জাল নথি সৃজন বা তথ্য গোপন করে জালিয়াতির মাধ্যমে হত্যাসহ গুরুত্বপূর্ণ ও চাঞ্চল্যকর মামলার আসামিরা উচ্চ আদালত থেকে জামিন নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। আদালতের সতর্কতা ও সজাগ দৃষ্টি উপেক্ষা করে একটি চক্র জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে বিচার বিভাগের পবিত্রতা ক্ষুন্ন করছে। জামিন জালিয়াতিসহ যেকোনো অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে সম্প্রতি উচ্চ আদালত কঠোর অবস্থান নিলেও জালিয়াতি থামছে না। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতিও আদালত অঙ্গনে দুর্নীতি ও জালিয়াতির বিরুদ্ধে ব্যাপকভাবে প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছে। তার পরও একের পর এক জামিন জালিয়াতির ঘটনা ঘটছে। গত ৩০ সেপ্টেম্বর একটি অস্ত্র মামলায় জালিয়াতি করে জামিন নেয়ায় জড়িত পাঁচজনের বিরুদ্ধে মামলা করার নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। আদেশের সময় আদালত বলেছেন, জামিন জালিয়াতি চক্র নথি জাল করে কত জামিন আদেশ হাসিল করে কে জানে? হয়তো আমরা সবগুলো ধরতে পারি না। নথি সৃজন করে এরকম জামিন জালিয়াতি তো হচ্ছে। হাইকোর্ট আরো বলেন, এরকম অনেক জালিয়াতি হচ্ছে, হয়তো আমরা ধরতে পারি না। আমরা কক্সবাজারের সাড়ে সাত লাখ ইয়াবা মামলায় জামিন জালিয়াতির ঘটনায় আমরা ব্যবস্থা নিতে আদেশ দিয়েছিলাম। কিন্তু কী ব্যবস্থা নিয়েছে তা জানানো হয়নি। অন্য দিকে খুলনার জোড়া খুন মামলার সাত আসামি তথ্য গোপন করে জামিন নেয়ায় তাদের জামিন আদেশ প্রত্যাহার চেয়ে আবেদন করেছে রাষ্ট্রপক্ষ। এ মামলার তিন আসামির দোষ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী থাকলেও তা জামিন আবেদনে গোপন করা হয়েছে। তথ্য গোপন করে জামিন নেয়ার বিষয়টি হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট বেঞ্চের নজরে এনে জামিন আদেশ প্রত্যাহার আবেদন করেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা।
এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি এ এম আমিন উদ্দিন নয়া দিগন্তকে বলেন, আদালত অঙ্গনের জালিয়াতির ঘটনা আমাদের জন্যও বিব্রতকর। আমরা এর বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে। আদালত যদি বলে কেউ জড়িত আমরা তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবো। আর আদালত নিজেই জালিয়াতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারেন। আমরা কাউকে আদালত অঙ্গনকে কলুষিত করার সুযোগ দিতে পারি না।
এ বিষয়ে অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মো: মোমতাজ উদ্দিন ফকির বলেন, আদালতে জালিয়াতির যেসব ঘটনা ধরা পড়ছে তা আমাদের তৎপরতার কারণেই ধরা পড়ছে। জালিয়াতি যারা করে অন্যভাবে করে। আদালতের নলেজে আসে না। বাহির থেকে এগুলো করা হয়। আমরা যেকোনো জালিয়াতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে।
আদালত অঙ্গনের জালিয়াতির ঘটনা আমাদের জন্যও বিব্রতকর। আমরা এর বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে। আদালত যদি বলে কেউ জড়িত আমরা তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবো। আর আদালত নিজেই জালিয়াতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারেন। আমরা কাউকে আদালত অঙ্গনকে কলুষিত করার সুযোগ দিতে পারি না।
১৭ বছরের দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি জালিয়াতি করে জামিন নেয়ার ঘটনায় ৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা করার নির্দেশ : অস্ত্র মামলায় ১৭ বছরের দণ্ডপ্রাপ্ত চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা উপজেলার মো: আব্দুস সাত্তার জালিয়াতি করে জামিন নেয়ায় ঝিনাইদহ কারাগারের দুই কারারক্ষীসহ ৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা করার নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। যাদের বিরুদ্ধে মামলা করতে বলা হয়েছে তারা হলেন- অস্ত্র মামলার আসামি আলমডাঙ্গা উপজেলার কায়েতপাড়া গ্রামের আব্দুস সাত্তার, ঝিনাইদহ কারাগারের দুই রক্ষী কনস্টেবল বিশ্বজিৎ বাবু ও কনস্টেবল খায়রুল আলম, তদবিরকারক চান্দ আলী বিশ্বাস এবং এফিডেভিটকারী আসামি সাত্তারের পিতা নিজামুদ্দিন। গত ৩০ সেপ্টেম্বর এসব আসামি জামিন জালিয়াতির ঘটনায় জড়িত থাকায় বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো: মোস্তাফিজুর রহমানের হাইকোর্ট বেঞ্চ তাদের বিরুদ্ধে মামলা করার আদেশ দেন। একই সঙ্গে তদন্তে আইনজীবী জড়িত থাকার বিষয়টি প্রমাণ হলে তার বিরুদ্ধেও আইনগত ব্যবস্থা নিতে বলেন আদালত। আদেশের আগে আদালত আসামি সাত্তারের আইনজীবী শেখ আতিয়ার রহমানের উদ্দেশে বলেন, এই জামিন জালিয়াত চক্র আপনাকে চিনল কিভাবে? আরো দুটি জামিন জালিয়াতির মামলায় আপনি ও আপনার ক্লার্ক সোহেল রানার নাম এসেছে। একজন সিনিয়র আইনজীবী হিসেবে কি আপনার কোনো দায়িত্ব নেই। মামলা পেলেন আর দাঁড়িয়ে গেলেন। জালিয়াত চক্র আপনার ওপর ভর করেছে কেন? জবাবে আইনজীবী শেখ আতিয়ার বলেন, মাই লর্ড জালিয়াতির বিষয়টি জানতে পেরে আমি আসামির এলাকায় আমার ছেলে ও দুই সহকারী পাঠিয়ে তথ্য নিয়ে আদালতে দাখিল করেছি। শেষ বয়সে এসে আমাকে এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে আমি লজ্জিত।
আইনজীবীরা জানান, ২০১৮ সালে সাত্তারের কাছ থেকে পুলিশ এক রাউন্ড গুলিসহ ওয়ান শুটার গান উদ্ধার করে। এই ঘটনায় করা মামলায় বিচারিক আদালত তাকে দুটি ধারায় ১৭ বছরের কারাদণ্ড দেন। কিন্তু নিম্ন আদালতের ওই রায় বদল করে সেখানে অস্ত্রের পরিবর্তে ‘চাইনিজ কুড়াল’ উদ্ধারের বিষয়টি উল্লেখ করে হাইকোর্টে আপিল করে জামিন চান সাত্তার। হাইকোর্ট আপিল শুনানির জন্য গ্রহণ করে তাকে এক বছরের জামিন দেন। কিন্তু সন্দেহ হওয়ায় তার আইনজীবীই বিষয়টি আদালতের নজরে আনেন। ২১ সেপ্টেম্বর হাইকোর্ট বেঞ্চ জামিনাদেশ প্রত্যাহার করে নেন। শুনানি শেষে হাইকোর্ট জামিন জালিয়াতিতে জড়িত থাকার অভিযোগে ৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা করার জন্য রেজিস্ট্রারকে নির্দেশ দেন। জামিন জালিয়াতিতে জড়িতরা হলেন- আসামি আব্দুস সাত্তার, দুই কারারক্ষী বিশ্বজিত ওরফে বাবু ও খায়রুল, এফিডেভিটকারী আসামির পিতা নিজামুদ্দিন এবং মামলার তদবিরকারক।
তথ্য গোপন করে জোড়া খুন মামলার ৭ আসামির জামিন, রিকল চেয়ে রাষ্ট্রপক্ষের আবেদন খুলনার তেরখাদার জোড়া খুন মামলার সাত আসামি তথ্য গোপন করে জামিন নেয়ায় তাদের জামিন আদেশ প্রত্যাহার চেয়ে আবেদন করেছে রাষ্ট্রপক্ষ। বৃহস্পতিবার বিচারপতি মো: রেজাউল হক ও বিচারপতি এম আতোয়ার রহমানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ আগামীকাল রোববার আবেদনটির ওপর শুনানি ও আদেশের দিন নির্ধারণ করেছেন। এ বিষয়ে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল সাইফুদ্দিন খালেদ বলেন, আসামিদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী থাকার পরও এ তথ্য গোপন করে জামিন নেয়ার বিষয়টি নজরে আসায় আসামিদের জামিন বাতিলের পাশাপাশি গ্রেফতারের জন্য আদালতের নির্দেশনা চেয়েছি। একই সঙ্গে যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য আবেদন করেছি। আইনজীবীরা জানান, গত বছরের ৭ আগস্ট খুলনার তেরখাদায় পূর্ব শত্রুতার জেরে নাঈম শেখ (২৭) নামে এক যুবককে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এ সময় আহত হন নিহত নাঈম শেখের বাবা হিরু শেখ (৫৫)। পরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি। ঘটনার পর দিন তেরখাদা থানায় ১৬ জনকে আসামি করে হত্যা মামলা দায়ের করা হয়। এরই মধ্যে ওই মামলায় তেরখাদার ইউপি চেয়ারম্যান এম দীন ইসলামসহ ১৯ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করেছে পুলিশ। মামলার তিন আসামি শেখ সাইফুল ইসলাম, আব্দুর রহমান ও খালিদ শেখ ওই বছরের আগস্ট মাসে আদালতে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেন। গত বছরের ১৯ ডিসেম্বর খুলনার জেলা ও দায়রা জজ এই মামলার আসামিদের জামিন আবেদন খারিজ করে দেন। পরে তারা গত ১৮ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টে জামিন চান। ওই জামিন আবেদনে তিন আসামির স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেয়ার তথ্য গোপন রাখা হয়। শুনানি শেষে হাইকোর্ট তাদের জামিন মঞ্জুর করেন। পরে কারাগার থেকে সাত আসামি মুক্তি পায়। তারা হলেনÑ শেখ সাইফুল ইসলাম, আব্দুর রহমান, খালিদ শেখ, ইস্কান্দার শেখ, জমির শেখ, জিয়ারুল শেখ ও আব্বাস শেখ।
আপনার মতামত জানানঃ