‘পারসোনাল ডেটা প্রোটেকশন অ্যাক্ট’ নামের আইন করে ভার্চ্যুয়াল জগতের স্পর্শকাতর তথ্যসহ সব তথ্যই এখন তালুবন্দী করতে চাইছে সরকার। প্রস্তাবিত আইন নিয়ে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের প্রাথমিক খসড়ায় তা-ই দেখা যাচ্ছে। খবর প্রথম আলো
এতে বলা হয়েছে, সম্মতি নিয়ে যেকোনো তথ্য সরকার নিতে পারবে এবং প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যবহার করতে পারবে। পুরো বিষয় নিয়ন্ত্রণ করবেন সরকারের নিয়োগ দেওয়া একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। তার অধীনে থাকা কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা তথ্য সংগ্রহের কাজ করতে না পারলে এ দায়িত্ব তৃতীয় কোনো পক্ষকে দিয়ে করাতে পারবেন তারা।
কোনো কারণে যদি ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁস হয় বা কোনো অসংগতি দেখা দেয়, তাহলে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি আদালতে যেতে পারবেন না। তাকে অভিযোগ করতে হবে ডিরেক্টর জেনারেলের কাছেই। ডিরেক্টর জেনারেল যদি আবার দেখেন, সরল বিশ্বাসে তার অধীনস্থ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সব ফাঁস করে দিয়েছেন, তাহলে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আর কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যাবে না। তবে আর কেউ ফাঁস করলে ভুক্তভোগী ক্ষতিপূরণ পাবেন।
তা ছাড়া ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, গুগল, টুইটার, আমাজনসহ সব টেকজায়ান্টকে বাংলাদেশে সার্ভার স্থাপন করতে হবে। এর উদ্দেশ্য হবে বাংলাদেশের নাগরিকদের ডেটা বাংলাদেশের ভেতরে রাখা।
প্রাথমিক খসড়ায় এ আইনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়েছে, বাংলাদেশি নাগরিকদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ও ব্যক্তিগত তথ্যকে সুরক্ষা দেওয়াই এ আইনের উদ্দেশ্য। সুরক্ষা নিশ্চিত করতে এ আইন একজন ব্যক্তির তথ্য সংগ্রহ, তথ্যকে ব্যবহারোপযোগী করা, সংরক্ষণ করা এবং প্রকাশের বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করবে।
কারণ, ব্যক্তিগত গোপনীয়তা, জীবনের অধিকার ও ব্যক্তিস্বাধীনতার সঙ্গে মানুষের চিন্তার স্বাধীনতা ও মর্যাদার বিষয়টি যুক্ত। যে ব্যক্তির তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে, তার অধিকার রক্ষা করবে আইনটি। একই সঙ্গে ডেটা কন্ট্রোলার, ডেটা কালেক্টর, ডেটা প্রসেসরসহ যারা রয়েছেন, তাদের সবাইকে ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষার বাধ্যবাধকতার মধ্যে নিয়ে আসবে এ আইন।
প্রাথমিক খসড়া অনুযায়ী, ডেটা অর্থ ইলেকট্রনিক মাধ্যম ব্যবহার করে পাওয়া তথ্য। যার ব্যক্তিগত তথ্য নেওয়া হচ্ছে, তিনি ডেটা সাবজেক্ট। ডেটা সাবজেক্টের ব্যক্তিগত তথ্য নিয়ে যিনি বা যারা কাজ করবেন, তিনি বা তারা ডেটা কন্ট্রোলার। ডেটা কন্ট্রোলারের অধীনে থেকে ডেটা প্রসেসররা ব্যক্তিগত তথ্য প্রয়োজন অনুযায়ী ঠিকঠাক করবেন। সবার ওপরে থাকবেন ডিরেক্টর জেনারেল।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের প্রয়োগ-বাস্তবায়ন ইত্যাদি দেখার জন্য ডিরেক্টর জেনারেল পদের কথা আইনে বলা আছে। ওই একই ডিরেক্টর জেনারেল এখানেও দায়িত্ব পালন করবেন।
কোনো কারণে যদি ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁস হয় বা কোনো অসংগতি দেখা দেয়, তাহলে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি আদালতে যেতে পারবেন না। তাকে অভিযোগ করতে হবে ডিরেক্টর জেনারেলের কাছেই। ডিরেক্টর জেনারেল যদি আবার দেখেন, সরল বিশ্বাসে তার অধীনস্থ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সব ফাঁস করে দিয়েছেন, তাহলে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আর কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যাবে না। তবে আর কেউ ফাঁস করলে ভুক্তভোগী ক্ষতিপূরণ পাবেন।
জাতীয় দৈনিক প্রথম আলো থেকে জানা যায়, প্রাথমিক খসড়ায় ব্যক্তিগত তথ্যের বাইরেও প্রয়োজনে স্পর্শকাতর তথ্য নেওয়ার সুযোগ আছে। স্পর্শকাতর তথ্য হলো জাতিগত, ধর্মীয়, দর্শনগত ও অন্যান্য বিশ্বাস, যেমন: রাজনৈতিক মতাদর্শ, রাজনৈতিক দলের সদস্যপদ, ট্রেড ইউনিয়ন, সংগঠন, বায়োমেট্রিক অথবা জেনেটিক ডেটা অথবা ব্যক্তির স্বাস্থ্য ও যৌনজীবন–সম্পর্কিত তথ্য। তা ছাড়া কোনো অপরাধ করেছেন বা করিয়েছেন কি না, আইনগত প্রক্রিয়া শেষ হয়েছে কি না, হলে শাস্তি হয়েছে কি না, তাও স্পর্শকাতর তথ্য।
প্রাথমিক খসড়া অনুযায়ী, সরকারের জন্য (ডেটা কন্ট্রোলার) কোনো আইনগত বাধ্যবাধকতা থাকলে বা সরকার যৌক্তিক মনে করলেই ব্যক্তিগত তথ্য হস্তগত করতে পারবেন। আবার ব্যক্তি যদি কোনো চুক্তির অংশ হন, তাহলেও ওই ব্যক্তির তথ্য নিতে পারবে। অথবা ব্যক্তি নিজেই যদি কোনো চুক্তির অংশ হতে চান, তিনিও তথ্য দিতে পারবেন।
ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহের কর্তৃত্ব থাকবে সরকারের প্রতিনিধি বা ডেটা কন্ট্রোলারের হাতে। তিনি যাকে নিয়োগ দেবেন, তিনিই ব্যক্তির কাছ থেকে সরাসরি তথ্য সংগ্রহ করতে পারবেন। অন্য কোনো ব্যক্তি, সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান বা সরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকেও তথ্য সংগ্রহ করা যাবে। ব্যক্তি নিজেও স্বেচ্ছায় তথ্য দিতে পারেন বা তিনি স্বীকৃত কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে তথ্য সংগ্রহের অনুমোদন দিতে পারেন। ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ক্ষুণ্ন না হলে অন্য যেকোনো সূত্র থেকে তথ্য সংগ্রহ করা যাবে। তা ছাড়া অপরাধ প্রতিরোধ, অপরাধী শনাক্ত, তদন্ত অথবা জাতীয় নিরাপত্তার প্রয়োজনে ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ করা যাবে।
তবে যার তথ্য নেওয়া হচ্ছে, তাকে জানানোর একটা বাধ্যবাধকতা আছে। তার কাছ থেকে সুস্পষ্টভাবে অনুমতি নেওয়ার কথাও বলা আছে। কোথাও যদি সরকারি কর্মকর্তারা ভুলভ্রান্তি করে বসেন বা আর কেউ তথ্য প্রকাশ করে দেন, তাহলে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি ডিরেক্টর জেনারেলের কাছে অভিযোগ করতে পারবেন। তার মানহানি হলে তিনি ক্ষতিপূরণ পাবেন।
তথ্য ও যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ অবশ্য বলেছেন, ‘নজরদারি বা সার্ভেইলেন্স এ আইনের উদ্দেশ্য নয়। আমরা চাই না আমাদের নাগরিকদের তথ্য অরক্ষিত থাকুক। ফেসবুক ও গুগল এখন নতুন ঔপনিবেশিক শক্তি। সামনের দিনগুলোয় তথ্য হবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র। মানুষ বুঝে বা না বুঝে তাদের ব্যক্তিগত তথ্য এদের হাতে তুলে দিচ্ছে। তাদের কাছ থেকে তথ্য ফাঁসের ঘটনাও ঘটেছে।’
প্রতিমন্ত্রী আরও বলেছেন, এখনো কোনো খসড়া চূড়ান্ত হয়নি। এখনো তারা আলাপ-আলোচনার মধ্যে আছেন এবং বিভিন্ন দেশের আইন পর্যালোচনা করছেন বলে জানিয়েছেন। খসড়া হলে তারা ওয়েবসাইটে প্রকাশ করবেন। তবে চলতি বছরের জুনে একটি জাতীয় দৈনিককে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি প্রাথমিক খসড়া করার কথা স্বীকার করেছিলেন।
এ বছরের জুনে সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশনের ষষ্ঠ প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার উপস্থিত ছিলেন। সংবাদপত্রের খবরে প্রকাশ, ওই অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, বাংলাদেশ সরকার ফেসবুক ও ইউটিউবের কাছে যত তথ্য চেয়েছে, তার মাত্র ৪০ শতাংশ দিয়েছে ফেসবুক ও ইউটিউব। তারা শুধু রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ব্যাপক অপপ্রচার এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে সন্ত্রাসসংক্রান্ত তথ্য দিয়ে সাহায্য করছে। কিন্তু কোনো নাগরিক যদি জঙ্গিবাদ বা গুজব ছড়ায়, তখন আর তথ্য দেয় না। তারা বলে, এগুলো বাক্স্বাধীনতা। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন যথেষ্ট নয়। এ সমস্যা সমাধানে নতুন আইন করা হচ্ছে। তার খসড়াও করা হয়েছে।
তবে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলেন, প্রায় সব ধরনের সেবা নিতে এখন ব্যক্তিগত তথ্য দেওয়া-নেওয়া করতে হয়। সে কারণে ব্যক্তিগত তথ্যের সুরক্ষা দিতে বিশ্বের ১৩৫টির মতো দেশ আইন করেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর জন্য জেনারেল ডেটা প্রোটেকশন রেগুলেশন (জিডিপিআর) আছে। এগুলোর উদ্দেশ্য হচ্ছে জনগণের ব্যক্তিগত তথ্যের গোপনীয়তা নিশ্চিত করা। পাশাপাশি একজন মানুষ যেন ডিজিটাল দুনিয়ায় নিরাপদ বোধ করে, তার ব্যবস্থা করা।
কিন্তু প্রাথমিক এ খসড়ায় সরকার ব্যক্তিগত তথ্যের বাণিজ্যিক ব্যবহার বন্ধে এ আইন করছে, নাকি মানবাধিকারের দৃষ্টিকোণ থেকে করছে, না রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার কথা মাথা রেখে করছে, তা-ই স্পষ্ট হয়নি বলে।
মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বিভিন্ন সময়ে বলেছে, বাংলাদেশে মত প্রকাশের অধিকারকে আরও খর্ব করার চেষ্টা জোরদার করেছে সরকার। এমনকি সরকার ফেসবুককে ব্যবহার করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ওপর আরও নিয়ন্ত্রণ আরোপের চেষ্টা করছে বলেও এক বিবৃতিতে অভিযোগ করেছে সংস্থাটি।
সংস্থাটি বলে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অপব্যবহার করে সহিংসতাকে উসকে দেয়ার বিষয়টি মোকাবিলা করা সরকারের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ কিন্তু প্রায়শই শৃঙ্খলা রক্ষার চেয়ে সমালোচনা বন্ধ করাই হয় রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপের মূল লক্ষ্য। এতে বলা হয়, যখন ব্লগার ও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টরা অনেকেই খুন হয়েছেন। কিন্তু মত প্রকাশের অধিকার সুরক্ষার বদলে সরকারের পক্ষ থেকে বরং সতর্ক করে বলা হয়েছে ধর্মীয় অনুভূতিতে যেন আঘাত না দেয়া হয়। এমনকি সরকার প্রায়ই প্রিন্ট ও ডিজিটাল মিডিয়ার ওপরও নিয়ন্ত্রণ আরোপ করছে বলেও অভিযোগ করে সংস্থাটি।
এসডব্লিউ/পিএ/কেএইচ/১৫০০
আপনার মতামত জানানঃ