সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে বিজ্ঞান মানু্ষকে অনেক কিছু উপহার দিয়েছে, যা জীবনযাপনকে করেছে সহজতর৷ কিন্তু বিজ্ঞানের সেই আশীর্বাদ মানুষের বিবেচনার অভাবে পরিণত হয়েছে অভিশাপে৷ প্লাস্টিক বর্জ্য তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ৷
আমাদের প্রতিদিনের বেঁচে থাকায় প্লাস্টিকের ব্যবহার আজ অপরিহার্য৷ জীবনের প্রতি ক্ষেত্রে বিকল্প সামগ্রী হিসেবে পলিমারের ব্যবহার হচ্ছে৷ ক্যারি ব্যাগ থেকে ওষুধের বোতল, খাদ্য পরিবেশনের পাত্র থেকে ফুলেব টব— বিভিন্ন ক্ষেত্রে চটের ব্যাগ হোক কিংবা কাঁচের শিশি অথবা চিনেমাটির থালা কিংবা মাটির টব— এ সব কিছুরই বিকল্প হিসেব ব্যবহৃত হচ্ছে প্লাস্টিক৷ অপেক্ষাকৃত সস্তা, বহনযোগ্য হওয়ার কারণে দ্রুত জনপ্রিয়তা পেয়েছ পলিমারে তৈরি সামগ্রী৷ এর ব্যবহার নিয়ে আপত্তি নেই, কিন্তু ব্যবহারের পর যেভাবে এগুলিকে যত্রতত্র ফেলে দেওয়া হচ্ছে, আপত্তি তাতেই৷ সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতার অভাব থাকায় তারা ব্যবহার করা প্লাস্টিকের সামগ্রী যেখানে-সেখানে ফেলে দিচ্ছে৷ যেহেতু প্লাস্টিকের সামগ্রী মাটিতে মিশে যায় না, এর একাংশ পুনর্ব্যবহারযোগ্য নয়, তাই ক্রমশ তা বর্জ্য হিসেবে জমা হচ্ছে লোকালয়ের বুকে৷ আর তা থেকেই ছড়াচ্ছে দূষণ৷ পলিমার সামগ্রী পুড়িয়ে ফেললে আরও বিপদ, হাইড্রোকার্বন হয়ে বাতাসে মিশে তা বাড়িয়ে দিচ্ছে দূষণের মাত্রা৷
বিশ্বের মোট মাছের ৬০ শতাংশ সরবরাহ করা হয় এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল থেকে। যদিও এই অঞ্চলটি সামুদ্রিক প্লাস্টিক দূষণের কেন্দ্রস্থল। প্লাস্টিক ও মাছের অতিরিক্ত এই মজুদ বিশ্বব্যাপী খাদ্য নিরাপত্তা এবং সমগ্র সামুদ্রিক খাদ্য শিল্পকে বিপদে ফেলছে। তারপরও কোনো দেশের সরকার বা বহুপক্ষীয় প্রতিষ্ঠান মহাসাগরের এই সমস্যা সমাধানে কাজ করছে না।
আজ বুধবার (১৫ সেপ্টেম্বর) এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) ঢাকা অফিস থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এসব তথ্য জানানো হয়।
এডিবির টেকসই উন্নয়ন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিভাগের মহাপরিচালক ব্রুনো ক্যারাসকো বলেছেন, এখন পর্যন্ত সমুদ্র প্রকল্পগুলোর জন্য অর্থায়ন স্বল্পমেয়াদী। এ সমস্যা সমাধানে ছোট ছোট চুক্তি থেকে রূপান্তরমূলক বাজার লেনদেনে অগ্রসর হওয়া দরকার। তাই চলতি মাসে এডিবি তার প্রথম নীল বন্ড জারি করেছে। টেকসই ব্লু ইকোনমি গড়ে তোলার পাশাপাশি সমুদ্রের সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য আর্থিক বাজার ব্যবহার করার পরিকল্পনাও নেওয়া হয়েছে।
এডিবি জানায়, ২০১৯ সালে এডিবি এশিয়া এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের জন্য পরিবেশসম্মত মহাসাগর ও টেকসই ব্লু ইকোনমির জন্য পরিকল্পনা চালু করেছে। এই পরিকল্পনায় সমুদ্র স্বাস্থ্য ও সামুদ্রিক অর্থনীতি প্রকল্পের জন্য ২০১৯ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে সহযোগীদের ৫ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করা হয়েছে।
এডিবির ভাইস প্রেসিডেন্ট ফাইন্যান্স অ্যান্ড রিস্ক ম্যানেজমেন্ট ইনগ্রিড ভ্যান উইস বলেন, সমুদ্রের স্বাস্থ্য, সামুদ্রিক প্রোটিন এবং জীবিকার জন্য এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে নিয়ন্ত্রণ করাই প্রধান লক্ষ্য। এ সমস্যা দূর করতে এডিবি অনুপ্রেরণার পাশাপাশি নতুন তহবিল তৈরি করবে। আমরা বিশ্বাস করি, এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য ব্লু বন্ড একটি ভালো পদক্ষেপ হবে।
তিনি জানান, ব্লু বন্ড মডেলটি প্রতিলিপি ও পরিমাপযোগ্য। এডিবি তাদের নিজস্ব ব্লু বন্ড ইস্যু করার প্রচেষ্টাকে সমর্থন করতে অংশীদারদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছে। এটি মৎস্য, সামুদ্রিক এবং উপকূলীয় পর্যটন, উপকূলীয় দূষণ হ্রাস ও বৃত্তাকার অর্থনীতি ত্বরান্বিত করে সামুদ্রিক নবায়নযোগ্য শক্তি, সবুজ বন্দর এবং শিপিং প্রকল্পে বিনিয়োগের মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে। একইসঙ্গে অর্থনৈতিক বৃদ্ধিকে উদ্দীপিত করবে।
এর আগে গত এপ্রিলে সায়েন্স অ্যাডভান্সে প্রকাশিত গবেষণায় দেখা গেছে, সমুদ্রে নদীবাহিত প্লাস্টিক দূষণে শীর্ষ দশ দেশের নয়টিই এশিয়ার।
সায়েন্স অ্যাডভান্সে প্রকাশিত গবেষণায় দেখা গেছে, সমুদ্রে নদীবাহিত প্লাস্টিক দূষণে শীর্ষ দশ দেশের নয়টিই এশিয়ার।
নেদারল্যান্ডস, জার্মানি ও নিউজিল্যান্ডের সাত গবেষকের করা এই গবেষণা বলছে, সমুদ্রের প্রায় ৮০ ভাগ প্লাস্টিক বর্জ্য আসে পৃথিবীর এক হাজারেরও বেশি নদী থেকে। এর একটি বড় অংশ আসে এশিয়ার নদীগুলো থেকে।
নতুন গবেষণা অনুযায়ী, সাগরদূষণে দায়ী দেশগুলোর যে তালিকা করা হয়েছে, তাতে দেখা গেছে শীর্ষ দশে ব্রাজিল ছাড়া বাকি সব দেশ এশিয়ার। শীর্ষ ৫০টি নদীর মধ্যে এশিয়ার আছে ৪৪টি। এর মধ্যে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ ফিলিপাইনের রাজধানী ম্যানিলার জনবহুল এলাকা দিয়ে বয়ে যাওয়া পাসিগ নদী দূষণের তালিকায় সবার ওপরে। এই নদী বছরে প্রায় ৬৯ হাজার টন প্লাস্টিক বহন করে সাগরে নিয়ে যাচ্ছে। দেশটি বছরে মোট ৩ লাখ ৬০ হাজার প্লাস্টিক বর্জ্য সমুদ্রে ফেলে। তালিকায় দ্বিতীয় ভারত ও তৃতীয় অবস্থানে আছে চীন। ভারতের নদীগুলো বছরে ১ লাখ ৩০ হাজার টন বর্জ্য সমুদ্রে নিয়ে যায়। চীন তৈরি করে প্রায় ৭১ হাজার টন।
তালিকায় ৯ নম্বরে থাকা বাংলাদেশের নদীগুলো বছরে প্রায় ২৫ হাজার টন প্লাস্টিক বর্জ্য সমুদ্রে নিয়ে যায়। বিশেষ করে ভারত ও বাংলাদেশের গঙ্গা-পদ্মা-মেঘনা বেসিন, কর্ণফুলী ও রূপসা নদী থেকে সবচেয়ে বেশি প্লাস্টিক বর্জ্য যায় বঙ্গোপসাগরে। পদ্মা দিয়ে বছরে প্রায় সাত হাজার টন, কর্ণফুলী দিয়ে প্রায় তিন হাজার টন এবং রূপসা দিয়ে প্রায় ১ হাজার ৪০০ টন প্লাস্টিক বর্জ্য সমুদ্রে গিয়ে পড়ে।
শীর্ষ দশে এসব দেশ ছাড়াও নাম আছে মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, মিয়ানমার, ভিয়েতনাম ও থাইল্যান্ডের। শুধু এই দেশগুলোই বছরে প্রায় ৫ লাখ ৮০ হাজার টন বর্জ্য ফেলে সমুদ্রে। আশার কথা হলো, সমুদ্র পরিষ্কার করার জন্য এখন পৃথিবীতে অনেকগুলো সংস্থা কাজ করছে। তারা প্রচুর অর্থও সেখানে ব্যয় করছে। কিন্তু গবেষকরা বলছেন, শুধু পরিষ্কার করাই সমাধান হতে পারে না। জনবসতিপূর্ণ এলাকাগুলো দিয়ে যেসব নদী বয়ে গেছে, সেসব এলাকায় পানিতে প্লাস্টিক বর্জ্য যেন না ফেলা হয় তেমন উদ্যোগ নিতে হবে।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরিবেশের ওপর ইতিবাচক প্রভাব নিশ্চিতে পলিথিন শপিং ব্যাগের উৎপাদন, ব্যবহার, বিপণন ও বাজারজাতকরণের ওপর জারিকৃত নিষেধাজ্ঞা পালনে দেশের জনগণকে সম্পৃক্ত করা দরকার।
তারা বলেন, সরকারের পরিবেশ অধিদপ্তর, পুলিশ প্রশাসন ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সদিচ্ছা, আন্তরিকতা, সততা, দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ এবং জবাবদিহিতার অভাব ও রাজনৈতিক অঙ্গীকারের অভাবে বর্তমানে পলিথিনের উৎপাদন ও ব্যবহার আগের চেয়ে অনেকগুণ বেড়ে গেছে। একইসঙ্গে রয়েছে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের অবহেলা।
তারা বলেন, ‘আগামী বছরগুলোতে প্লাস্টিকের ব্যবহার কি বাড়বে? আমরা অনায়াসে বলতে পারি বাড়বে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে হাত মিলিয়েই বাড়ছে প্লাস্টিকের ব্যবহার। তারা বলেন, অর্থনীতিতে যত বেশি প্রবৃদ্ধি আসছে প্লাস্টিকের ব্যবহারও বাড়ছে। প্লাস্টিক ব্যবহার হচ্ছে নির্মাণে, অবকাঠামো উন্নয়নে, ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিকস শিল্পে এবং পরিবহনে।
তারা বলেন, আপনার ছোট ছোট পদক্ষেপে সমুদ্র দূষণ কমতে পারে। সবাইকে এ বিষয়ে সচেতন হতে হবে এবং চারপাশের মানুষকেও সমুদ্রের গুরুত্ব সম্পর্কে জানাতে হবে। সমুদ্রে বেড়াতে গেলে আমরা জেনে বা না বুঝে বিভিন্ন খাবারের প্যাকেটসহ বোতল বা প্লাস্টিক ইত্যাদি পানিতে ফেলে দূষিত করি। এবিষয়েও সচেতন থাকতে হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩৫১
আপনার মতামত জানানঃ