২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর অর্থাৎ আজকের এই দিনেই যুক্তরাষ্ট্রে ভয়াবহ হামলার ঘটনা ঘটে। আধুনিক ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলায় সেদিন নিহত হন প্রায় ৩ হাজার মানুষ। আর ঠিক এরপরই সন্ত্রাস দমনের নামে আফগানিস্তানে যুদ্ধ শুরু করে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বুশের প্রশাসন।
যুক্তরাষ্ট্রে অন্যতম দীর্ঘ এই যুদ্ধ শেষ হতে সময় লেগেছে ১৯ বছর, ১০ মাস, ২৩ দিন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের হিসাব মতে, এই যুদ্ধে মারা গেছে কমপক্ষে ২৩২৫ জন মার্কিন সেনা। এর পাশাপাশি ঠিক কতজন বেসামরিক মানুষ নিহত হয়েছেন, তার কোনো হিসেব নেই।
২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে সন্ত্রাসী হামলার পর এর জবাব হিসেবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ ঘোষণা করেছিলেন। বিশ বছর কেটে গেছে, কিন্তু সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সে যুদ্ধ এখনো শেষ হয়নি। বরং বিশ্বের প্রায় সব রাষ্ট্রই কোনো না কোনভাবে সে যুদ্ধের অংশ হয়ে পড়েছে। এর ফলে বদলে গেছে পৃথিবী, বিপন্ন হয়ে পড়েছে বিশ্বের মানুষ।
যা ঘটেছিল নাইন-ইলেভেনে
সেদিন ছিল মঙ্গলবার। সকাল ৮টা ৪৫ মিনিটে ২০ হাজার গ্যালন জেট ফুয়েল ভর্তি আমেরিকান এয়ারলাইনসের বোয়িং-৭৬৭ উড়োজাহাজটি আছড়ে পড়ে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের উত্তর দিকের টাওয়ারে। উড়োজাহাজটি ১১০ তলা ভবনটির ৮০তম তলায় ঢুকে পড়ে। হামলার সঙ্গে সঙ্গেই নিহত হন শত শত মানুষ, ভবনের ভেতরে আটকে পড়েন আরও অসংখ্য মানুষ। ১৮ মিনিট পরে, সকাল ৯টা ০৩ মিনিটে দ্বিতীয় বিমানটি হামলা চালায়। ইউনাইটেড এয়ারলাইনস ফ্লাইট ১৭৫-এর আরেকটি বোয়িং-৭৬৭ উড়োজাহাজ ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের দক্ষিণ দিকের টাওয়ারের ৬০তম তলায় আঘাত হানে। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে টুইন টাওয়ারের উত্তর দিকের ভবনটি ভেঙে পড়ে। ভবনটি ধসে পড়ার সময় ভেতরে যারা ছিলেন, তাদের মধ্যে মাত্র ছয়জনকে জীবিত অবস্থায় উদ্ধার করা গিয়েছিল। প্রায় ১০ হাজার মানুষকে গুরুতর আহত অবস্থায় বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে হামলার প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা পর তৃতীয় হামলাটি হয় যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সদর দপ্তর পেন্টাগনে। সকাল ৯টা ৪৫ মিনিটে পেন্টাগনের পশ্চিম দিকে আঘাত করে আমেরিকান এয়ারলাইনস ফ্লাইট ৭৭-এর বোয়িং-৭৫৭ উড়োজাহাজটি। পেন্টাগনে হামলায় ১২৫ জন সামরিক কর্মকর্তা ও বেসামরিক নাগরিক নিহত হন বলে জানানো হয়। জিম্মি করা বিমানটির ভেতরে থাকা ৬৪ জনও নিহত হন।
চতুর্থ বিমান হামলাটি হয় সকাল ১০টা ১০ মিনিটে। নিউজার্সি থেকে ক্যালিফোর্নিয়ার উদ্দেশে যাত্রা করার ৪০ মিনিট পর ইউনাইটেড ফ্লাইট ৯৩ নামের উড়োজাহাজটি ছিনতাই করা হয়। বিমানে থাকা অবস্থাতেই যাত্রীরা নিউইয়র্ক ও ওয়াশিংটনে হামলার বিষয়ে জেনে যান। পরে পশ্চিম পেনসিলভানিয়ার শ্যাংকসভিলের কাছে একটি ফাঁকা মাঠে উড়োজাহাজটি বিধ্বস্ত হয়। এতে বিমানে থাকা ৪৪ জনের সবাই নিহত হন।
আল-কায়েদার সম্পৃক্ততা
ধারণা করা হয়, হামলাকারীদের আর্থিক মদদ দিয়েছিল ওসামা বিন লাদেনের সংগঠন আল-কায়েদা। হামলাকারীদের মধ্যে কেউ কেউ এক বছরের বেশি সময় ধরে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করে উড়োজাহাজ চালানোর প্রশিক্ষণ নেন। বাকিরাও নাইন-ইলেভেনের আগে বিভিন্ন সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে আসেন। ১৯ হামলাকারী সহজেই বিমানবন্দরের নিরাপত্তাবেষ্টনী ফাঁকি দিয়ে ধারালো অস্ত্র নিয়ে উড়োজাহাজে ওঠেন। উড্ডয়নের পরপরই যাত্রীদের জিম্মি করে পাইলটদের কাছ থেকে নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছিলেন হামলাকারীরা।
নাইন ইলেভেনের পর যা ঘটেছিল
১১ সেপ্টেম্বর টুইন টাওয়ারে হামলার দিন স্থানীয় সময় রাত ৯টায় জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ। এই একটি মাত্র ভাষণে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেন তিনি। বাস্তবে বুশ শুধু তার দেশের পররাষ্ট্রনীতিই নয়, বরং বিশ্বকে বিভাজনের ঘোষণা দিলেন।
বুশ তার ভাষণে বলেন, ‘যেসব সন্ত্রাসী এই ধরনের কাজ করেছে এবং তাদের আশ্রয় দাতাদের মধ্যে আমরা কোনো পার্থক্য করব না। এই যুদ্ধে যারা আমাদের পাশে দাঁড়াবে না, তারা সবাই আমাদের বিরুদ্ধে৷’
২০ সেপ্টেম্বর কংগ্রেসে যৌথ অভিযানের প্রস্তাব পেশ করে রিপাবলিকানরা। ন্যাটোর সদস্যভুক্ত দেশগুলোর সমন্বয়ে পরের মাসেই হামলার পরিকল্পনা শুরু করে ওয়াশিংটন। ৭ অক্টোবর আফগানিস্তানে হামলা শুরু করে মার্কিন নেতৃত্বাধীন ন্যাটো বাহিনী। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহের মধ্যেই তালিবানের পতন ঘটে। কাবুলের ক্ষমতায় বসানো হয় যুক্তরাষ্ট্রের মনোনীত ব্যক্তি হামিদ কারজাইকে।
আফগান যুদ্ধের পর ন্যাটোর পরবর্তী লক্ষ্য নির্ধারিত হয় ইরাক। ২০০১ সালের সেপ্টেম্বরে যখন আফগানিস্তানে হামলার পরিকল্পনা চলছিল তখনই প্রেসিডেন্ট বুশ ইরাকের ওপর হামলার ছক কষতে তার কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছিলেন। সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের কোনো সম্পর্ক না থাকা সত্ত্বেও শুধুমাত্র গণবিধ্বংসী অস্ত্র রয়েছে এই অজুহাত দেখিয়ে ২০০৩ সালের ২০ মার্চ বাগদাদে হামলা শুরু করা হয়। ১ মে প্রেসিডেন্ট বুশ ইরাক যুদ্ধের সমাপ্তি ঘোষণা করেন এবং তখন থেকেই দেশটিতে সেনা দখলদারিত্বের সূচনা হয়। আশ্চর্য বিষয় হচ্ছে, যেই অজুহাত দেখিয়ে ইরাকে হামলা চালানো হয়েছিল সেই গণবিধ্বংসী কোনো অস্ত্রের সন্ধান দেশটিতে পায়নি মার্কিন বাহিনী।
ইরাক যুদ্ধের এই জের যুক্তরাষ্ট্রকে টানতে হয়েছে ২০১৭ সাল পর্যন্ত। ইরাকে মার্কিন সেনাদের নির্যাতনের শিকার ব্যক্তিরা পরবর্তীতে গড়ে তোলে সন্ত্রাসী বাহিনী ইসলামিক স্টেট বা আইএস। ২০১৩ সালে মার্চে দলটি সিরিয়ার রাকা দখল করে। পরের বছর তারা ইরাকের বিস্তৃত অংশ দখল করে। এর পরপরই সন্ত্রাসী সংগঠনটির কার্যক্রম সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রকে যৌথ অভিযান চালিয়ে ২০১৭ সালে পতন ঘটাতে হয় আইএসের।
২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরে সন্ত্রাসী হামলার ছয় সপ্তাহের মাথায় বিতর্কিত প্যাট্রিয়ট আইন পাশ করে বুশ প্রশাসন। এই আইনটিতে মার্কিন যে কোনো নাগরিককে সন্দেহবশত গ্রেপ্তারের ক্ষমতা দেওয়া হয় এফবিআইকে। দেশি ও আন্তর্জাতিক ফোন কল, ই-মেইল ও অনলাইন কার্যক্রমে নজরদারির অনুমতি পায় সংস্থাটি। শুধু তা-ই নয়, এই আইনের বলে যে কোনো অভিবাসীকে বিনা বিচারে যতদিন খুশি আটকে রাখার ক্ষমতা ছিল নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর। মূলত মুসলিম অভিবাসীরা এই আইনে নিপীড়নের শিকার হন।
নাইন ইলেভের আর্থিক ক্ষতির দায় নিতে হয়েছে সারা বিশ্বকেও। হামলার পর এক মাসে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কের এক লাখ ৪৩ হাজার মানুষ চাকরি হারান। বিমানে যাত্রী সংকটের কারণে হামলার পর প্রথম তিন মাসে এভিয়েশন খাতে সংশ্লিষ্ট ৬০ শতাংশ মানুষের চাকরি চলে যায়। নাইন ইলেভেনের পর বিশ্বব্যাপী যে সন্ত্রাসবাদ মাথাচাড়া দেয়, তাতে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ক্ষতি হয় প্রায় ৮০০ বিলিয়ন ডলারের।
যেভাবে কাটছে যুক্তরাষ্ট্রের মুসলিমদের দিন
সব হামলার পর থেকে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত মুসলমানরা বর্ণবাদ ও ক্রমাগত ইসলামফোবিয়ার শিকার হচ্ছেন। ২০ বছর ধরে সরকারি গোয়েন্দা নজরদারির মধ্যে রয়েছেন তারা। বহুগুণে বেড়েছে তাদের ওপর মানসিক নির্যাতন ও বিদ্বেষের ঘটনা। ইসলামবিদ্বেষও বেড়েছে। সর্বোপরি যুক্তরাষ্ট্রের অসংখ্য মুসলিম নাগরিকের জীবন বদলে গেছে। গতকাল শুক্রবার প্রকাশিত আলজাজিরার এক বিশ্নেষণে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।
৯/১১-এর পর যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরেও আমূল পরিবর্তন হয়েছে। মুসলিম সম্প্রদায়ের অনেকে এসব হামলার পরে মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। তাদের একজন হলেন হাসান শেখ।
প্রেসিডেন্ট বুশ চেয়েছিলেন, আমেরিকা তার পেশির জোরে বিশ্বে গণতন্ত্র ছড়িয়ে দেবে। বাস্তবে ঘটেছে উল্টো। সন্ত্রাস শুধু বহির্গত হুমকি নয়, সে একটি অভ্যন্তরীণ হুমকি, এই যুক্তি ব্যবহার করে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কর্তৃত্ববাদী সরকার ক্ষমতা দখল করে বসেছে। রাশিয়া থেকে তুরস্ক, ফিলিপিন থেকে ভারত— সর্বত্রই এখন কর্তৃত্ববাদী সরকার ক্ষমতায়। সন্ত্রাস দমনের নামে এসব দেশের ক্ষমতাসীন সরকার নিজের দেশের মানুষের বিরুদ্ধেই যুদ্ধ ঘোষণা করেছে।
৯/১১-এর দিন সকালে মিশিগানের ডেট্রয়েটের উচ্চ বিদ্যালয়ে বিশ্ব শিক্ষার শ্রেণিতে ছিলেন। প্রথম হামলার পর নির্ধারিত পরীক্ষা নেওয়ার পরিবর্তে তার শিক্ষক শ্রেণিকক্ষের টেলিভিশন চালু করেন, এতে দ্বিতীয় হামলাটি দেখেছিলেন হাসান। তার বয়স এখন ৩৪। তিনি স্মরণ করেন, ‘আমরা শুধু টিভিতে অবাক হয়ে দেখেছিলাম। ওই সব পরিস্থিতির গুরুত্ব তখন আমরা বুঝতে পারিনি।’ হাসান শেখ একজন মুসলমান এবং পাকিস্তানি অভিবাসীর সন্তান। তিনি বলেন, পরবর্তী জীবনে আমাকে পরিস্কার করেছে, এসব ঘটনা যুক্তরাষ্ট্রে একজন মুসলমান হিসেবে আমার অভিজ্ঞতাকে আমূল বদলে দেবে। তিনি বলেন, বুলিংয়ের শিকার হয়েছি এবং স্পষ্টভাবে বর্ণবাদী মন্তব্যের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছি।
সন্ত্রাসী হামলার এক বছর পর তিনি তার পরিবারের সঙ্গে ওয়াশিংটন ডিসি গিয়েছিলেন। তিনি বলেন, তখন তার মা হিজাব পরা থাকায় তাকে সন্ত্রাসী হিসেবে অভিযুক্ত করে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিলেন এক ব্যক্তি।
হাসান বলেন, তিনি ও তার পরিবার এমন বহু ঘটনার শিকার হয়েছেন। হাসানের পরিবারই শুধু নয়, এমন বর্ণবাদী আচরণের শিকার হতে হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের বহু মুসলিম নাগরিককে। ২০০০ সালে মোট ২৮টি এমন ঘটনা ঘটলেও ২০০১ সালে হামলার পর কয়েক মাসে ৪৮১টি বিদ্বেষজনিত অপরাধের ঘটনা ঘটে।
ওয়াশিংটন ডিসিভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠনের মুসলমান আইনজীবীদের সঙ্গে নীতি পরামর্শদাতা হিসেবে কাজ করেন সুমাইয়া ওয়াহিদ। তিনি বলেন, ‘৯/১১ হামলার পর বিদ্বেষ ও বৈষম্য বেড়েছে।’ ওই ঘটনার পর প্যাট্রিয়েট অ্যাক্ট পাস করে যুক্তরাষ্ট্র। এ আইনের মাধ্যমে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা অনলাইন ও অফলাইনে ব্যাপকভাবে নজরদারি ও পর্যবেক্ষণ করেন। এরপর থেকে মুসলমানরা সরকারি নজরদারিতে রয়েছেন। যা আগে কখনও হয়নি। মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে, এ আইনের ফলে বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন মুসলমানরা।
যুক্তরাষ্ট্রের সিএআইআর পরিচালক বরার্ট ম্যাকও তখন বলেছিলেন, ‘৯/১১ হামলার পরপরই যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত সব মুসলমানকে জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।’ ম্যাকও সম্প্রতি সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘তাদের প্রার্থনালয়, সুশীল সমাজ, শিক্ষার্থী গ্রুপ এমনকি ব্যবসা প্রতিষ্ঠাগুলোও ফেডারেল সরকারের নজদারিতে রয়েছে।’
অনিঃশেষ এক যুদ্ধ
আমেরিকার ব্রাউন ইউনিভার্সিটির ‘কস্ট অব ওয়ার’ প্রকল্পের হিসাব অনুসারে, গত বিশ বছর আফগানিস্তান ও ইরাকে যুদ্ধে নিহত হয়েছে প্রায় এক লাখ মানুষ, ব্যয় হয়েছে আট লাখ কোটি মার্কিন ডলার। অর্থের হিসাবে এই যুদ্ধ বাবদ প্রতিদিন খরচ হয়েছে ৩০ কোটি ডলার। আর মানুষের জীবন ও জীবিকার যে ক্ষতি হয়েছে, তার লিখিত কোনো হিসাব কারও কাছে নেই।
যুক্তরাষ্ট্রসহ ৬০টি দেশে এই যুদ্ধ এখনো অব্যাহত। ২০০১ সালে যখন সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের শুরু, তখন জঙ্গিবাদ একটি বা দুটি দেশে সীমাবদ্ধ ছিল। এখন তা প্রায় সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। যুদ্ধ চলছে দেশের ভেতরে ও দেশের বাইরে। ‘কস্ট অব ওয়ার’ প্রকল্পের অন্যতম পরিচালক স্টেফানি সাভেল উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, আরও বিশ বছর পরও হয়তো এই যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতির হিসাব–নিকাশ করতে হবে।
অনেকেই মনে করেন, আল-কায়েদার সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে আফগানিস্তানে মার্কিন হামলা ছিল একটি বাহানামাত্র। আসল লক্ষ্য ছিল ভিন্ন। অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল হয়ে আসা আমেরিকা বিশ্বে নিজের আধিপত্য রক্ষার একমাত্র উপায় হিসেবে ‘সর্বাধিক’ শক্তি প্রয়োগের পথ বেছে নেয়।
অন্যান্যের মধ্যে এই তত্ত্বে বিশ্বাস করেন খ্যাতনামা মার্কিন বুদ্ধিজীবী নোয়াম চমস্কি। নেশন সাপ্তাহিকের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, তালিবান সরকার ওসামা বিন লাদেনকে আমেরিকার হাতে তুলে দেওয়ার প্রস্তাব করেছিল। বুশ সে প্রস্তাব গ্রহণ করেননি। বুশের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ডোনাল্ড রামসফেল্ড বলেছিলেন, ‘আত্মসমর্পণ নিয়ে আমরা কোনো আপস আলোচনা করি না।’ অর্থাৎ চমস্কির কথায়, আমেরিকার একমাত্র লক্ষ্য ছিল নিজের বাহুবল প্রদর্শন ও সবাইকে ভীত করা।
সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের একটা লক্ষ্য ছিল, বিশ্বে আমেরিকার পছন্দমতো নতুন বিশ্ব নির্মাণ। এই বিশ্বাস অথবা ঔদ্ধত্য থেকেই আফগানিস্তান ও ইরাকে প্রাথমিক বিজয়ের পর জর্জ বুশ আমেরিকার পররাষ্ট্রনীতির অন্যতম লক্ষ্য জাতি নির্মাণ বা নেশন বিল্ডিং বলে ঘোষণা দিয়ে ছিলেন। এখন সেই অ্যাডভেঞ্চারের বিশ বছর পর আমেরিকা বলছে, সে আর জাতি নির্মাণে আগ্রহী নয়।
প্রেসিডেন্ট বুশ চেয়েছিলেন, আমেরিকা তার পেশির জোরে বিশ্বে গণতন্ত্র ছড়িয়ে দেবে। বাস্তবে ঘটেছে উল্টো। সন্ত্রাস শুধু বহির্গত হুমকি নয়, সে একটি অভ্যন্তরীণ হুমকি, এই যুক্তি ব্যবহার করে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কর্তৃত্ববাদী সরকার ক্ষমতা দখল করে বসেছে। রাশিয়া থেকে তুরস্ক, ফিলিপিন থেকে ভারত— সর্বত্রই এখন কর্তৃত্ববাদী সরকার ক্ষমতায়। সন্ত্রাস দমনের নামে এসব দেশের ক্ষমতাসীন সরকার নিজের দেশের মানুষের বিরুদ্ধেই যুদ্ধ ঘোষণা করেছে।
এখন পৃথিবীর ছোট-বড় সব দেশেই সরকার নিজ দেশের মানুষের ওপর সার্বক্ষণিক নজরদারির ব্যবস্থা করেছে। মোড়ে মোড়ে ক্যামেরা, তাতে নাগরিকদের প্রতিটি পদক্ষেপের ওপর নজর রাখা হচ্ছে। আধুনিক মুঠোফোন প্রযুক্তি ব্যবহার করে আড়ি পাতা হচ্ছে। মুখে বলা হচ্ছে, এই নজরদারির লক্ষ্য অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাস দমন। বাস্তবে মৃত্যু হচ্ছে গণতান্ত্রিক ভিন্নমতের।
উদাহরণ হিসেবে চীনের কথাই ধরা যাক। বিশ্বজুড়ে নজরদারি ব্যবস্থার ওপর একটি গবেষণাপত্র অনুসারে, পৃথিবীতে এই মুহূর্তে মোট ৭৭০ মিলিয়ন নজরদারি ক্যামেরা চালু রয়েছে, যার ৫৪ শতাংশ চীনে। শানজি প্রদেশের রাজধানী তাই-ইয়ানে প্রতি ১ হাজার নাগরিকের জন্য রয়েছে ১১৭টি ক্যামেরা। শুধু সিসিটিভি নয়, চীনে যে ব্যাপক নজরদারি অবকাঠামো গড়ে তোলা হয়েছে, তাতে সমানভাবে জোর দেওয়া হয়েছে ইন্টারনেট ব্যবহার ও তথ্য নিয়ন্ত্রণের ওপর। এই ইন্টারনেট মনিটরিংয়ের প্রধান লক্ষ্য দেশের উইঘুর মুসলিম সম্প্রদায়। তবে যেখানেই ভিন্নমতের স্বর শোনা যায়, সেখানেই থাকে এই নজরদারি ব্যবহার করে কণ্ঠরোধের ব্যবস্থা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩৪৭
আপনার মতামত জানানঃ