেডিও বন্ধ হয়ে গেছে।’
রেডিওটির আরেক প্রতিবেদক মোহাম্মদ ইকরাম শাহাব বলেন, ‘অর্থনৈতিক সমস্যার কারণে রেডিওটি কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছে এবং আমরা চাকরি হারিয়েছি।’
আফগানিস্তানে মুক্ত গণমাধ্যম নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলো বলছে, অর্থনৈতিক সমস্যা মারাত্মক এবং নিষেধাজ্ঞার মধ্যে কাজ করা মিডিয়ার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩৪৭
আপনার মতামত জানানঃ