কিশোরগঞ্জে মাদ্রাসাছাত্র ধর্ষণ মামলার প্রধান আসামি বেলাল হোসেন ওরফে বিল্লালকে (২৫) গ্রেপ্তার করেছে র্যাব-১৪, সিপিসি-২ এর একটি দল। শুক্রবার ভোরে ময়মনসিংহ জেলার গৌরিপুর উপজেলার বিশ্বনাথপুর এলাকা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। তিনি ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার পাড়া পাঁচাশি গ্রামের মুজিবুর রহমানের ছেলে।
র্যাব সূত্র জানায়, ধর্ষণের ঘটনায় কিশোরগঞ্জ সদর মডেল থানায় মামলা হলে র্যাব ছায়া তদন্ত শুরু করে এবং তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করে আসামিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চালায়। শুক্রবার ভোরে র্যাবের একটি দল গৌরিপুরের বিশ্বনাথপুর থেকে মামলার মূল আসামী বিল্লালকে গ্রেপ্তার করে।
র্যাবের কোম্পানী কমান্ডার লেফটেনেন্ট কমান্ডার বিএন এম. শোভন খান জানান, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তিনি ঘটনার সাথে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছেন। পরে তাকে কিশোরগঞ্জ সদর মডেল থানায় সোপর্দ করা হয়।
র্যাব সূত্র জানায়, কিশোরগঞ্জ শহরের নগুয়া শ্যামলী রোডে ৭১৫ জামিয়াতুস সুন্নাহ মাদ্রাসার তৃতীয় তলার টয়লেটে মাদ্রাসার আবাসিক এক ছাত্রকে গত ১৫ আগস্ট শিক্ষক হাফেজ মাওলানা বেলাল হোসেন বিল্লাল ভয়ভীতি দেখিয়ে ধর্ষণ করেন। পরে একইভাবে গত ২৭ আগস্ট পুনরায় ধর্ষণ করেন। এ অবস্থায় ছাত্র বাসায় গিয়ে ঘটনা জানালে ছাত্রের পিতা কয়েকজন আত্মীয়কে সঙ্গে নিয়ে মাদ্রাসায় যান। তারা মাদ্রাসার পরিচালক হাফেজ মাওলানা মুফতি হোসাইন মো. নাঈমকে ঘটনা জানালে পরিচালক বিল্লালকে ডেকে এনে জিজ্ঞাসা করলে তিনি ঘটনা স্বীকার করেন। পরে পরিচালক নাঈমের জিম্মায় বিল্লালকে রেখে তারা বাসায় চলে যান। কিন্তু পরিচালক পরে বিল্লালকে ছেড়ে দিলে তিনি পালিয়ে যান।
এ ব্যাপারে ভূক্তভোগী ছাত্রের পিতা বাদী হয়ে গত ৩০ আগস্ট কিশোরগঞ্জ মডেল থানায় শিক্ষক বিল্লাল ও পরিচালক নাঈমকে আসামি করে মামলা দায়ের করেন।
মামলার বাদী জানান, তিনি ঢাকায় একটি ব্যাংকে চাকরি করেন। তার স্ত্রী একটি প্রাইমারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক। তাদের একমাত্র ছেলেকে কোরআনে হাফেজ বানানোর জন্য ভর্তি করা হয় জামিয়াতুস সুন্নাহ মাদ্রাসায়। ১০ বছর বয়সী ছেলেটি নাজেরা বিভাগ থেকে পাস করে হেফজখানায় ভর্তি হয়। মাদ্রাসাতেই থাকত সে।
সাপ্তাহিক ছুটিতে গত ২৪ আগস্ট ঢাকা থেকে কিশোরগঞ্জ যান তিনি। সেখান থেকে স্ত্রী ও ছেলেকে নিয়ে বেড়াতে যান শ্বশুরবাড়ি। সেদিন বিকেলে শিক্ষক বেলাল তাকে ফোন করে জানান, ছেলেকে দ্রুত মাদ্রাসায় ফিরিয়ে দিতে হবে, না হলে পড়াশোনার ক্ষতি হবে।
ওই ছাত্রের বাবা আরও জানান, মাদ্রাসায় যাওয়ার কথা শুনে তার ছেলে কান্নাকাটি শুরু করে। একপর্যায়ে সে জানায়, গত ১৫ আগস্ট সকালে মাদ্রাসার তিনতলায় একটি টয়লেটে নিয়ে ভয় দেখিয়ে তাকে ধর্ষণ করেন শিক্ষক বেলাল।
‘ধর্ষণের খবর এতদিন বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে দেখে আসছি। আর আজ নিজ পরিবারের মধ্যেই এ ঘটনা ঘটল। আলেম হয়ে এ ধরনের জঘন্য কাজ ওনারা করেন কীভাবে? ছাত্ররা তো তার কাছে সন্তান সমতুল্য।’
একইভাবে গত ২৪ আগস্ট সকালেও তাকে নির্যাতন করা হয়। সেদিনই মাদ্রাসায় গিয়ে অধ্যক্ষের কাছে বিষয়টি জানালে বেলালকে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। বেলাল তা স্বীকার করে সবার কাছে ক্ষমা চান।
ওই ছাত্রের বাবা গণমাধ্যমকে বলেন, ‘বেলালকে মাদ্রাসার অধ্যক্ষের জিম্মায় রেখে বাসায় চলে আসি। স্বজনদের পরামর্শে আবার মাদ্রাসায় গিয়ে ওই শিক্ষকের খোঁজ করে জানতে পারি তাকে পালিয়ে যেতে সহযোগিতা করেছেন মাদ্রাসার অধ্যক্ষ হোসাইন মোহাম্মদ নাঈম।’
ওই ছাত্রের মামা বলেন, ‘ধর্ষণের খবর এতদিন বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে দেখে আসছি। আর আজ নিজ পরিবারের মধ্যেই এ ঘটনা ঘটল। আলেম হয়ে এ ধরনের জঘন্য কাজ ওনারা করেন কীভাবে? ছাত্ররা তো তার কাছে সন্তান সমতুল্য।’
তিনি আরও বলেন, ‘এ ঘটনার পর আমিও গিয়েছিলাম মাদ্রাসায়। সেখানে যাওয়ার পর হুজুরকে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে প্রথমে তিনি অস্বীকার করেন। কিন্তু তাকে কোরআন ছুঁয়ে বলতে বলা হলে তিনি বিষয়টি স্বীকার করেন।’
ওই ছাত্র জানায়, বেলাল আরও কয়েক ছাত্রকে ধর্ষণ করেছেন। বেশ কয়েকটি ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীও সে। তবে ভয় ও লজ্জায় সবাই চুপ থাকে।
মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মোহাম্মদ হোসাইন জানান, ১৭০ জন ছাত্র পড়াশোনা করে তার মাদ্রাসায়। এর মধ্যে ৩০ জন আবাসিক ছাত্র।
তিনি বলেন, ‘বিষয়টি জানার পরই বেলালকে মাদ্রাসা থেকে তাড়িয়ে দেয়া হয়েছে।’
বাংলাদেশে এখন ছেলে শিশু ধর্ষণ উদ্বেগজনক হারে বড়ে গেছে৷ কিন্তু ধর্ষকদের আইনের আওতায় এনে শাস্তি দেওয়ার তেমন কোনো নজির দেখা যায় না। প্রায় সমস্তটাই স্থানীয় জনপ্রতিনিধি কিংবা মাতব্বর কর্তৃক শালিসে বিচারের মাধ্যমে সুরাহা করা হয়। তবে এবিষয়ে আইনে সুস্পষ্টভাবে তেমন কিছু নেই বলে অনেকে দাবি করলেও আইন বিশেষজ্ঞরা জানান, একটা ভুল ধারণা চলে আসছিল যে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে শুধু নারী ও মেয়ে শিশু ধর্ষণের শিকার হলেই বিচার করা যাবে৷ কিন্তু এই আইনের সংজ্ঞায় শিশু বলতে ছেলে বা মেয়ে আলাদা করা হয়নি৷ ১৬ বছর পর্যন্ত সব শিশুকেই বুঝানো হয়েছে৷ শিশু আইনেও শিশুদের কোনো লিঙ্গ ভাগ করা হয়নি৷ তাই ১৬ বছর পর্যন্ত কোনো ছেলে শিশু যদি ধর্ষণের শিকার হয় তাহলে ধর্ষণ মামলাই হবে৷ যার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড৷
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলেন, আলিয়া মাদ্রাসা ছাড়া অন্য মাদ্রাসাগুলোতে সরকারের নিয়ন্ত্রণ বা তদারকি সেভাবে নেই। সেজন্য যৌন নির্যাতন বা শিশু শিক্ষার্থীদের ওপর নির্যাতনের সুযোগ থাকে। এছাড়া সেখানে পরিবেশ এমন যে, শিশু শিক্ষার্থীদের ওপর নির্যাতনের অভিযোগ অনেক সময় প্রকাশও হয় না। কওমি, এবতেদায়ী বা নূরানী-বিভিন্ন ধরনের মাদ্রাসা পরিচালনার জন্য বেসরকারি উদ্যোগে কর্তৃপক্ষ যারা রয়েছে, তাদের তদারকি বাড়ানো উচিত বলে মনে করেন তারা।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, অনেকে মনে করেন এরা আদব কায়দা শিক্ষা দেন। নৈতিকতা শিক্ষা দেন। সে কারণে ধর্মীয় বিশ্বাস থেকে হোক বা নিরাপত্তার কথা ভেবে অনেকে ছেলেমেয়েদের মাদ্রাসায় পড়াতে দেন। কিন্তু বাস্তবতায় দেখা যাচ্ছে, যে নিরাপত্তার কথা ভেবে মাদ্রাসায় ছেলেমেয়েদের পড়াতে দেয়া হয় সেখানে আদৌ নিরাপদ নয়। দেখা যায় ছেলেরাও নিরাপদ নয় এসব তথাকথিত হুজুরদের কাছে। এটিও সমাজের বৈকল্যতা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২০২০
আপনার মতামত জানানঃ