যুক্তরাষ্ট্র আর তাদের মিত্ররা দীর্ঘদিন ধরেই অভিযোগ করে আসছে পাকিস্তান আফগান তালিবান এবং তাদের মিত্র হাক্কানি নেটওয়ার্ককে নিরাপদ স্বর্গ গড়ে তুলতে দিয়েছে। আফগানিস্তানে তালিবানের ক্ষমতা দখলে পাকিস্তানের হাতকেই শক্তিশালী হিসাবে দেখা হয়। এমন পরিস্থিতিতে ওয়াশিংটনের পক্ষ থেকে কড়া নজর রাখা হচ্ছে ইসলামাবাদের কর্মকাণ্ডের উপর। আফগানিস্তান বিষয়ে পাকিস্তানের অবস্থানের ওপর’ই ঠিক হবে আগামী দিনের ইসলামাবাদ-ওয়াশিংটন কূটনৈতিক সম্পর্কের গতিপথ।
আফগানিস্তান হতে আমেরিকান সেনা সম্পূর্ণ ভাবে প্রত্যাহারের পরে এই প্রথম কংগ্রেসে তালেবান প্রসঙ্গ উত্থাপন করেন আমেরিকান পররাষ্ট্রমন্ত্রী। হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভ-এর বিদেশ বিষয়ক কমিটির সামনে তিনি বলেছেন, ‘আফগানিস্তানের সঙ্গে পাকিস্তানের একাধিক স্বার্থ জড়িয়ে রয়েছে। যার মধ্যে বেশ কয়েকটি আবার ওয়াশিংটনের স্বার্থের বিরোধী।’
গত দুই দশক ও নিকট ভবিষ্যতে আফগানিস্তানে পাকিস্তানের ভূমিকার আলোকে তাদের সঙ্গে ভবিষ্যৎ সম্পর্কের রূপরেখা ঠিক হবে বলে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন জানিয়েছেন।
গত মাসে তালিবান আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর স্থানীয় সময় সোমবার প্রথম এ বিষয়ে কংগ্রেস সদস্যদের মুখোমুখি হন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। মার্কিন কংগ্রেসের হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভসের পররাষ্ট্রবিষয়ক কমিটিকে ব্লিঙ্কেন বলেন, আফগানিস্তানে পাকিস্তানের নানামুখী স্বার্থ রয়েছে, সেগুলোর কিছু বিষয় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
ওই বিষয়গুলো তুলে ধরে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, একটা হলো আফগানিস্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে পাকিস্তানের ধারাবাহিক প্রচেষ্টা, আরেকটি হলো তালিবান সদস্যদের পৃষ্ঠপোষকতা এবং আরও একটি বিষয় হচ্ছে সন্ত্রাস দমন নিয়ে ওয়াশিংটনের সঙ্গে ইসলামাবাদের সম্পৃক্ততা।
পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্মূল্যায়নের সময় হয়েছে কি না, সে প্রশ্ন পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে করেছিলেন কংগ্রেস সদস্যরা। জবাবে ব্লিঙ্কেন বলেন, শিগগিরই তা করা হবে।
ব্লিঙ্কেন বলেন, ‘সামনের দিন ও সপ্তাহগুলোতে আমরা যেসব বিষয় দেখতে চলেছি তার একটি এটা। ২০ বছর ধরে পাকিস্তান যে ভূমিকা পালন করেছে শুধু সেটাই নয়, আগামী বছরগুলোতে আমরা তাদের যে ভূমিকা চাই এবং তার জন্য তারা কী করবে, সেসব বিষয় বিবেচনা করা হবে।’
আন্তর্জাতিক মহলের দাবি পূরণ ছাড়া তালিবান সরকারকে বৈধতা না দিতেও পাকিস্তানের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তালিবানের কাছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাওয়া সম্পর্কে তিনি বলেন, যেসব ব্যক্তি আফগানিস্তান ছাড়তে চান, তাদের নিরাপদে বের আসা নিশ্চিত করা এবং নারী, মেয়েশিশু ও সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষা। এ ছাড়া আফগানিস্তান যেন আবার সন্ত্রাসীদের স্বর্গরাজ্য না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে।
ব্লিঙ্কেন বলেন, তাই এগুলোর নিরসন এবং ওই সব প্রত্যাশা যাতে পূরণ করা হয়, সে জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বড় অংশের সঙ্গে পাকিস্তানের কাজ করা দরকার।
যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাটো–বহির্ভূত মিত্র (এমএনএন) দেশ হিসেবে বেশ কিছু সামরিক সুবিধা পায় পাকিস্তান। দেশটির ওই মর্যাদা প্রত্যাহারের আহ্বান জানান হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভসের ডেমোক্র্যাট সদস্য জোয়াকুইন কাস্ট্রো।
মার্কিন কংগ্রেসে কোনো আগন্তুক নন ব্লিনকেন। তিনি এর আগে তৎকালীন সিনেটর জো বাইডেনের স্টাফ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। সিনেট ফরেন রিলেশন্স কমিটিতে সভাপতিত্ব করেছেন। ফলে তিনি সেখানকার সব নিয়মকানুন পুংখানুপুঙ্খভাবে জানেন। তাই দৃপ্তকণ্ঠে বলেন, উত্তরাধিকার সূত্রে (আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহারের জন্য) আমরা একটি ডেডলাইন পেয়েছিলাম। তালিবানদের সঙ্গে ডনাল্ড ট্রাম্প যে চুক্তি করে গিয়েছেন, তা অনুসরণ করতে বাধ্য ছিলেন জো বাইডেন। বাইডেন যখন দায়িত্ব গ্রহণ করেন তখন আফগানিস্তানে মার্কিন সেনার উপস্থিতি কমিয়ে ২৫০০ করা হয়। ওই চুক্তি সত্ত্বেও তালিবানরা বেপরোয়াভাবে তাদের সামরিক অভিযান চালিয়ে যেতে থাকে। ফলে বাইডেনকে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হয় এই যুদ্ধ বন্ধের বা যুদ্ধ চালিয়ে যেতে।
ব্লিনকেন বলেন, প্রেসিডেন্ট বাইডেন যদি তার উত্তরসুরির প্রতিশ্রুতি অনুসরণ না করতেন তাহলে আফগানিস্তানে আমাদের সেনা ও মিত্রদের ওপর হামলা বৃদ্ধি পেতো। আফগানিস্তানের বড় বড় শহরে তালিবানরা বড় রকমের হামলা চালাতো। এরই মধ্যে ডেমোক্রেটিক নেতৃত্বাধীন কংগ্রেশনাল কমিটি সেনা প্রত্যাহারের বিষয়টি তদন্ত করছে।
আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের সময় কাবুল বিমানবন্দরে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। ওই হামলার ১৩ মার্কিন সেনা নিহত হন। অভিযোগ রয়েছে, পাকিস্তানের সঙ্গে তালিবানের গভীর সম্পর্ক রয়েছে। তবে এই অভিযোগ অস্বীকার করে ইসলামাবাদ।
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, শুনানিতে আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তের পক্ষে কথা বলেছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
ব্লিঙ্কেন বলেন, আফগানিস্তানে সেনারা আরও বেশি দিন থাকলেও পরিস্থিতির তেমন পরিবর্তন হতো না।
গত ২০ বছরের আফগান যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ছয় হাজারের বেশি মার্কিন সেনার মৃত্যু হয়েছে। এ ছাড়া মার্কিন সেনাদের হাতে মৃত্যু হয়েছে এক লাখের বেশি আফগান জনগণের। যুক্তরাষ্ট্রের এই যুদ্ধে খরচ করেছে দুই ট্রিলিয়নের বেশি মার্কিন ডলার।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭২৪
আপনার মতামত জানানঃ