বাংলাদেশ সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির দৃষ্টি গ্রামের দরিদ্রদের দিকেই বেশি। এদিকে নজর কম শহরের দরিদ্রের প্রতি। গ্রামে দরিদ্র মানুষের বাইরেও অনেকে এ কর্মসূচির সুফল ভোগ করছে। কিন্তু শহরে দরিদ্রদের ৫৭ শতাংশই সামাজিক নিরাপত্তা সুবিধা পায় না।
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শহর এলাকায় প্রতি ৫ জনে একজন দরিদ্র, যাদের অনেকেই সরকারের সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির বাইরে রয়েছেন। আজ বৃহস্পতিবার সংস্থাটির এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ কথা বলা হয়।
গ্রামীণ ও শহর এলাকার মধ্যে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির ভারসাম্য রাখা প্রয়োজন বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
এতে বলা হয়েছে, শহর এলাকায় প্রায় ১১ শতাংশ মানুষ সামাজিক সুরক্ষায় আছেন যদিও ১৯ শতাংশ মানুষ দরিদ্র। অন্যদিকে, গ্রামাঞ্চলে ২৬ শতাংশ মানুষ দরিদ্র যদিও ৩৬ শতাংশ মানুষ সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় রয়েছেন।
গবেষণায় উঠে এসেছে, একাধিক সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে প্রকৃত দরিদ্ররা সুবিধা পায় না। অবস্থাসম্পন্ন মানুষেরা এর ফল ভোগ করে। আবার এ কর্মসূচির বাস্তবায়নে যেসব কর্মী আছেন, তাদের দক্ষতার অভাব প্রকট। সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিগুলোর বিশ্লেষণ ও জরিপের মাধ্যমে এ গবেষণা করা হয়েছে।
গবেষণায় বলা হয়েছে, দেশে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতা বেড়েছে। দেশের ১০টি পরিবারের মধ্যে ৩টি পরিবার এখন সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় আছে। কিন্তু এর কার্যকারিতা এখনও আশানুরূপ নয়। অন্তর্ভুক্তির সংখ্যা বাড়লেও দারিদ্র্যের হার আনুপাতিক হারে কমেনি। এসব কর্মসূচির নানা প্রক্রিয়াগত জটিলতা ও দীর্ঘসূত্রতা রয়ে গেছে। ফলে আখেরে এর কার্যকারিতা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে প্রকৃত দরিদ্ররা এ সুবিধা পাচ্ছে না।
সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্তির সংখ্যা বাড়লেও দারিদ্র্যের হার আনুপাতিক হারে কমেনি। দেশের প্রতি আট দরিদ্র মানুষের একজন শিশু। কিন্তু এসব শিশুর জন্য সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির মাত্র ১ দশমিক ৬ শতাংশ ব্যয় হয়।
খাদ্যসহায়তা ও নগদ অর্থপ্রাপ্তির কর্মসূচিতে আছে এমন ৪৯ থেকে ৬৬ শতাংশ মানুষই দরিদ্র নয়। এমন বেশ কিছু কর্মসূচিতে সুবিধাভোগীদের মান কী হবে, তা নির্ধারণ করা হয়নি। শহুরে বয়স্ক ভাতা ও অতিদরিদ্রদের কর্মসংস্থান কর্মসূচিতে (ইজিপিপি) যথাক্রমে ২০ শতাংশ ও ৩৮ শতাংশই দরিদ্র না হয়েও সুবিধা নেয়।
গবেষণায় উল্লেখ করা হয়, মোট ১৩০টি সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির মধ্যে ৩০টিতে মোট বরাদ্দের ৯০ শতাংশ ব্যয় হয়। ছোট আকারের ১০০টিতে বরাদ্দ মাত্র ১০ শতাংশ।
সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির ব্যবস্থাপনায় বরাদ্দ খুবই কম। এর মধ্যে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় সাড়ে ৮ শতাংশ, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় আড়াই শতাংশ এবং মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় মাত্র ১ শতাংশ ব্যয় করে। ফলে তাদের গ্রহণ করা কর্মসূচির কার্যকারিতা কম হচ্ছে।
‘বাংলাদেশ সোশ্যাল প্রটেকশন পাবলিক এক্সপেনডিচার রিভিউ’ শিরোনামের প্রতিবেদনে বাংলাদেশের চলমান সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি ও প্রকল্পে বিনিয়োগ এবং সেগুলোকে কিভাবে আরও গতিশীল করা যায় সে বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে।
বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ ও ভুটানের অপারেশনস ম্যানেজার দনদন চেন বলেন, ‘গত কয়েক দশকে বাংলাদেশ সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির পরিধি অনেক বাড়িয়েছে। বর্তমানে দেশের প্রতি ১০ ঘরের ৩ ঘর এই পরিধির আওতায় রয়েছে। চলমান বৈশ্বিক করোনা মহামারির কারণে আরও জোরালো কর্মসূচির প্রয়োজন দেখা দিয়েছে’ উল্লেখ করে তিনি আরও সমন্বিত কর্মসূচির ওপর জোর দেন।
পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, ‘সার্বিকভাবে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি নিয়ে আমরা ইতিবাচক মূল্যায়নই পাই। এ নিয়ে কিছু দুর্নীতির অভিযোগও আছে। এসব অস্বীকার করা যাবে না।’
দুর্যোগকালে এ কর্মসূচির আওতায় মানুষের জন্য থোক বরাদ্দ বেড়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত মোট বরাদ্দের মাত্র ৩ শতাংশ দুর্যোগকালীন।
সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিগুলোর মধ্যে খাদ্যসহায়তা ও নগদ অর্থ দেওয়ার কর্মসূচি অপেক্ষাকৃত ভালোভাবে চলে। কিন্তু মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষার্থীদের জন্য বৃত্তি , গ্রামীণ টেস্ট রিলিফ এবং শহুরে বয়স্ক ভাতার (ওএএ) কর্মসূচির পরিচালন মান উন্নত নয়।
এদিকে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির কর্মীদের দক্ষতার সমস্যা প্রকট। ৮২ শতাংশ কর্মী তাদের কাজের তথ্য কম্পিউটারে দিতে পারেন না। ৬৮ শতাংশ কম্পিউটার ব্যবহার করেন না। ৬১ শতাংশ শুধু কাগজে তাঁদের উপাত্তগুলো লিখে রাখতে পারেন।
সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির অর্থ ছাড় হয়ে মানুষের হাতে পৌঁছাতে অন্তত দুই মাস সময় চলে যায়। নানা ধাপ পেরোতেই এ দেরি।
একটি সফল সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির চারটি দিক থাকা দরকার বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমান। তার মতে, এ দিকগুলো হলো অর্থায়ন, কার্যকর সুবিধাভোগী চিহ্নিত করা, কার্যক্রর তথ্যভান্ডার তৈরি এবং মাঠপর্যায়ে বরাদ্দের সঙ্গে জড়িতদের মান উন্নয়ন।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) নির্বাহী চেয়ারম্যান হোসেন জিল্লুর বলেন, বাজেটের হিসাবে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ২ দশমিক ৬ শতাংশ সামাজিক সুরক্ষায় ব্যয় হচ্ছে বলে জানানো হয়। কিন্তু এর মধ্যে আমলাদের পেনশনকেও ধরা হয়েছে। সামাজিক সুরক্ষার যে ধারণা তার মধ্যে তাঁরা তো পড়তে পারেন না। তাই সাকল্যে এটি বাজেটের দেড় শতাংশের বেশি হবে না।
বিশেষজ্ঞদের মতে, কার্যকর সুবিধাভোগী নির্বাচন করার ক্ষেত্রে সমস্যা আছে, যা এ গবেষণায় স্পষ্ট হয়েছে। আর এর সঙ্গে কর্মীদের দক্ষতার বিষয়টিও জড়িত। সেখানে দক্ষতা থাকলে উপকারভোগী নির্বাচন সহজ হতো। তথ্যভাণ্ডার বলতে শুধু কম্পিউটারে উপাত্ত সংগ্রহ নয়, এটি বিশ্বাসযোগ্য তথ্যের বিশ্বাসযোগ্যভাবে সংগ্রহের বিষয়। এ ক্ষেত্রেও আমাদের ঘাটতি আছে। গবেষণাটি এটি মূর্ত করেছে।
এসডব্লিউ/এমএন/ডব্লিউজেএ/১৯২৩
আপনার মতামত জানানঃ