অটোমান সাম্রাজ্য বলতে বর্তমান তুরস্কের সাম্রাজ্যকে বুঝায়। তবে অটোমান সাম্রাজ্যের মত এত বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে শাসন সেই সময়ে অন্য কোন সাম্রাজ্যের ছিল না। যে কারণে অটোমান সুলতান প্রথম সুলেমান কে বলা হত পৃথিবীর বাদশাহ। তুরস্কের ইস্তাম্বুল শহর থেকে সারা পৃথিবীর তিনটি মহাদেশ শাসন করা এই রাজবংশ টিকে ছিল ৬২৪ বছর। মুসলিম এই রাজবংশের শাসনতলে ছিল বর্তমান বিশ্বের ইউরোপের ক্ষমতাধর ফ্রান্স, হাঙ্গেরি, বুলগেরিয়া সহ প্রায় সকল দেশই। এছাড়া সুদীর্ঘ ৬২৪ বছর ব্যাপী অটোমান সুলতানগণ শাসন করেছেন এশিয়া ও আফ্রিকার দেশসমূহ সহ বর্তমান বিশ্বের প্রায় শতাধিক দেশ।
অটোমান সাম্রাজ্য যখন তার সোনালি অধ্যায় সূচনার পথে ঠিক তখন পারস্যে সাফাভি রাজবংশের গোড়াপত্তন হয়। সৃষ্টির পর থেকেই অটোমানদের সাথে তাদের দ্বন্দ্ব, যা স্থায়ী হয়েছিল সাফাভিদের উত্তরসূরি আফশারি রাজবংশ পর্যন্ত। ১৫১৪ সাল থেকে ১৭৪৭ সাল পর্যন্ত মুসলিম বিশ্বের দুই শক্তিশালী সাম্রাজ্যের মধ্যে ৫টি যুদ্ধ হয়।
অটোমান আর সাফাভিদ সাম্রাজ্যের মধ্যে যুদ্ধের প্রধাণ কারণ ছিল মধ্যপ্রাচ্য নিয়ন্ত্রণ এবং খুব স্বাভাবিকভাবেই নিজ নিজ সাম্রাজ্যের সীমানার বিস্তৃতি ঘটানো। দুই পক্ষের রেষারেষিতে মূল রসদ হিসেবে কাজ করেছিল ধর্মীয় মতভেদ। ধর্মীয় বিশ্বাসে দুই সাম্রাজ্যই ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসি থাকলেও অটোমানরা ছিলেন সুন্নি মুসলিম। অন্যদিকে সাফাভিরা ছিলেন শিয়া। এই সাফাভিদদের হাত ধরেই ইরানে শিয়া মতবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়। মূলত অটোমানদের সাথে এখান থেকেই দ্বন্দ্বের সূত্রপাত।
যুদ্ধের ক্ষেত্র প্রস্তুত
এই ঐতিহাসিক দ্বন্দ্বের সূতপাত ১৫০০ সালে। যখন সাফাভি রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা প্রথম ইসমাইল তার কিছু শিয়া অনুসারী যোদ্ধাদের নিয়ে আজারবাইজানের আক কয়ুনলু সালতানাতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। আক কয়ুনলু তখন ইরাক, ইরান ও ককেশাসের বড় একটি অংশ শাসন করতেন।
১৫০২ সালের মধ্যে ইসমাইল ও তার কিজিলবাস আন্দোলনের সমর্থকরা আক কয়ুনলুর অধীনে থাকা অধিকাংশ জায়গা দখল করে। তখন কয়ুনলু বাধ্য হয়ে অটোমান সাম্রাজ্যের সুলতান দ্বিতীয় বায়েজিদের সাহায্য প্রার্থনা করেন।
অটোমান সুলতান কয়ুনলুর আবেদনে সাড়া দিয়ে কিছু সৈন্য পাঠান, যাদের নেতৃত্ব দেন জাল পাশা এবং উসমান পাশা। ১৫০৩ সালে হামাদানের যুদ্ধে কয়ুনলুর সেনাদের সাথে অটোমান সেনারা যোগ দিলেও এই যুদ্ধকে অটোমান বনাম সাফাভি যুদ্ধ বলা যায় না। অটোমানরা কয়ুনলুকে সাহায্য করার পরও যুদ্ধে শাহ ইসমাইল জয়লাভ করে।
হামাদানে জয়লাভ করার পর সাফাভিরা ইরানের সমগ্র মালভূমি দখল করার মধ্য দিয়ে আক কয়ুনলু রাজ্যকে বিলীন করে দেন। কয়ুনলুকে হারানোর পর ইসমাইল নিজেকে ইরানের শাহ হিসেবে ঘোষণা করেন। এ সময় ওই অঞ্চলের সুন্নিদের উপর জোরপূর্বক শিয়া মতবাদ চাপিয়ে দেয়া হয়। এরপর ধীরে ধীরে পুরো ইরানে শিয়া মতবাদ ছড়িয়ে পড়ে। এছাড়া শাহ ইসমাইল যেসব অঞ্চল দখল করেছেন সেখানকার সুন্নি মসজিদ ও মাজার গুঁড়িয়ে দেন।
এখানে থেমে থাকেননি শাহ ইসমাইল। ১৫০৭ সালে তিনি অটোমান সাম্রাজ্যের পূর্ব সীমান্তে দুলকাদিরদের উপর হামলা করেন। সাফাভি সৈন্যরা পূর্ব আনাতোলিয়ার মধ্য দিয়ে গিয়ে দুলকাদিরদের উপর হামলা করে। পূর্ব আনাতোলিয়া ছিল অটোমান সাম্রাজ্যের অংশ। এরপরও অটোমান সুলতান দ্বিতীয় বায়েজিদ কোনো প্রতিশোধ নেওয়ার চেষ্টা করেননি।
শাহ ইসমাইলের পরাজয়
সময়ের পরিক্রমায় সাফাভিরা সরাসরি অটোমানদের হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। শিয়া যোদ্ধারা পূর্ব আনাতোলিয়ায় ছোট ছোট বিদ্রোহ শুরু করে। এরপর শাহকুলুর নেতৃত্বে আনাতোলিয়ার অটোমান প্রশাসকদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করলে নড়েচড়ে বসেন সুলতান দ্বিতীয় বায়েজিদ৷
শুরুতে শাহকুলুর সমর্থকরা কিছু সাফল্য পায় এবং বেশ কয়েকজন অটোমান সেনাকে হত্যা করতে সক্ষম হয়। কিন্তু এরপর অটোমানদের অভিযানের মুখে শাহকুলু প্রাণ হারান। কিন্তু এরপরও তার সমর্থকরা আত্মসমর্পণ করতে রাজি হয়নি। তাদের কিছু সাফাভিদের নিয়ন্ত্রিত রাজ্যে চলে যান। আর কিছু অংশ আনাতোলিয়ার পাহাড়ি অঞ্চলে পুনরায় সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করেন।
সুলতান বায়েজিদের পুত্র সুলতান সেলিম শত্রুদের প্রতি কখনোই দয়া দেখাননি। ১৫১২ সালে সিংহাসনে বসার দু’বছর পর সুলতান সেলিম সাফাভিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণা দেন। যাতে করে আনাতোলিয়ায় আর শিয়া মতাদর্শে বিশ্বাসীরা বিদ্রোহের কোনো রসদ না পায়।
১৫১৪ সালের ২৩ আগস্ট ব্যাটল অব চালদিরানে শাহ ইসমাইলকে পরাজিত করেন সুলতান সেলিম। এবং সেই সাথে সাফাভি সাম্রাজ্যের রাজধানী তাবরিজ দখল করেন। এরপর সুলতান সেলিম ইরানের আরে ভেতরে গিয়ে পুরো সাফাভি সাম্রাজ্য জয় করার ইচ্ছা প্রকাশ করলেও জেনেসারিরা সায় দেননি। এরপর ১৫১৭ সাল পর্যন্ত সুলতান সেলিম আনাতোলিয়ায় শিয়া সমর্থকদের বিদ্রোহ দমন করেন।
ইসমাইলের পূর্বে সাফাভি নেতারা শিয়া মতবাদ রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেননি। শাহ ইসমাইল সেই দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। তিনি ঘোষণা করে সাফাভি সাম্রাজ্যে একমাত্র শিয়া মতবাদে বিশ্বাসীরা থাকবেন। অন্য সকল ধর্মীয় বিশ্বাসীদেরও এর আওতায় আসতে হবে।
এখানে বলে রাখা ভালো, শিয়ারা বিশ্বাস করেন হযরত মোহাম্মদ (সা) এর মৃত্যুর পর খিলাফতের যোগ্য উত্তরসূরি ছিলেন হযরত আলী (রা)। কিন্তু তিনি ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে সেই সময় খলিফা হতে পারেননি। এছাড়া তারা ১২ ইমামে বিশ্বাসী। যার সর্বশেষ ইমাম হবেন ইমাম মাহাদী বা মেসিয়াহ (ইহুদিরা এই নাম ব্যবহার করেন)।
শাহ ইসমাইলের শিয়া ও কিজিলবাস সমর্থকদের অনেকেই বিশ্বাস করতেন তিনি নিজেও একজন ইমাম। যদিও তিনি তা কখনোই দাবি করেননি। তার সমর্থকরা এটাও বিশ্বাস করতেন যে, মধ্যপ্রাচ্যের নিয়ন্ত্রণ এবং খিলাফত তাদের মাধ্যমেই পরিচালিত হওয়া উচিত। যদিও ইসলামী খিলাফতের প্রধান তখন অটোমান সুলতানরা।
যুদ্ধ আর চুক্তির চক্রে দুই সাম্রাজ্য
অটোমান সাম্রাজ্যের শ্রেষ্ঠ সুলতান বলা হয় সুলতান সেলিমের উত্তরসূরি সুলতান সুলেমানকে। তিনিই প্রথম সুন্নি অটোমান আর শিয়া সাফাভি সাম্রাজ্যের মধ্যে বিবাদ মেটানোর চেষ্টা করেছিলেন; যাতে চিরতরে দুই সাম্রাজ্যের মধ্যে আর কোনো যুদ্ধ না হয়।
শাহ ইসমাইলকে হারানোর পর থেকে সাফাভিদের সাথে অটোমান সাম্রাজ্যের ব্যবসা-বাণিজ্য নিষিদ্ধ ছিল। এবং ইরানের কোনো শিয়া মুসলিম মক্কায় হজ্ব করার সুযোগ পেতেন না। সুলতান সুলেমান সিংহাসনে বসার পরও এই নিয়মের কোনো পরিবর্তন হয়নি।
বরং ১৫৩২ সাল থেকে আবারো সাফাভিদের সাথে অটোমানদের যুদ্ধ শুরু। দীর্ঘ ২৩ বছরের যুদ্ধ শেষে ১৫৫৫ সালে পারস্যের শাহ তামাস্প সুলতান সুলেমানের সাথে শান্তিচুক্তি করতে বাধ্য হন। এই চুক্তির পর সাফাভি ও অটোমানদের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য চালু হয়। সেই সাথে দুই সাম্রাজ্যের সীমানা নির্ধারণের পাশাপাশি ইরানের শিয়া মুসলিমদের মক্কায় হজ্বের অনুমতি দেওয়া হয়। বিনিময়ে সাফাভিরা অটোমান সুলতানদের ইসলামের খলিফা হিসেবে মেনে নেয়।
কিন্তু এই চুক্তি দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। ১৫৭৮ সালে সুলতান তৃতীয় মুরাদ ককেশাস দখল করেন। যা সাফাভি সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল। এরপর ১৫৯০ সালে সাফাভিদের হারানোর পর শাহ আব্বাসের সাথে কনস্টান্টিনোপল চুক্তি করেন তৃতীয় মুরাদ। এই চুক্তি অনুসারে সাফাভিরা ককেশাস অটোমান সুলতানের কাছে ছেড়ে দেন। সেই সাথে তৃতীয় মুরাদকে নিজেদের খলিফা হিসেবেও মেনে নেন।
কিন্তু শাহ আব্বাস ছিলেন সাফাভি বংশের শ্রেষ্ঠ শাহ। তিনি সহজেই চুক্তি মেনে নেননি। চুক্তির কয়েক বছর পর শাহ আব্বাস অটোমানদের উপর পাল্টা আক্রমণ করেন। ১৬০৩ সাল থেকে ১৬১৮ সালে মধ্যে শাহ আব্বাস পুনরায় ইরাক, ককেশাস ও পূর্ব আনাতোলিয়ার হারানো ভূখণ্ড উদ্ধার করেন। কিন্তু তিনি তা ধরে রাখতে পারেননি।
১৬২৩ সাল থেকে ১৬৩৯ সাল পর্যন্ত সুলতান চতুর্থ মুরাদ সাফাভিদের উপর হামলা করে আব্বাস যা দখল করেছিলেন তার বেশি উদ্ধার করেন। ১৯৩৯ সালে দুই সাম্রাজ্য জুহাব চুক্তি স্বাক্ষর করে, যেখানে সুলতান সুলেমানের আমাসিয়া চুক্তি মোতাবেক দুই সাম্রাজ্যে সীমানা পুনরায় নির্ধারণ করা হয়।
অটোমানরা তাদের সুদীর্ঘ শাসনকালে অসংখ্য যুদ্ধ করেছে, যার মাত্র ৫টি ছিল সাফাভিদের বিরুদ্ধে। যার মূল উদ্দেশ্য ছিল মধ্যপ্রাচ্যকে নিয়ন্ত্রণ করা। সেই হিসেবে সাফাভিরা অটোমানদের প্রধান প্রতিপক্ষ ছিল না। সাফাভিরা যেখানে আঞ্চলিক শক্তি; অটোমানরা সেখানে ইউরোপ, এশিয়া এবং আফ্রিকা পর্যন্ত নিজেদের সাম্রাজ্যকে বিস্তৃত করেছিল।
এরপরও তাদের সাথে ১৫১৪ সাল থেকে ১৭৪৭ সাল পর্যন্ত লড়াই চলেছে। তখন থেকে অটোমানদের সাম্রাজ্যের সূর্য ঢলে পড়তে শুরু করে। এরপরও ইরান তাদের বড় হুমকি হয়ে উঠতে পারেনি। তবে সাফাভিরা আঞ্চলিক শক্তি হয়েও দীর্ঘসময় পরাক্রমশালী অটোমানদের বিরুদ্ধে লড়ে গেছে।
আপনার মতামত জানানঃ