রাজধানী কাবুল দখলের মাধ্যমে পুরো আফগানিস্তান করায়ত্ত করার দুই সপ্তাহের মাথায় নানা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে তালিবান গোষ্ঠী। প্রবল সঙ্কুলতার মধ্যে অপ্রত্যাশিতভাবে পাওয়া দ্রুতগতির বিজয়ের কারণে সৃষ্ট শূন্যতা কাটিয়ে শাসন কাজ চালাতে গিয়ে রীতিমতো লড়াই করতে হচ্ছে আফগান সশস্ত্র এই ইসলামীপন্থী গোষ্ঠীকে।
নগদ সংকট তো রয়েছেই, আরেকটি জটিল সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে তালিবান— দক্ষ জনবলের অভাব। তালিবানরা ক্ষমতায় আসছে, এমন ইঙ্গিত পেতেই বহু আফগান দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছে। এদের অধিকাংশই বিভিন্ন ক্ষেত্রে দক্ষ, অভিজ্ঞ ও মেধাসম্পন্ন লোক। কূটনীতিক, ব্যাংকার, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, অধ্যাপক এবং বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা কট্টরপন্থি তালিবানদের ভয় পেয়ে পালিয়ে গেছে। বলতে গেলে দেশটি এখন প্রায় মেধাশূন্য।
প্রকৃতপক্ষে তারাই ছিলেন সদ্য ক্ষমতাচ্যুত আফগান সরকার এবং সমাজের চালিকা শক্তি। কিন্তু তালিবানের চোখে তারা দুর্নীতিগ্রস্ত। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই মেধাবী জনগোষ্ঠীকে হারানোর কারণে বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র এই দেশটি পরিচালনা ও গঠনে তালিবানকে বেশ বেগ পেতে হবে।
রাচিদ নামে কাবুলের এক সাবেক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা ফ্রান্সে আশ্রয় নিয়েছেন। তিনি বার্তা সংস্থা এএফপিকে বলেন, ‘আমি কখনো আমার দেশ ছাড়তে চাইনি। কিন্তু এখন আমি স্ত্রী–সন্তানসহ ফ্রান্সে আশ্রয় নিতে চাচ্ছি।’
ইউরোপের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকে পড়াশোনা করা ৪০ বছর বয়সী ওই ব্যক্তি বলেন, ‘আফগানিস্তানে আমার সব ছিল। কাজ নিয়েও আমি সন্তুষ্ট ছিলাম। আমার অধীনে ৫০ জন কাজ করতেন। আমার সামাজিক মর্যাদা ছিল। সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, আমি আফগানিস্তানের জনগণের জন্য এত দিন যা করলাম, তার সবই বৃথা গেল।’
রাচিদ বলেন, ‘আমার সঙ্গে যে ৩০ বা ৪০ জন পড়াশোনা করছেন, তারা সবাই দেশ ছেড়েছেন। এটি দেশের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি।’
বছরের পর বছর ধরে যারা আত্মঘাতী বোমা হামলা ও বেছে বেছে লোকজনকে হত্যা করেছে, এখন সেই তালিবানের হাতে দেশ। তাই এই বাহিনীর শাসনকালে নিরাপদে ও স্বাধীনভাবে কাজ করা অসম্ভব বলে মনে করেন রাচিদের মতো অনেকে।
আফগানিস্তান বিষয়ে বিশেষজ্ঞ মাইকেল ব্যারি কাবুলে আমেরিকান ইউনিভার্সিটির শিক্ষক। তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত তারা (তালিবান যোদ্ধা) দেশকে ধ্বংস ও প্রশাসনকে পতন ঘটানোকে প্রধান দায়িত্ব মনে করেছে। আর এ জন্য তারা পাকিস্তান থেকে আর্থিক সহায়তা পেয়েছে।
আর বর্তমান পরিস্থিতিতে তালিবানের দক্ষতা প্রসঙ্গে তিনি ব্যাখ্যা করে বলেন, প্রশাসনের চাকাকে সর্বদা চালু রাখতে তাদের (তালিবান) ন্যূনতম প্রযুক্তিগত দক্ষ লোকজন লাগবে, উচ্চশিক্ষিত লোকজন লাগবে। এ জন্য তাদের আন্তর্জাতিক সহায়তাও লাগবে।
বছরের পর বছর ধরে যারা আত্মঘাতী বোমা হামলা ও বেছে বেছে লোকজনকে হত্যা করেছে, এখন সেই তালিবানের হাতে দেশ। তাই এই বাহিনীর শাসনকালে নিরাপদে ও স্বাধীনভাবে কাজ করা অসম্ভব বলে মনে করেন অনেকে।
তালিবান হয়তো এ অবস্থা ইতিমধ্যে বুঝতে শুরু করেছে। কারণ গত ২৪ আগস্ট তালিবান বাহিনীর এক মুখপাত্র অভিযোগ করে বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র ‘আফগান বিশেষজ্ঞদের’ সরিয়ে নিচ্ছে।
কাবুলে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে তালিবানের মুখপাত্র জাবিউল্লাহ মুজাহিদ বলেছিলেন, ‘আমরা তাদের এটি করতে নিষেধ করেছি। দেশটির নিজেদের বিশেষজ্ঞ জনবলকে দরকার। তাদের অন্য দেশে নিয়ে যাওয়া উচিত নয়।’
এত কিছু জানার পরও তালিবান কেন তাদের স্বঘোষিত শত্রু যুক্তরাষ্ট্রকে আফগানিস্তান থেকে অনেক দক্ষ জনবলকে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ দিয়েছে এমন প্রশ্নের জবাবে ব্যারি বলেন, তারা এটি করে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে নিজেদের উদার হিসেবে উপস্থাপন করেছে এবং একই সঙ্গে তারা সম্ভাব্য বিরোধিতা থেকেও রেহাই পাচ্ছে।
আগেরবার আফগানিস্তানের ক্ষমতায় থাকাকালে কূটনীতি থেকে অনেকটা বিচ্ছিন্ন ছিল তালিবান। এবার তালিবান আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেতে আগ্রহী। কিন্তু অনেক দেশই এরই মধ্যে কাবুলে কূটনৈতিক মিশন বন্ধ করেছে।
তালিবান এ পর্যন্ত চীন, ইরান রাশিয়ার মতো আঞ্চলিক প্রভাবশালী কিছু দেশের সঙ্গে যোগাযোগ করলেও এখনও কারও স্বীকৃতি পায়নি। পশ্চিমা দেশগুলোও তালিবানকে এখন পর্যন্ত স্বীকৃতি দেওয়ার আগ্রহ দেখায়নি।
সর্বশেষ খবরে কাবুলে ভয়াবহ বোমা হামলা ও আরও হামলার আশঙ্কা তালিবানদের কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি করেছে। এতে বিমানবন্দরের কার্যক্রম ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি বিদেশি নাগরিক এবং দেশত্যাগে ইচ্ছুক আফগানদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া সমস্যাগ্রস্ত হবে। বিশ্বনেতৃত্বও নাগরিকদের নিরাপদে দেশত্যাগের বিষয়ে চিন্তিত। আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশ বোমা হামলার বিরুদ্ধে কঠোর মনোভাব প্রকাশ করেছে। ঘটনার সঙ্গে আইএস-এর সম্পৃক্ততা আছে বলেও মিডিয়ার খবরে প্রকাশ।
ফলে ২০ বছরের যুদ্ধের পর শান্তির বদলে আরও জটিল যুদ্ধাবস্থায় আফগানিস্তান নিপতিত হতে যাচ্ছে বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত। তালিবানদের পক্ষে নতুন নতুন হামলা ও চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা কতটুকু সম্ভব হবে, সেটাই এখন বড় প্রশ্ন।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫৩৪
আপনার মতামত জানানঃ