দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এসে আফগান নারীদের বিষয়ে ভিন্ন সুর বাজালেও তালিবান গোষ্ঠী তাদের সরকার গঠন থেকে শুরু করে নানা ক্ষেত্রে নারীদের প্রতি পূর্বেকার মনোভাবই ধরে রেখেছে। আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীর চাপে পড়ে তালিবানের মুখে আফগান নারী বিষয়ে কিছুটা নরম সুর বাজলেও দিনশেষে আগের রূঢ় আচরণই বজায় রেখেছে তালিবান। পড়ালেখা থেকে খেলাধুলা— নানা বিষয়ে দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা। এর মধ্যে তালিবান–নিযুক্ত আফগানিস্তানের খেলাধুলা ও শারীরিক শিক্ষাবিষয়ক দপ্তরের মহাপরিচালক জানিয়েছেন, দেশটিতে ৪০০ ধরনের খেলাধুলার অনুমোদন দেওয়া হবে। কিন্তু নারীরা খেলায় অংশ নিতে পারবেন কিনা তা নিয়ে তালিবান চুপ।
আফগানিস্তান ক্রীড়া বিভাগের মহাপরিচালক আহমেদ রুস্তমজাই এএফপিকে বলেছেন, ‘মেয়েদের খেলার ব্যাপারে আমাকে দয়া করে কিছু জিজ্ঞাসা করবেন না।’ নিজে আফগানিস্তানের কুংফু ও কুস্তি চ্যাম্পিয়ন থাকলেও মেয়েদের খেলা নিয়ে চুপ থাকাই শ্রেয় মনে করেছেন তিনি। এ ব্যাপারে যাবতীয় প্রশ্ন এড়িয়ে গেছেন।
১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত আফগানিস্তানের ক্ষমতায় থাকাকালে খেলাধুলার ব্যাপারে বেশ কট্টর অবস্থান নিয়েছিল তালিবান। সে সময় পুরুষের বিভিন্ন খেলাধুলার ওপর তালিবানের কঠোর নিয়ন্ত্রণ ছিল। আর নারীদের খেলাধুলা তারা পুরোপুরি নিষিদ্ধ করেছিল। সে সময় স্টেডিয়ামগুলো প্রায়ই ‘অপরাধীদের’ সাজা কার্যকরের স্থান হিসেবে ব্যবহার করা হতো। তবে এবার ক্ষমতায় এসে কিছুটা ভিন্ন সুরে কথা বলছে তালিবান।
আফগানিস্তানের খেলাধুলা ও শারীরিক শিক্ষাবিষয়ক দপ্তরের মহাপরিচালক বশির আহমাদ রুস্তমজাই এএফপিকে বলেন, প্রায় ৪০০ ধরনের খেলাধুলার অনুমোদন দেওয়া হবে। শরিয়াহ আইনের বিরুদ্ধে না গেলে কোনো খেলার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হবে না।
রুস্তমজাই বলেন, শরিয়াহ আইন মেনে চললে আফগানিস্তানের খেলাধুলায় বিশ্বের অন্য দেশগুলোর তুলনায় খুব কমই পরিবর্তন আসবে। উদাহরণ দিতে গিয়ে তিনি বলেন, ফুটবল খেলোয়াড় বা বক্সারদের হাঁটুর নিচ পর্যন্ত প্যান্ট পরে খেলায় নামতে হবে। ফলে খেলায় খুব বেশি পরিবর্তন আসবে না।
সাঁতার থেকে ফুটবল, অশ্বারোহন থেকে ক্রিকেট, আফগনিস্তানে সব খেলাই খেলতে পারবে পুরুষরা। তালিবান জানিয়ে দিয়েছে, পুরুষরা চারশর মতো খেলায় অংশ নিতে পারবেন। কোনো বাধা নেই। কিন্তু মেয়েরা? ডিরেক্টর জেনারেল অফ স্পোর্টস বসির আহমেদ রুস্তমজাই সংবাদসংস্থা এএফপি-কে বলেছেন, ‘মেয়েদের খেলার ব্যাপারে আমাকে দয়া করে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করবেন না।’
মেয়েদের খেলায় অংশগ্রণ করার অনুমতি প্রসঙ্গে আহমেদ রুস্তমজাই তার এক পরামর্শদাতা বলেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে ছেলেদের মতো মেয়েরা সব খেলায় অংশ নেবে, এটা ভাবা যায় না। তবে অল্প কিছু খেলায় মেয়েরা আলাদাভাবে অংশ নিলেও নিতে পারে। তবে আহমেদ রুস্তমজাই তার পরামর্শদাতার এ বক্তব্য সমর্থন করেননি।
এখনো পর্যন্ত আফগানিস্তানে মেয়েরা কোনো খেলায় অংশ নিতে পারবেন কিনা, তা বলা যাচ্ছে না। গত সপ্তাহে তালিবানের সাংস্কৃতিক কমিশনের উপ-প্রধান আহমদুল্লাহ ওয়াসিক বলেছেন, ‘মেয়েদের জন্য তো খেলায় অংশ নেওয়াটা জরুরি কোনো বিষয় নয়। আর ক্রিকেট খেলতে হলে, তাদের মুখ ও সারা শরীর ঢেকে রাখা সম্ভব নয়।’
তবে মেয়েদের ক্রিকেট খেলা নিয়ে তালিবানের উপর চাপ বাড়ছে। কারণ, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিধি হলো, প্রতিটি দেশ যারা পুরুষদের ক্রিকেট খেলে, তাদের মেয়েদের দলও বাধ্যতামূলকভাবে রাখতে হবে। তাদের টেস্ট ম্যাচ খেলতে হবে। আফগানিস্তান ক্রিকেট বোর্ডের প্রেসিডেন্ট আজিজুল্লাহ ফজলি বলেছেন, মেয়েদের ক্রিকেট খেলার ব্যাপারে তিনি এখনো আশাবাদী।
কিন্তু রুস্তমজাই জানিয়ে দিয়েছেন, ‘এই বিষয়ে তালিবান শীর্ষ নেতাদের সিদ্ধান্তই শেষ কথা বলবে। তারা যদি বলেন, আমরা মেয়েদের খেলার অনুমতি দিতে পারি, তা হলে দেব। তারা যদি নিষেধ করেন, তাহলে মেয়েরা খেলতে পারবেন না।’
আগামী নভেম্বরে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে নিজেদের ইতিহাসে প্রথম টেস্ট ম্যাচ খেলতে যাচ্ছে আফগানিস্তানের পুরুষ ক্রিকেট দল৷ কিন্তু তালিবানের সাংস্কৃতিক কমিশনের উপ-প্রধানের বক্তব্য শুনে অস্ট্রেলিয়া জানিয়ে দেয় আফগান নারীদের খেলাধুলার অধিকার কেড়ে নেয়া হলে হোবার্টে অনুষ্ঠেয় আফগানিস্তান-অস্ট্রেলিয়া টেস্ট ম্যাচ বাতিল করা হবে৷ অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক টিম পেইনও তার অসন্তোষ এবং ক্ষোভের কথা জানান কঠোরভাবে৷ পেইন মনে করেন, নারীদের অধিকার কেড়ে নিয়ে আফগানিস্তান যদি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে দল পাঠায়, তাহলে অন্য দেশগুলোর উচিত হয় তার প্রতিবাদে আসর থেকে নিজেদের দল প্রত্যাহার করে নেয়া অথবা আফগানিস্তান দলকে বয়কট করা৷
নারী ক্রীড়াবিদদের বিষয়ে তালিবানের সম্ভাব্য সিদ্ধান্ত আইসিসিতে আফগানিস্তানের পূর্ণ সদস্য পদকেও ফেলেছে হুমকিতে৷
ক্রিকেটের সর্বোচ্চ সংস্থা আইসিসির নিয়ম অনুযায়ী টেস্ট খেলুড়ে প্রতিটি দেশে নারীদের সক্রিয় দলও থাকতে হবে৷ তাই নারীর অংশগ্রহণের সুযোগ না থাকলে আফগানিস্তানের পূর্ণ সদস্যপদও থাকবে কিনা এ বিষয়ে নভেম্বরের বোর্ড মিটিংয়েই সিদ্ধান্ত নিতে চায় আইসিসি৷
এমন চতুর্মুখী চাপের মুখে আগেই অসহায়ত্ব প্রকাশ করেছিল আফগানিস্তান ক্রিকেট বোর্ড৷ অস্ট্রেলিয়াকে হোবার্ট টেস্ট বাতিল না করার অনুরোধ জানিয়ে এক বিবৃতিতে বোর্ড বলেছিল, ‘আফগানিস্তানের সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় পরিবেশ পরিবর্তনে আমরা অক্ষম, তাই আমাদের একা করে দেবেন না৷’
কিন্তু আফগান ক্রিকেট বোর্ডের এই অনুরোধ হোবার্ট টেস্ট বাতিল বাতিল হওয়া ঠেকাতে পারলেও আফগানিস্তানের আইসিসির সদস্যপদ খারিজ হওয়ার আশঙ্কা দূর করতে পারতো না৷
সংবাদ মাধ্যমের খবর অনুযায়ী, আফগানিস্তানের নারী ক্রিকেটাররা এখন পালিয়ে বেড়াচ্ছেন৷ তালিবান তাদের খুঁজে বের করতে কাবুলের বাড়ি বাড়ি হানা দিচ্ছে৷ তবে আফগানিস্তান ক্রিকেট বোর্ডের চেয়ারম্যান এসবিএস রেডিও পাশতো-কে বলেন, ‘ নারী ক্রিকেট কোচ ডায়না বারাকজাই এবং তার খেলোয়াড়রা নিরাপদ আছেন৷ নিজেদের দেশেই আছেন তারা৷ অনেক দেশ তাদের আফগানিস্তান ছাড়তে বলেছে, কিন্তু তারা আফগানিস্তান ছেড়ে যাননি৷’
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮১৮
আপনার মতামত জানানঃ