নারীদের প্রতি কঠোর নীতিমালা তৈরিতে কাজ করছে তালিবান। এরই মধ্যে দেশটিতে নারী মন্ত্রণালয় বাতিল করে স্থাপন করা হয়েছে পাপপুণ্য বিষয়ক মন্ত্রণালয়। তালিবানের ক্ষমতা গ্রহণের কারণে দেশটিতে নারীরাই আছে শঙ্কার মধ্যে, সেখানে সমকামী জনগোষ্ঠীর অবস্থা আরও ভয়াবহ।
তালিবানরা আফগানিস্তান দখল করে নেবার পর থেকেই আতঙ্কে রয়েছেন সে দেশের সমকামী সম্প্রদায়ের মানুষজন। তাদের ওপরে তালিবানি খড়্গ যেকোন মুহূর্তে নেমে আসতে পারে। নারীদের ওপর যেভাবে তালিবানি ফতোয়া নেমে এসেছে, খুব শীঘ্রই যে তারা তালিবানের শিকার হতে চলেছেন সেই আশঙ্কা প্রকাশ করছেন সমকামীরা।
আফগানিস্তানে বসবাসরত সমকামী বা ট্রান্স জেন্ডারদের অনেকেই এরই মধ্যে দেশ ছাড়তে সফল হয়েছে। তবে যারা এখনও আটকে আছেন, তাদের পরিস্থিতি খুবই শোচনীয়। তালিবানের ভয়ে তাদের মধ্যে অনেকে সপ্তাহের পর সপ্তাহ বাড়ির বেসমেন্টে লুকিয়ে আছেন। কেউ বা যথেষ্ট খাবারের সরবরাহ ছাড়াই বন্দি হয়ে আছেন একটি গোপন কক্ষে, কেউ গা ঢাকা দিয়ে আছেন বন্ধুর সাহায্যে।
অনেক সমকামী এরই মধ্যে ধরা পড়েছেন তালিবানের হাতে। ভুক্তভোগী এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের দাবি, ধরা পড়ার পর তালিবানের হাতে ধর্ষণের শিকার হচ্ছে বহু সমকামী। অনেককে হত্যা করা হয়েছে বলেও অভিযোগ।
সমকামীদের সম্পর্কে এখনও তালিবান সরকার আনুষ্ঠানিক কোনও নীতি নির্ধারণ করেনি বলে জানা গেছে। তবে সম্প্রতি জার্মানি ভিত্তিক একটি সংবাদমাধ্যমে তালিবানের একজন বিচারক জানিয়েছিলেন, সমকামীদের জন্য দু’টি শাস্তি রয়েছে। একটি হলো পাথর নিক্ষেপ, অপরটি হলো দেয়ালে পিষে হত্যা করা।
ভুক্তভোগী এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের দাবি, ধরা পড়ার পর তালিবানের হাতে ধর্ষণের শিকার হচ্ছে বহু সমকামী। অনেককে হত্যা করা হয়েছে বলেও অভিযোগ।
এই বিষয়ে এক তালিবান মুখপাত্রের মন্তব্য চাইলে তিনি জানান, এই সম্প্রদায় নিয়ে সরকারিভাবে কোনও পরিকল্পনা এখনও নাই। কিছু অগ্রগতি ঘটলে জানানো হবে।
তালিবানের মতে, শরিয়াহ আইন অনুসারে সমকামিতার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড।
এলজিবিটিকিউ সম্প্রদায়ের কয়েকজন সিএনএনকে জানান, তারা জানতে পেরেছেন তাদের বন্ধু, পার্টনার ও এই সম্প্রদায়ের মানুষ হামলা ও ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন। তালিবান শাসকরাও তাদের সঙ্গে এমন আচরণ করতে পারে বলে তারা আতঙ্কিত।
কয়েকজন জানান, তারা কয়েক সপ্তাহ ধরে একটি বেজমেন্টের একটি রুমে দেয়াল বা ফোনের স্ক্রিনের দিকে অনির্দিষ্টকাল তাকিয়ে থাকছেন। যদি বাইরে বের হওয়ার কোনও ইঙ্গিত পাওয়া যায়। অনেকে বন্ধুদের সহযোগিতায় লুকিয়ে আছেন। অনেকেই আছেন একা, ফুরিয়ে গেছে খাবার।
তবে সবাই বলছেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তাদের পরিত্যাগ করেছে বলে অনুভব করছেন তারা।
আফগানিস্তানে কৈশোর পার করায় নিজেকে ভাগ্যবান মনে করে রাবিয়া বালখি। সমকামী সম্প্রদায়ের প্রতি বৈষম্যের দীর্ঘ ইতিহাস থাকা দেশটিতে জন্ম নেওয়ার পরও তার পরিবার লেসবিয়ান হিসেবে তাকে মেনে নিয়েছে। কিন্তু এখন বালখি বলছেন, এই বিরল মেনে নেওয়ার ঘটনাই তার জীবন হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে। কারণ আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ নেওয়া তালিবান গোষ্ঠী দেশটির গে, লেসবিয়ান ও রূপান্তরকামীদের বিরুদ্ধে শারীরিক সহিংসতা ও আতঙ্ক ছড়াচ্ছে।
তালিবান ক্ষমতা দখলের পরই বালখি ও তার পরিবার আত্মগোপনে চলে যান। দেশটি ছাড়তে বাইরের সহযোগিতা চাওয়া কয়েকশ’ সমকামী মানুষদের একজন তিনি।
অজ্ঞাত স্থান থেকে মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএনকে তিনি বলেন, পরিস্থিতি প্রতিদিন খারাপ হচ্ছে। গ্রেপ্তার হওয়ার আতঙ্ক এখন জীবনের অংশ হয়ে গেছে। এতই উদ্বিগ্ন যে এখন আমি রাতে ঘুমাতে পারি না।
বালখি জানান, তালিবান আমার পরিবার সম্পর্কে সব জানে। তিনি আশঙ্কা করছেন, তার পরিবার হামলার শিকার হতে পারে কিংবা সমকামী হওয়ায় তাকে হত্যা করা হতে পারে। তিনি আতঙ্কে রয়েছে, তালিবান তাকে খুঁজে পেলে পাথর নিক্ষেপ করে হত্যা করবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সমকামীর কথায়, ‘কীভাবে মানুষের উপর তালিবান অত্যাচার চালায় তার ভয়ানক অভিজ্ঞতা রয়েছে। আমি যে সমকামী সেটা কাউকেই জানাইনি। কারণ, এই খবরটা ছড়িয়ে পড়লেই তালিবানের কাছে পৌঁছাবে। আর তার পরই আমার উপর নেমে আসবে মৃত্যুদণ্ডের খাঁড়া’।
একই সুর শোনা গিয়েছে বছর একুশের এক যুবকের কথায়। এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছেন, তার মা-বাবাও জানেন না যে তাদের ছেলে সমকামী। যদি তারা জানতেন তা হলে এত দিনে জেলের ঘানি টানতে হত। ওই যুবকের কথায়, ‘কিন্তু এখন পরিস্থিতি আরও ভয়ানক। আগের পরিস্থিতি থাকলে হয়তো জেলবন্দি থাকতাম। কিন্তু এখন তালিবান রাজ চলছে। তারা যদি জানতে পারে আমি সমকামী, তা হলে মৃত্যু অনিবার্য’।
এই দুই সমকামীর মতোই বাকিরা তালিবানের রক্তচক্ষু থেকে নিজেদের আড়াল করে রাখার চেষ্টা করছেন। তাদের আশঙ্কা নারীদের ওপর যদি এত কঠোর নিষেধাজ্ঞা নেমে আসতে পারে তা হলে শরিয়তি আইনের চোখে ‘ঘৃণ্য’ সমকামীদের কী পরিণতি হতে পারে তা ভেবেই আত্মগোপনের পথ খুঁজছেন অনেকেই। হয়তো এ বার সমকামীদের খুঁজে খুঁজে তালিকা তৈরি করে মৃত্যুদণ্ডের ব্যবস্থা করবে তালিবান, এমনটাই বলছেন আফগানিস্তানের সমকামীরা।
বর্তমানে আফগানিস্তান থেকে সহায়তাকারী ফ্লাইটগুলোও বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সমকামী জনগোষ্ঠীর সদস্যদের আর পালানোর পথ নেই আপাতত। তাই প্রতিটি দিন তাদের কাটছে আতঙ্কের মধ্যে। আশঙ্কা এখনই দেশ থেকে পালাতে না পারলে আমৃত্যু এভাবেই কাটাতে হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪১৭
আপনার মতামত জানানঃ